সোমবার, ২ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

গুণবাচক সুশীল ও গবেষণায় চিচিং ফাঁক

ড. জিনাত হুদা

গুণবাচক সুশীল ও গবেষণায় চিচিং ফাঁক

প্রুধোর কথা মনে পড়ে গেল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগে অনিয়ম সংক্রান্ত টিআইবির তথাকথিত গবেষণা প্রতিবেদনটি (!) পড়ে। দারিদ্র্যকে ব্যাখ্যা করার লক্ষ্যে প্রুধো যে বইটি লিখেছিলেন তার নাম The Philosophy of Poverty (দারিদ্র্যের দর্শন)। বইটি কার্ল মার্কসের ভাষায় এতই নিম্নমানের ছিল যে, এর বিরোধিতা করে তিনি আরেকটি বই লিখে তার নাম দেন The Poverty of Philosophy (দর্শনের দারিদ্র্য)। বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগের ব্যবস্থা সম্পর্কে টিআইবির দাবি তারা একটি গুণবাচক বা Qualitative গবেষণা চালিয়েছেন। এই গুণবাচক গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী (১) প্রভাষক নিয়োগে ৩-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত অবৈধ লেনদেন হয় (২) রাজনৈতিক বিবেচনা গুরুত্ব পায় (৩) স্বজনপ্রীতি/এলাকাপ্রীতি গুরুত্ব পায়। টিআইবির এ ধরনের তথাকথিত গুণবাচক গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রভাষক নিয়োগে বিধিবহির্ভূত এসব আর্থিক লেনদেন ও অনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে (১) উপাচার্য (২) উপ-উপাচার্য (৩) শিক্ষকনেতা (৪) বিশেষজ্ঞ, ছাত্রনেতা (৫) ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের একাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে। এ অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা, কর্মচারী, নিয়োগ কমিটির সদস্যদের একাংশের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, ছাত্রনেতাদের মাধ্যমে নগদে বা ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। এই তথাকথিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দেওয়ার জন্য সনদ, নথিপত্র, ব্যাংক ড্রাফট বা প্রকাশনার নমুনা কপি সরিয়ে প্রার্থীদের অযোগ্যতা প্রমাণ করা হয়। অন্যদিকে আবেদনের যোগ্যতা না থাকলেও একই রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী বা পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়।

টিআইবির সুশীল গবেষকরা এ ধরনের একটি গুণবাচক গবেষণা চালিয়েছেন ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। টিআইবির এই গবেষণাটি কোনোভাবেই গুণবাচক গবেষণা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটি হচ্ছে একটি চিচিং ফাঁক প্রতিবেদন। কেন এবং কীভাবে? গুণবাচক গবেষণা হচ্ছে এমন একটি গবেষণা পদ্ধতি যা মূলত একটি  ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতি। এটি in-depth গবেষণা করে কোনো সংবেদনশীল, জটিল কিংবা লুকায়িত সামাজিক প্রপঞ্চ নিয়ে। এই গবেষণাটি বর্ণনামূলক যেখানে সামাজিক অবস্থানের আলোকে, insider perspective এর আলোকে একটি সামাজিক প্রপঞ্চ বা ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা হয়। অর্থাৎ এই গবেষণার ফলাফল সংখ্যাতাত্ত্বিক গবেষণার মতো কোনো হাইপোথিসিসকে গ্রহণ বা বর্জন করে না। এখানে generalization এর কোনো সুযোগ নেই। এই পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহের টুল এবং নমুনায়নের এর চরিত্রও তাই আলাদা। এই পদ্ধতিতে মূলত purposive, snowball sampling ব্যবহার করা হয়। তথ্য সংগ্রহের টুল হিসেবে in-depth interview, case study কিংবা Focus group discussion ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো টিআইবি যে ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তথাকথিত গবেষণা চালিয়েছে এই ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে কোনো sampling method ব্যবহার করা হলো? কী প্রক্রিয়ায় এই নির্বাচন সম্পন্ন হলো?  যেহেতু এই গবেষণাটি in-depth গবেষণা, ফলে যাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তাদের প্রদত্ত Narrative বা বর্ণনাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে। অর্থাৎ টার্গেট গোষ্ঠী প্রদত্ত তথ্য, বর্ণনাই এই পদ্ধতিতে মূল ভূমিকা পালন করে। এই পদ্ধতিতে টার্গেট গোষ্ঠী বা উত্তরদাতাদের উত্তরের আলোকেই গবেষণাটি রূপ নেয়, গবেষকের নিজস্ব উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য পূরণের জন্য নয়। উত্তরদাতারা এখানে গবেষকের হাতের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহৃত হন না। কিন্তু টিআইবির তথাকথিত সুশীল গবেষকরা এই গবেষণায় কাদের টার্গেট গ্রুপ হিসেবে নির্বাচন করেছেন? এই ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবার চরিত্রই কি একই রকম? যদি একই রকম না হয়ে থাকে তবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একই ধরনের নীতিহীনতার আশ্রয় নেওয়া হয় কীভাবে? বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, অবয়ব, সামাজিক চরিত্র, এলাকাভিত্তিক অবস্থান ভিন্ন। এই social context ভিন্ন হওয়ার কারণে in-depth analysis অনুযায়ী গুণবাচক পদ্ধতিতে ভিন্নতা বা ভিন্নমাত্রা আসাটাই ছিল স্বাভাবিক। অথচ টিআইবির সুশীল গবেষকরা রাম, শ্যাম, যদু, মধুদের নিয়ে এই গবেষণা চালিয়েছে বলেই এই social context সম্পূর্ণভাবেই হয়েছে উপেক্ষিত। রাম, শ্যাম, যদু, মধুদের কথা এ কারণেই বললাম যে, টিআইবি কোনোভাবেই এই ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে যেমন স্বচ্ছতা দেখায়নি তেমনি কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কোন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, বিশেষজ্ঞ, ছাত্রনেতাদের কথা বলেছেন তাদের ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেননি। উল্লেখ করেননি এই ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কতজন প্রভাষক ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন, কতজন দিয়েছেন ২০ লাখ টাকা। এই টাকা কীভাবে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য বা বিশেষজ্ঞ সদস্যদের দিয়েছেন? যেসব প্রভাষক এসব আর্থিক লেনদেন করেছেন অনৈতিক উপাচার্য, ডিন বা শিক্ষক সমিতির নেতাদের সঙ্গে টিআইবি কি তাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে? নাকি কেস স্টাডি করেছে? নাকি এসব অভিযুক্ত ব্যক্তিকে এক টেবিলে বসিয়ে FGD করেছে? এক্ষেত্রে এসব উত্তরদাতার বক্তব্য গুণবাচক গবেষণার নীতি মেনে কি রেকর্ডবন্দী করা হয়েছে? এ ধরনের একটি অতিসংবেদনশীল বিষয় নিয়ে (যেটির সঙ্গে দেশ, সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি এবং শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সম্মান, আত্মমর্যাদার বিষয়টি জড়িত) কাজ করতে গিয়ে টিআইবি কীভাবে ঘুষ প্রদানকারী প্রভাষক এবং ঘুষ গ্রহণকারী শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্কে গড়ে তুললেন? কী করে এসব অভিযুক্ত উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এবং প্রভাষক প্রার্থীদের কাছ থেকে বক্তব্য টেনে বের করে নিয়ে এলেন? কী করে তাদের বর্ণনা বা narrative-কে cross-check করলেন? কিংবা গুণবাচক পদ্ধতির এই নিয়মনীতি টিআইবি আদৌ অনুসরণ করেছে কিনা? টিআইবির সুশীল গবেষকদের এসব প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই অবশ্যই দিতে হবে। যদি টিআইবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ডিন, বিশেষজ্ঞ সদস্য এবং নিয়োগপ্রাপ্ত প্রভাষকদের কাছ থেকে কোনো তথ্যই সংগ্রহ না করে থাকে, তবে এটি যে শুধু কোনো গবেষণাই হয়নি তা নয়। বরং গবেষণার নামে এটি হয়েছে সুশীল প্রতারণা। টিআইবি দাবি করেছে প্রভাষক নিয়োগে পদে পদে যে অনিয়ম হয়ে থাকে তা তারা তুলে ধরেছেন। আমি আমার এ লেখনীতে গুণবাচক গবেষণার নামে টিআইবি যে পদে পদে চরম প্রতারণা করেছে, অনৈতিকভাবে অসৎ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কাজ করেছে, তা তুলে ধরছি। তাদের সুশীল গবেষণার ফাঁকফোকর তুলে ধরছি। টিআইবি বলেছে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দেওয়ার লক্ষ্যে ব্যাংক ড্রাফট, প্রকাশনার নমুনা ইত্যাদি সরিয়ে ফেলা হয়। টিআইবির সুশীল গবেষকদের জানা দরকার একজন প্রভাষক প্রায় ১০-১১টি আবেদন ফরম জমা দেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বশর্ত অনুযায়ী। প্রতিটি প্রভাষক প্রার্থীর কাছে নিজস্ব কপিটি থাকে যেখানে আবেদনপত্র, সনদ, ব্যাংক ড্রাফট, প্রকাশনার ফটোকপি থেকে যায়। সুতরাং টিআইবির স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার যদি কোনো কাগজপত্র সরিয়েও ফেলে, প্রভাষক প্রার্থীর নিজস্ব কপিতে সব ডকুমেন্টস কিন্তু থেকেই যায়। সুতরাং যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সরিয়ে ফেলা হয় বলে টিআইবি যে গবেষণা চালাল কাজটা কি খুব বেশি কাঁচা গবেষণা হয়ে গেল না? টিআইবি গবেষণার আরেকটি চিচিং ফাঁকের বিষয় হলো যোগ্যতাহীন প্রার্থী আবেদনের শর্ত পূরণ না করলেও রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী প্রার্থীকে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। টিআইবির জানা উচিত ছিল প্রভাষক নিয়োগের প্রথম ধাপটিই হলো বিভাগীয় বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত সিএনডি পার হওয়া। একটি বিভাগের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকরাই মূলত প্রথমে বিভাগে প্রভাষক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তা নিয়ে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে একটি মতানৈক্যে পৌঁছতে কখনো প্রচুর সময় লাগে, কখনো স্বল্প সময়েও মীমাংসা হয়। সুতরাং টিআইবি যে দাবি করে বসল বেশি বেশি নম্বর দিয়ে একজন শিক্ষক একজন ছাত্রছাত্রীকে প্রথম করে দিয়ে তাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বসে- এটিও আরেকটি অতি সরলীকরণ তথ্য। কারণ যে শিক্ষক বেশি বেশি নম্বর দিচ্ছেন তিনি যে সিএনডির সদস্য হবেন বা নিয়োগ বোর্ডের সদস্য হবেন তার কোনো গ্যারান্টি নেই। সুতরাং সেই ‘ক’ শিক্ষক কীভাবে সেই ‘খ’ শিক্ষার্থীকে প্রভাষক নিয়োগে ভূমিকা পালন করবেন? টিআইবি এসব প্রশ্ন কীভাবে তাদের গবেষণায় তুলে এনেছেন? আদৌ তুলে এনেছেন কিনা? সিএনডির সদস্যরা শুধু প্রভাষক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা-অপ্রয়োজনীয়তা বিষয়েই মতামত জ্ঞাপন করেন না, তারা আবেদন পত্রগুলোও যাচাই-বাছাই করেন। সুতরাং যেসব প্রার্থী আবেদনপত্রের শর্ত পূরণ করে না বা আবেদনই করে না, তাদের সাক্ষাৎকার কার্ড দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না রাজনৈতিক বিবেচনা, আত্মীয়তা বা আঞ্চলিকতার ওপর ভিত্তি করে। আমি একজন সিএনডি সদস্য হিসেবে টিআইবির প্রতিবেদনের এ অংশকে কাল্পনিক মিথ্যাচার বলে অভিহিত করছি। কারণ একটি বড় বিভাগের সিএনডির সদস্য থাকেন ৮-৯ জন ও ছোট বিভাগে ৩-৪ জন। এই ৮-৯ জন শিক্ষক এসব আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই করে রেজিস্ট্রার অফিসে মতামত পাঠিয়ে থাকেন কোন কোন প্রার্থী শর্ত পূরণ করে বা করে না এ বিষয়ে। এখানে উল্লেখ্য, এই শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে শুধু স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ফলাফলই বিবেচনায় নেওয়া হয় না, এসএসসি এবং এইচএসসি ফলাফলের বিষয়টিও গুরুত্ব পায়। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক চাইলেও একজন ছাত্রছাত্রীকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম করে দিতে পারেন না। কারণ একজন ছাত্রছাত্রীকে একটি বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের কোর্স পড়তে হয়। যদি টিআইবির বক্তব্য অনুযায়ী ধরেও নেওয়া যায় বিভাগে একদল অনৈতিক শিক্ষক কোনো ছাত্রছাত্রীকে বেশি বেশি নম্বর দিচ্ছেন সেই ছাত্রছাত্রীকে কোনো না কোনো পর্যায়ে সেই বিভাগেরই আরেক দল অত্যন্ত নীতিবান, বিবেকবান এবং হার্ড মার্কার শিক্ষকদের কোর্সও পড়তে হয়। সুতরাং বেশি নম্বর পাওয়ার ক্ষেত্রে তখন আবার ভারসাম্য এসে যায়। তদুপরি কোনো কোনো কোর্সে যদি বেশি নম্বর ওঠে আসে সেক্ষেত্রে তৃতীয় পরীক্ষকের ব্যবস্থা করা হয়। তদুপরি ভাইভা বোর্ডে যদি তথাকথিত অনৈতিক শিক্ষক বেশি নম্বর দেওয়ার চেষ্টা করেন, সেক্ষেত্রেও বহু তর্ক, বিতর্ক এবং প্রশ্ন ওঠে যায়। আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকেই এই সত্যকে প্রকাশ করছি। কিন্তু টিআইবি আমাদের মতো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষকের in-depth interview বা case-study করেছে কিনা তা তো প্রকাশই করেনি। মূলত এ প্রতিবেদনটি পড়ে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সবার মনে- এ গবেষণার উদ্দেশ্য কী? কারণ তাদের এ গবেষণার একটি অংশ নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী কোনো শিক্ষক, নারী শিক্ষার্থীর একাংশকে টার্গেট করে বেশি বেশি নম্বর দিয়ে তাদের শিক্ষক বানিয়ে দেয়। এটি কি টিআইবির সুশীলদের বক্তব্য? নাকি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও তেঁতুল হুজুরদের বক্তব্য? স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সারা বিশ্বেই যে কখনো কখনো ছাত্রীরা পুরুষ শিক্ষক কর্তৃক শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন না তা নয়। এটি পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার একটি কুিসত বাস্তবতা। তবে এ ধরনের নীতিবিহীন কাজের জন্য গঠিত হয়ে আছে তদন্ত কমিটি। আমি নিজে বেশ কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের তদন্ত কমিটির সদস্য।

কিন্তু টিআইবি আজ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষকদের এক অংশের দিকে তেঁতুল হুজুরের বা সাঈদীর মতো অনৈতিকতার দোহাই দিয়ে কুিসত আঙ্গুল তুলেন তখন টিআইবির এ প্রতিবেদনকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করাকেই নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি। তবে গুণবাচক গবেষণা, সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত গবেষণার ধুয়া টিআইবি তুলেছে বলে আবারও প্রশ্ন করি- এ ধরনের কতজন অনৈতিক মহিলা শিক্ষিকাকে আপনারা in-depth study করেছেন? এমন একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কী ধরনের প্রশ্ন ব্যবহার করেছেন? যে ‘ক’ পুরুষ শিক্ষক ‘খ’ নারী শিক্ষককে বেশি নম্বর দিয়ে দিল, সে পুরুষ শিক্ষক সে ‘খ’ নারী শিক্ষককে কটা কোর্স পড়িয়েছিলেন? সে পুরুষ শিক্ষক কি সেই ‘খ’ শিক্ষকের থিসিস সুপারভাইজার ছিলেন কিংবা টিউটোরিয়াল গ্রুপে ছিলেন? সেই ‘ক’ পুরুষ শিক্ষক কি ফাইনালে ভাইভা বোর্ডে এবং নিয়োগ বোর্ডেও ছিলেন? একজন পুরুষ ‘ক’ শিক্ষক যখন নারী ‘খ’ শিক্ষার্থীকে নিয়ে এত মাতামাতি, এত মাখামাখি করলেন, তখন বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকরা এ বিষয়ে কীভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন? আপনার জিরাফের মতো গলা উঁচিয়ে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নীল, সাদা, গোলাপিতে বিভক্ত। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এত বিভক্ত, এত বিভাজিত সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু একজন বা দুজন শিক্ষক বিনা বাধায়, সমালোচনায় কীভাবে একজন ছাত্র/ছাত্রীকে নিয়োগ বোর্ডের বৈতরণী পার করিয়ে দেন তা বোধগম্য হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো একজনের হেজিমনি চলে না বা আধিপত্য চলে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় একটি হেটারোজেনাস এনটিটি। টিআইবির যেসব সুশীল নিজেদের স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার একছত্র দাবিদার বলে মনে করেন তাদের সৎ সাহস নেই স্বচ্ছভাবে তাদের টার্গেট গোষ্ঠীর পরিচয় তুলে ধরার। গুণবাচক গবেষণা পদ্ধতিতে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয় যখন অতি সংবেদনশীল বা গোপনীয় বিষয় নিয়ে কাজ করা হয়। টিআইবি কি এমন একজন প্রভাষকের পরিচয় ছদ্মনাম দিয়েও তুলে ধরতে পারবেন যার কাছ থেকে সরাসরিভাবে আর্থিক অনিয়মের বিষয় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন? ছদ্মনামের প্রভাষকের সঙ্গে ছদ্মনামের উপাচার্যের বা উপ-উপাচার্যের সম্পর্ক কীভাবে গড়ে উঠল? একজন উপাচার্যের সঙ্গে সদ্য পাস করা একজন ছাত্রের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠা কী করে সম্ভব? একজন উপাচার্যের কাছে প্রবেশাধিকার কি এতই সহজ? সম্ভব নয় বিধায় টিআইবি হিন্দি চলচ্চিত্রের অনুকরণে একজন মধ্যস্থতাকারীকে নিয়ে এলেন যিনি ছাত্রনেতা অথবা রাজনৈতিক নেতা অথবা প্রশাসনিক ভবনের কর্মচারী। যদি টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী এটিই বাস্তবতা হয়ে থাকে তবে টিআইবি এ ধরনের কজন ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক নেতা বা কর্মচারী/কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন? কোন sampling method এর মাধ্যমে এদের নির্বাচন করেছে টিআইবির গবেষকরা? এসব উত্তরদাতা অতঃপর কোন প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য বা বিশেষজ্ঞ সদস্যদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে? টিআইবি নিজের গবেষণার দারিদ্র্যকে এতটাই প্রকট করে তুলে ধরেছে যে এটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য কিংবা বিশেষজ্ঞ সদস্যদের কাছে ৩-২০ লাখ টাকা ঘুষ প্রদান করার বিষয়টি গাছ থেকে আম পেড়ে খাবার মতোই সহজ। তাই ঘুষ গ্রহণকারী কোন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ডিন, ছাত্রনেতা বা বিশেষজ্ঞ সদস্যদের সঙ্গে টিআইবির সুশীল গবেষকরা কীভাবে যোগাযোগ করলেন, বিষয়টি তাদের সামনে কীভাবে তুলে ধরলেন, তাদের কী প্রতিক্রিয়া হলো- যা গুণবাচক গবেষণার মূল বৈশিষ্ট্য তার কোনো উল্লেখই নেই তাদের তথাকথিত গবেষণা পত্রে। তাই এটি গবেষণা নয়, গবেষণার নামে চিচিং ফাঁক প্রতিবেদন। টিআইবি ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা চালাল এবং দাবি করল তারা তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রভাষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, সেসব স্টেক হোল্ডারের কাছ থেকে? এ স্টেক হোল্ডার কারা? টিআইবি আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি প্রভাষক নিয়োগের প্রক্রিয়া বিষয়ে আলোচনার জন্য। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের নিয়োগ বোর্ডে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলাম এবং আছি। যেহেতু আমি আগে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলাম এবং বর্তমানে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষজ্ঞ সদস্য আছি খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে টিআইবি আমার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করল না কেন? কারণ আমি বা আমার মতো যারা বিভিন্ন বোর্ডে বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে আছি আমাদের কাছ থেকে তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কোনো অসৎ তথ্য পাবেন না বলে? রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা, উপাচার্যের অভিপ্রায় অনুযায়ী নিয়োগ প্রদান সংক্রান্ত টিআইবির প্রতিবেদন পড়ে মনে হলো একজন উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের সব প্রভাষক প্রার্থীকে চেনেন এবং জানেন। আমি যেখানে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সব মেধাবী ছাত্রছাত্রীকেই চিনি না, চেনার কথাও না সেখানে বিজ্ঞান অনুষদের একজন উপাচার্য কীভাবে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তিনজন প্রভাষককে নিয়োগ দিতে পারেন শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা ৩-২০ লাখ টাকার ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে? মূলত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বোর্ডের একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কীভাবে একই রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী শিক্ষকরা প্রভাষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে তীব্রভাবে ভিন্নমত পোষণ করেন। কোনো কোনো সদস্য একাডেমিক ফলাফলকে গুরুত্ব দেন। কেউ কেউ গুরুত্ব দেন ভাইভা বোর্ডের পারফরমেন্সকে। আবার কেউ কেউ গুরুত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রার্থীদের। কেউ কেউ প্রান্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রার্থীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বোর্ডের সদস্য থাকাকালীন আমি বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে একমত হতে পারিনি তৎকালীন উপ-উপাচার্যের সঙ্গে, খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গেও একমত হতে পারিনি প্রভাষক নির্বাচনে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, ডিন এবং বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে কাউকেই আমরা নিয়োগ দিতে পারিনি একাধিক প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও। কারণ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হওয়ার জন্য যতটা যোগ্যভাবে ভাইভা বোর্ডে নিজেকে উপস্থাপনের প্রয়োজন ছিল, প্রার্থীরা সেভাবে নিজেকে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছিল বলে সে বোর্ড মনে করেছিল। জগন্নাথ কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু উপাচার্য নয়, বরং বিশেষজ্ঞ ডিন, চেয়ারম্যানরাও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ কিংবা সরকার বিভাগে মুখ্য ভূমিকা রাখেন এবং এটাই স্বাভাবিক। কারণ প্রতিটি নিয়োগ বোর্ডের সদস্যবৃন্দ আলাদা, উপাচার্য/উপ-উপাচার্যের চরিত্র আলাদা, ভূমিকা আলাদা, প্রার্থীদের তালিকা আলাদা। এই যে পৃথক বৈশিষ্ট্য, এই যে স্বাতন্ত্র্য- এটি খুঁজে বের করাই মূলত গুণবাচক গবেষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কারণ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং বাস্তাবিক প্রয়োজনীয়তার অবয়বটি আলাদা। এ কারণেই গুণগত গবেষণায় social context এত গুরুত্বপূর্ণ যা টিআইবির সুশীল গবেষকরা হয় জানেনই না অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য উপেক্ষা করেছেন। অসৎ উদ্দেশ্য অকারণেই বললাম যে- বাংলাদেশে এখন সবচাইতে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের নাম টিআইবি। এর আগেও টিআইবি সংসদ সদস্যদের নিয়ে, দুর্নীতি নিয়ে, পুলিশ প্রশাসন নিয়ে নানা বিতর্কমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বর্তমান পার্লামেন্টকে ‘পুতুলনাচের রঙ্গমঞ্চ’ বলে অভিহিত করে নিজেদের গবেষণার দারিদ্র্যকে আগেই প্রকটভাবে প্রকাশ করেছে টিআইবি। কারণ গবেষণার ভাষা কখনই ‘পুতুলনাচের রঙ্গমঞ্চ’ হতে পারে না। যে কোনো ধরনের সামাজিক গবেষণায় এ ধরনের অলঙ্কারিক শব্দ বা ভাষা ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে অনৈতিক বলে বিবেচিত হয়। টিআইবি যে একটি অনৈতিক এবং দুর্বল গবেষণা সংগঠন এটি আবারও প্রমাণিত হলো তার তথাকথিত এ গুণবাচক গবেষণার মাধ্যমে। এ গবেষণার পদ্ধতি যদি গুণবাচক হয়ে থাকে তবে এখানে সুপারিশমালা এলো কীভাবে? কারণ গুণবাচক গবেষণায় সাধারণীকরণের কোনো সুযোগ নেই। গুণবাচক গবেষণা উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়, পূর্ব চিন্তা নিয়েও হয় না। এটি গড়ে ওঠে সম্পূর্ণভাবে উত্তরদাতাদের দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা, জীবনাদর্শের আলোকে। টিআইবির সুপারিশই প্রমাণ করে কোনো উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, বিশেষজ্ঞ সদস্য কিংবা নবীন প্রভাষকদের কাছ থেকে তারা কোনো তথ্যই গ্রহণ করেননি। গুণবাচক পদ্ধতি যেহেতু ব্যাখ্যামূলক তাই যে সামাজিক অবস্থার আলোকে প্রভাষক নিয়োগের বিষয়টি সম্পর্কে গবেষণা চালানো উচিত ছিল তার ধারেকাছেও যায়নি টিআইবি। যদি যেত তবে এ ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়কে একই মাত্রায় একই বিবেচনায় আনত না। প্রতিবেদনটি যে সম্পূর্ণভাবে চিচিং ফাঁক তার বড় প্রমাণ, যে কোনো গবেষণায় ethics এর একটি বিষয় থাকে যা টিআইবি কোনোভাবেই মানেনি। যেহেতু গুণবাচক গবষেণা অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কাজ করে তাই এ ধরনের গবেষকদের কমিটমেন্ট থাকে তাদের প্রকাশিত তথ্য কোনোভাবেই কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য রুতিকর হবে না। কিন্তু টিআইবি কী করল? গবেষণার সব ethics ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক থেকে উদীয়মান মেধাবী তরুণ এবং নারী শিক্ষকদের অনৈতিক, চরিত্রহীন, ঘুষ প্রদানকারী ও ঘুষ গ্রহণকারী হিসেবে চিত্রিত করলেন। তাহলে এ প্রতিবেদন প্রকাশের উদ্দেশ্য কী? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চরিত্র হরণ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজ ধ্বংস করা। মূলত টিআইবির এ প্রতিবেদন থেকে পরিষ্কার এটি কতিপয় কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য পূরণ করতে চাচ্ছে যারা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জায়গা করে দিতে চায়, যারা ঢালওভাবে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কথা বলে উগ্রবাদী, মৌলবাদী গোষ্ঠীর ধারাকে এগিয়ে নিতে চায়, যারা নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রযাত্রাকে রুখতে চায়, যারা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পুলিশি কিংবা প্রশাসনিক যন্ত্রের খাঁচায় বন্দী করে দিতে চায়, যাতে বাংলাদেশকে আর মুক্তচিন্তা কিংবা আধুনিকায়নের পথে অগ্রসর হতে দেওয়া না যায়। টিআইবির রিপোর্ট যে কতখানি বিভ্রান্তিমূলক তার আরেকটি প্রমাণ হলো- গত ২১ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক আদেশ যেখানে মৌখিক পরীক্ষার সঙ্গে লিখিত পরীক্ষা গ্রহণের কথা বলা হয়। সরকারি ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বিধায় পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রয়োজন। অন্যদিকে টিআইবি বলছে বর্তমান সরকারের সময়ে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কাউকেই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। সুতরাং কোনটি সত্য? সরকারি আদেশ না টিআইবি প্রতিবেদন? সুশীল গবেষক, উচ্চাভিলাষী আমলা, রাজনীতিবিদ সবাই আসলে ভয় পান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। তাই অতীতে সামরিক আমলাতন্ত্র, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সুশীল উপদেষ্টারা যেমন চেষ্টা করেছে তেমনি বিভিন্ন এনজিওর সুশীল গবেষক ও সরকারি আমলারও এখন প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন শিক্ষকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য। তবে অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার আগে টিআইবির উচিত নিজের জন্য প্রেসক্রিপশন ঠিক করা এবং সুপারিশমালা প্রণয়ন করা। যদি নিজের জন্য এ সুপারিশমালা তৈরি করার যোগ্যতা টিআইবির না থাকে তবে এর উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে সুপারিশমালা গ্রহণ করা। তাই টিআইবির জন্য সুপারিশ হচ্ছে (১) কোন রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর বা তথাকথিত গত্বাঁধা পূর্বনির্ধারিত ধারণার আলোকে কোনো সামাজিক প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যার নাম যে গবেষণা নয় তা অনুধাবন করা। (২) গুণবাচক গবেষণার নামে নিজের বা কোনো গোষ্ঠীর অসৎ উদ্দেশ্য পূরণ থেকে বিরত থাকা (৩) গুণবাচক গবেষণার চরিত্র ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও in-depth জ্ঞান অর্জন করা (৪) গুণবাচক গবেষণা জটিল ও সংবেদনশীল প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যা করা হয়। এ ব্যাখ্যা টিআইবির ব্যাখ্যার মতো এত সরল, ফ্ল্যাট হতে পারে না। এটিকে interpretative করার লক্ষ্যে কীভাবে উত্তরদাতাদের কাছ থেকে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা যায়, সংবেদনশীল এবং লুকায়িত সত্যকে টেনে বের করে আনার জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন সে বিষয়ে তাদের গভীরভাবে অধ্যয়ন প্রয়োজন। (৫) গবেষণাকর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি নৈতিকতার বিষয়টিকে মেনে চলার সংস্কৃতিকে নিজেদের মধ্যে আয়ত্ত করা। বোধকরি এসব সুপারিশমালা গ্রহণ করলেই টিআইবি সুশীলের আলখেল্লা ছেড়ে অনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের কাজ করা থেকে বিরত থাকবে এবং গবেষণার দারিদ্র্য থেকেও মুক্ত হতে পারবে।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর