মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
সাম্প্রতিক

রাজনীতিতে ছড়িয়ে পড়ুক নারায়ণগঞ্জের সুবাতাস

আলম রায়হান

রাজনীতিতে ছড়িয়ে পড়ুক নারায়ণগঞ্জের সুবাতাস

আগুনসন্ত্রাস আর নানাবিধ আশঙ্কার পর রাজনীতিতে সুবাতাস বইছে। বিষয়টি কেবল রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল নয়, অতিসাধারণ জনও অনুভব করছেন। বিষয়টি নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের সাফল্যের মধ্য দিয়ে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে প্রচলিত ধারায় টানটান উত্তেজনা নয়, উৎসবের প্রশান্তিতে সম্পন্ন হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এটি শুধু একটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেবল নয়, এ নির্বাচনকে মর্যাদার লড়াই হিসেবেই নিয়েছিল বর্তমান শাসক দল আওয়ামী লীগ ও সাবেক শাসক দল বিপর্যস্ত বিএনপি। এ দুই দলের মধ্যে জয়-পরাজয়ের দোলাচলে সন্দেহাতীতভাবে বিজয়ী হয়েছে নারায়ণগঞ্জবাসী। একই সঙ্গে প্রমাণিত হয়েছে, গণতান্ত্রিক পথে হাঁটার ধারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে পূর্ণমাত্রায় বহাল। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে দুই দলের প্রার্থীর মধ্যে, এমনটাই পর্যবেক্ষকদের ধারণা ছিল। কিন্তু ভোটের ব্যবধান হয়েছে ধারণার চেয়ে অনেক বেশি। যারা ডা. আইভীর বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন তারাও ভোটের এত ব্যবধান আশা করেননি।

ভোটের হিসাবে বিজয়ী হয়েছেন ডা. আইভী আর পরাজিত অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত। কিন্তু সুস্থ রাজনীতির নিরিখে দুজনই বিজয়ী হয়েছেন; তাদের পথচলার ধরনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সুবাতাস অনেককেই স্পর্শ করেছে। পাশাপাশি ২২ ডিসেম্বরের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মডেল হয়েই থাকবে। যাকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এদিকে ভোট গ্রহণকালে কৌশলী বক্তব্য এবং ফল প্রকাশের পর বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া গ্রহণযোগ্য মাত্রা অতিক্রম করেনি বলেই মনে করে পর্যবেক্ষক মহল।

সিটি নির্বাচনের ফল নিয়ে দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বাহাস যখন দেশবাসীর বিরক্তির উদ্রেক করেছে তখন দেশবাসী খুবই প্রশান্তির সঙ্গে দেখেছে বিজয়ী প্রার্থীর রাজনৈতিক শিষ্টাচারের দৃশ্য। বিজয়ী ডা. আইভী মিষ্টি নিয়ে গেছেন অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানের বাসায়। এ সময় কেউ দরজা বন্ধ করে দেয়নি, গেটে তালাও ঝোলানো ছিল না বা কেউ বলেনি, তিনি পরাজয়ের কষ্ট আর গ্লানিতে অচেতন অবস্থায় আছেন; এখন দেখা হবে না। বরং বিজয়ী ডা. আইভীকে পরম আত্মীয়ের মতো আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছেন অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত ও তার স্ত্রী। স্বাগত জানানোর ধরন, আপ্যায়ন ও আন্তরিক আলোচনায় সেখানে সৃষ্টি হয় একটি হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশের। এ সময় ডা. আইভীকে সহায়তার আশ্বাস দেন অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত। আর ডা. আইভী বলেছেন, বিএনপির মেয়র প্রার্থীর দেওয়া নির্বাচনী ইশতেহার দেখবেন তিনি। ইশতেহারে থাকা কল্যাণকর বিষয়গুলো গ্রহণের ব্যাপারে তার ইতিবাচক মনোভাব থাকবে বলেও মন্তব্য করেন ডা. আইভী।

শুরু থেকেই সারা দেশের মানুষের নজর ছিল এ নির্বাচনের দিকে। নির্বাচনের খবর সংগ্রহের জন্য সহস্রাধিক সংবাদকর্মী ও প্রায় ৩০০ পর্যবেক্ষক সক্রিয় ছিলেন। এদের মূল্যায়ন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।

এর পরও এ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির প্রশ্ন তোলার বিষয়টিকে পর্যবেক্ষরা সনাতনী রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখেছেন, এর বেশি নয়। আর বিএনপি-ঘেঁষা পর্যবেক্ষকরা দেখেছেন প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া দলটির জন্য আশার আলো হিসেবে। নারায়ণগঞ্জে বিএনপি প্রার্থীর পরাজয়কে আসলে আওয়ামী লীগের বিজয় হিসেবে দেখছেন না তারা, দেখছেন আইভীর বিজয় হিসেবে। আর ডা. জাফরুল্লাহর মতো বিএনপি-ঘেঁষা বুদ্ধিজীবীদের মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপি ভালো খেলেছে। তার মতে এবারের নির্বাচনে অ্যাডভোকেট সাখাওয়াতের মতো অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া এবং গত নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে দলের নেতা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে প্রত্যাহার করে সঠিক কাজ করেছে বিএনপি। এ বিষয়টিকে ২৩ ডিসেম্বর আরও পরিষ্কার করেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, গতবার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জিতেছেন আইভী প্রায় ১ লাখ ভোটের ব্যবধানে। তার পিতা ও পারিবারিক ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার নিজের এবং গত মেয়াদে কাজ ও অহংকারমুক্ত আচরণের সুনাম। এসব কিছুর সঙ্গে যোগ হয়েছে আওয়ামী লীগের সমর্থন। এসব বিবেচনায় অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর মূল্যায়ন হচ্ছে, অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত বেশ ভালো করেছেন, বেশিই ভোট পেয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন নিয়ে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে অনেকেই একমত। তাদের মতে নির্বাচনে বিএনপির এ শক্ত অবস্থানের কারণ হচ্ছে জামায়াতের সঙ্গে দৃশ্যমান সখ্য কমানো। তারা আরও মনে করেন, বিএনপির সামনে একটি পথ খোলা আছে, আর তা হচ্ছে নির্বাচনের রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করা। স্মরণ করা যেতে পারে, এরশাদের সামরিক শাসকের নিষ্পেষণে প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া বিএনপি ইউটার্নে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচন কেন্দ্র করেই। সেই নির্বাচনে প্রার্থী সংকট কাটাতে যাকে মনোনয়ন দিয়েছে প্রায় ক্ষেত্রেই সে পাস করেছে। সে নির্বাচনে বিএনপির টিকিটে কলা গাছও পাস করার বচন সত্য না হলেও কো-অপারেটিভের ইন্সপেক্টর চাকরি ছেড়ে বিএনপির টিকিটে পাস করে সংসদ সদস্য হওয়ার দৃষ্টান্তও আছে; আর রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন কতজন যে বিএনপির মনোনয়নে জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছেন তা বহুদিন গবেষণার বিষয় হয়ে থাকবে। সে নির্বাচনেই প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় বসেছেন বেগম খালেদা জিয়া। ১/১১ সামরিক বাহিনী সমর্থিত ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন সরকারের দমনের পর বিএনপি টিকে গেছে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে। কিন্তু জামায়াতের পরামর্শে ২০১৪ সালে নির্বাচন না করে দূরে থেকে নিজের পায়ে নিজে কুঠার মারা কেবল নয়, বলা চলে নিজের গলায় নিজে ঘঞ্জর চালিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। সম্ভবত এ বোধ থেকেই নারায়ণগঞ্জের মাধ্যমে নির্বাচনের পথে হাঁটতে শুরু করেছে বিএনপি।

সর্বশেষ খবর