শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বার্ধক্যে বিলাপ নয়, বাঁচার আনন্দ খুঁজে নিন

তুষার কণা খোন্দকার

বার্ধক্যে বিলাপ নয়, বাঁচার আনন্দ খুঁজে নিন

কয়েক বছর আগে সুইডেনের গোথেনবার্গ শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। এক সন্ধ্যায় আমার ভাগ্নি-ভাগ্নিজামাই শহরের মধ্যে একটা ছোট পাহাড় দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ভাগ্নিজামাই বলল, ‘আগের দিনে জোয়ান সুইডিসরা পরিবারের বুড়া মানুষদের বোঝা টানতে চাইত না। সেজন্য ওরা বুড়াবুড়িকে নিয়ে এসে এ পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে মারত।’ গল্প শুনে আমি বিস্ময়ে বেদনায় হাঁ হয়ে চেয়ে আছি। আমার দুর্দশা দেখে ভাগ্নি নির্বিকার মুখে বলল, ‘বুড়াবুড়িকে আছাড় দিয়ে না মেরে ওদের উপায় কী বল! সুইডেনে বুড়াবুড়িগুলো শ’ বছর আয়ু নিয়ে খুনখুনে বুড়া হয়েও বেঁচে থাকে। কিছুতেই মরতে চায় না। আইন আদালতের ঝামেলা না থাকলে সুইডিসরা এখনো বুড়াবুড়িকে পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যেত।’ ভাগ্নির নিষ্ঠুর মতামতের সঙ্গে আমি একমত তা বলছি না। তবে বেশিদিন বেঁচে থাকাটা আনন্দের নাকি ঝামেলার সেটাও নিশ্চিত হতে পারছি না। বাঙালি সমাজে প্রবাদ আছে, ‘ক্ষুধার নষ্ট মুড়ি- বাড়ির নষ্ট বুড়ি।’ আমাদের সমাজ একতরফা পুরুষ শাসিত বলে প্রবাদের আক্রমণের তালিকা থেকে বুড়া বাদ পড়েছে। আদতে ভাটি বয়সে বুড়াবুড়ি দুজনই তাচ্ছিল্যের কাতারে এক। বাংলাদেশের মানুষের রুজি-রোজগার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে মিল রেখে মানুষের গড় আয়ু প্রতিবছর বেড়ে চলেছে। আশা করছি, সামনের বছরগুলোতে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির হার এভাবে অক্ষুণ্ন থাকলে আমরা অনেকে শতায়ু পেতে যাচ্ছি। মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়াজুড়ে একটি বিষয় আলোচনায় ওঠে আসছে। মানুষের আয়ু বাড়ছে এ কথা সত্যি কিন্তু মানুষের আয়ুর সঙ্গে কি জীবন যুক্ত হচ্ছে? জীবনযাপনের পদ্ধতি পালটে ফেলে, ডাক্তার বদ্যির সেবা নিয়ে আমরা বেশিদিন বাঁচতে পারছি; কিন্তু দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাঁচার আনন্দ দীর্ঘায়ু হচ্ছে না। সারা দুনিয়ায় মানুষ এটি নিয়ে চিন্তিত। তারা ভাবছে, আয়ুকে টেনেটুনে লম্বা করে ফায়দা কী যদি আয়ুর সঙ্গে বেঁচে থাকার আনন্দ মিশিয়ে নেওয়া না যায়। পশ্চিমা দুনিয়ার মানুষ বেঁচে থাকার সঙ্গে বাঁচার আনন্দ যোগ করার জন্য আরও গবেষণার ওপর জোর তাগিদ দিচ্ছে। গবেষকদের কষে তাগিদ দিলেই যে তারা খুব দ্রুত আয়ুর সঙ্গে জীবন জুড়ে দেওয়ার কাজে সফল হবে তেমন লক্ষণ চোখে পড়ছে না। পশ্চিমা দুনিয়ার মানুষ যৌবনকালে উদ্দাম জীবনযাপন করে। বয়সে ভাটির টান আসার সঙ্গে সঙ্গে ওরা সংসারের ভার থেকে মুক্তি পেতে থাকে। পশ্চিমা দেশগুলোতে মানুষের শৈশবে এবং বার্ধক্যে দেখভাল করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমাদের প্রাচ্যের জীবনযাত্রায় এখনো সনাতনী ব্যবস্থাই শেষ ভরসা। শৈশবে কিংবা বার্ধক্যে মানুষের দেখভাল করার জন্য রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এদিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেকের পরিবার আগের মতো আঁটসাঁট বাঁধনে আটকে নেই। ছেলেমেয়েরা দূরদূরান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে বার্ধক্যে পরিবার ছাড়া আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই ভাবলে অনেকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কিন্তু সমস্যার প্রতিকার করার জন্য কেউ ইতিবাচক পথে কিছু ভাবছে বলে মনে হয় না। সমস্যাটা উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্তকে দ্রুত গ্রাস করছে। রক্ত সম্পর্কের মানুষগুলোকে চারপাশে অনুপস্থিত দেখে তারা দুশ্চিন্তার ভারে নুয়ে পড়ে। কিন্তু উদার মন নিয়ে সমস্যা সমাধানের কথা এরা এখনো চিন্তা করছে না। এদের শূন্য প্রাসাদে নিঃসঙ্গ বসবাসের কষ্ট দেখে আমার একটা গল্প মনে পড়ে। গল্পটি সৃষ্টির সময়ে প্রাণীদের জন্য আয়ু বরাদ্দ করাকে কেন্দ্র করে। গল্পটা হচ্ছে, দুনিয়ার দরকারি সব কিছু সৃষ্টি করার পরে ঈশ্বর মনের খেয়ালে প্রাণীকুল সৃষ্টি করতে বসলেন। মাটির তৈরি প্রাণীগুলোকে ঈশ্বর সুন্দর আদল দিয়ে গড়ার পরে সেগুলোকে সার বেঁধে সাজিয়ে রাখছেন। ঈশ্বর ওদেরকে আয়ু বরাদ্দ করে দুনিয়ায় পাঠাবেন বলে সবাই অপেক্ষা করছে। সবার সামনে লম্বা এক সারি প্রাণীর এক মাথায় বসে আছে মাটির তৈরি মানুষ। তার পাশে একটি গাধা, গাধার পাশে কুকুর আর তার গা-ঘেঁষে শকুন। ঈশ্বর সৃষ্টির কাজ গোছগাছ করে এবার প্রাণীকুলকে আয়ু বরাদ্দ করতে বসলেন। প্রথম সারির শুরুতে বসে থাকা মানুষ, গাধা, কুকুর এবং শকুন এ চার প্রজাতিকে ঈশ্বর এক ইশারায় চল্লিশ বছর করে আয়ু বরাদ্দ করে অন্যান্য প্রাণী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঈশ্বরকে বেখেয়াল পেয়ে সারির মাথায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা মানুষ তার পাশে চুপচাপ বসে থাকা গাধাকে নিয়ে পড়ল। বলল, তুই ব্যাটা গাধা। দুনিয়ার ওপর যতদিন বাঁচবি ততদিন পিঠের ওপর তোকে বোঝার ভার বইতে হবে। তোর এত লম্বা আয়ু নিয়ে চল্লিশ বছর বাঁচার দরকারটা কী? এমন কষ্টের জীবন অকারণে লম্বা না করে বরং কমিয়ে ফেলা ভালো। বোকাসোকা গাধা বেচারা কী আর বলবে। সে শুধু মন দিয়ে মানুষের কথা শুনছে। মানুষ মওকা পেয়ে বলে, তোকে একটা ভালো বুদ্ধি দিচ্ছিরে গাধা। আমার বুদ্ধি শুনলে তোর কষ্টের জীবন সংক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। এক কাজ কর, তোর চল্লিশ বছরের লম্বা আয়ু থেকে অর্ধেক অর্থাৎ বিশ বছর আমাকে দিয়ে দে। মানুষের কথা শুনে গাধা লম্বা শ্বাস ফেলে। আয়ুর মতো দামি জিনিস কেউ কাউকে কি সহজে দিতে চায়! তবুও গাধার সাধ্য কী মানুষের সঙ্গে কুলিয়ে ওঠে! মানুষের মাথায় যখন আয়ু চুরির মতলব ঢুকেছে সে সেটা হাসিল না করে কি ক্ষান্ত হবে! মানুষের ঘ্যানঘ্যানানিতে ত্যক্ত গাধা অবশেষে বলল, যা বাপু, তোর প্যাঁচাল থামা। আমার আয়ু কেড়ে নিয়ে তুই ভালো থাকতে পারলে আমার চল্লিশ বছর আয়ু থেকে অর্ধেক বিশ বছর তোকে দান করে দিলাম। গাধার সঙ্গে মুলামুলি করে বিশ বছর আয়ু জিতে নিয়ে মানুষের সাহস বেড়ে গেল। এবার সে কুকুরকে ঘায়েল করতে নেমে পড়ল। কুকুর চালাক প্রাণী। সে শুরুতে আপত্তি করেছিল। কিন্তু সেও যে খুব সুবিধা করতে পারল তা নয়। যতই চালাক হোক তবুও তো কুকুর। সেই তো মানুষের সামনে পড়লে লেজ নাড়ে। এক সময় বুঝিয়ে শুনিয়ে কব্জা করে কুকুরের চল্লিশ বছর আয়ু থেকে মানুষ বিশ বছর বাগিয়ে নিল। কুকুরের আয়ু থেকে বিশ বছর হাতিয়ে নিয়ে মানুষের লোভ থামল না। নিজের আয়ুতে আরও বিশ বছর যোগ করার ধান্ধায় এবার সে শকুনকে নিয়ে পড়ল। গাধা আর কুকুরকে মানুষের কাছে হার মানতে দেখে শকুন বিনা দ্বিধায় বিশ বছর আয়ু মানুষকে দান করে দিয়ে বিষণ্ন মনে পৃথিবীর পথে উড়াল দিল। গাধা, কুকুর আর শকুন এ তিনজনের অর্ধেক আয়ু বাগিয়ে নিয়ে স্বর্গের পাট চুকিয়ে মানুষ সবার শেষে বিজয়ীর বেশে দুনিয়ায় এলো।

দুনিয়ার ওপর শুরুর দিনগুলো মানুষের ভালোই কেটে যাচ্ছিল। তবে মানুষের নিজের অরিজিনাল আয়ু চল্লিশ বছর পার হওয়ার পরে সে যখন একচল্লিশ বছর বয়সে গাধার আয়ুতে পা রাখল সেদিন সে অন্যের আয়ু বাগিয়ে আনার ফজিলত টের পেতে শুরু করল। মানুষ দেখল, মাত্র চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত সে নিজের জীবনযাপন করেছে। চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে সে নিজ কৃতিত্বে নিজের জন্য যা কিছু ভালো সেটি সে অর্জন করেছে। নিজের আনন্দে বুঁদ হয়ে সেটি সে মৌজ মেরে ভোগও করেছে। একচল্লিশ বছর বয়সে সে গাধার জীবনে প্রবেশ করল। একচল্লিশ থেকে ষাট এই বিশ বছর বাঁচতে গিয়ে সংসারের বোঝা মানুষের পিঠে ভার হয়ে চেপে বসে। সংসার গোছানো, সন্তান মানুষ করা, ভাই-বেরাদারের সঙ্গে সম্পত্তি ভাগাভাগি হরেক পদের দায়-দায়িত্বের বোঝা পিঠে নিয়ে সে লম্বা করে শ্বাস ফেলারও সময় পায় না। মানুষের বয়স যখন ষাটের কোটায় তখন গাধার জীবন পার হয়ে শুরু হয় কুকুরের জীবন। কুকুরের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে পাওয়া বিশ বছর ধরে মানুষ তার চারপাশের সবকিছুর ওপর নির্লজ্জ পাহারাদারি শুরু করে। একষট্টি থেকে আশি বছর বয়স পর্যন্ত মানুষ তার চারপাশের ঘটনার দিকে তীক্ষ নজরদারি করে আর ভাবে, আহারে কত কষ্ট করে সব গুছিয়ে তুলেছিলাম। ছেলেমেয়েরা সব মাটি করে দিল। চারপাশের মানুষ পাত্তা দিক কিংবা না দিক সত্তর আশি বছর বয়সে নিজের অর্জন ঘিরে চেঁচামেচি করা ছাড়া মানুষের তেমন কিছু করার থাকে না। এরপর নব্বই একশ বছর বেঁচে থাকলে সেটি শকুনের আয়ু। অমন বার্ধক্যে মানুষ বাড়ির এক কোনায় একলা এক খাটে শুয়ে বসে দিন রাত ঝিমায় আর ঝিমায়।

সরকার আইন করে বাপ-মায়ের বোঝা সন্তানের পিঠে চাপাতে পারে কিন্তু সরকার কি আইনের বলে জীবনের প্রাকৃতিক গতিধারা বদলে দিতে পারে? নোয়াখালী জেলার প্রবাদে বলে, ‘আমি বলি ঝি, ঝি; ঝিও বলে ঝি, ঝি। সরল বাংলায় মানে করলে বোঝায়, আমি মেয়েকে ডাকি, মেয়ে ডাকে তার মেয়েকে’। অর্থাৎ ভালোবাসা নিম্নগামী। প্রকৃতির নিয়মের ওপর জবরদস্তি চলে না। শহুরে ধনী শ্রেণির অনেক মানুষকে আজকাল প্রবাসী সন্তানদের পিণ্ডি চটকাতে শুনি। তারা আবেগভরে নচিকেতা নামের এক গায়কের অতি আবেগি গানের কলি আউড়াতে থাকেন যার গানে অবহেলিত বাপমায়ের করুণ পরিণতি বাখান করা হয়েছে। গানের কলির আবেগ নিয়ে বয়স্ক মানুষগুলো সন্তানকে গালমন্দ করে উদ্ভট সুখ পেতে পারেন কিন্তু তাতে পরিস্থিতি ভালোর দিকে বদলাবে না। বাপ-মায়ের যত্ন না নেওয়ার জন্য ছেলেমেয়েকে যারা দুষতে থাকেন তারা একবারও ভাবেন না তারা নিজেরা নিষ্ঠুর স্বার্থপরতার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের জন্য তাদের সম্পত্তি পাহারা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা ছেলেমেয়েকে গালাগালি করেন ঠিকই আবার সেই প্রবাসী সন্তানদের ভোগের জন্য সঞ্চিত সম্পদ যক্ষের মতো পাহারা দিয়ে রাখেন। এ আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর মানুষগুলো প্রবাসী সন্তানদের ভোগের বন্দোবস্ত করার কাজে মজে থাকে অথচ পথের পাশের ক্ষুধার্ত শিশুটির দিকে একবার চোখ তুলে চেয়ে দেখে না। অভিযোগকারী মানুষগুলো তার নিজের এবং তার মতো অন্য অসহায় বয়স্ক এবং শিশুদের যত্ন নেওয়ার মতো টেকসই একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে একটি টাকাও খরচ করে না। বর্তমান সময়ে দাবি, সমাজের বিত্তবান এবং বিত্তহীন সবাইকে আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার বৃত্ত কেটে বের হয়ে আসতে হবে। তা না হলে শেষ জীবনে দুর্ভোগ ভুগে অতৃপ্ত মনে পরকালের পথে ফিরতি যাত্রা শুরু করতে হবে।

গবেষকরা কবে আয়ুর সঙ্গে জীবন যোগ করবেন কিংবা সরকার আইন করে বার্ধক্যের কষ্ট কতখানি লাঘব করবেন সেটি নিয়ে বিলাপ করে আমি সময় নষ্ট করার বিপক্ষে। আমি শহুরে ধনী শ্রেণির নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য একটি সহজ বুদ্ধি দিতে পারি। শহুরে ধনীরা বিলাপ বাদ দিয়ে ছোট পরিসরে চমৎকার ক্লাব কিংবা সোসাইটি গড়ে তুলতে পারেন। বিশাল আয়োজনের প্রয়োজন কী? কয়েকজন সমবয়সী একত্রিত হয়ে এটি করা সম্ভব। ছোট পরিসরে তারা অনেক বড় কাজ করতে পারেন। পথশিশুদের লেখাপড়া শিখিয়ে অনাবিল আনন্দ পেতে পারেন। ভালো লাগলে তারা নিজ বাড়িতে আশ্রয়হীন শিশুদের আশ্রয় দিতে পারেন। শহরের জীবনে হাঁফ ধরে গেলে নিজ গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে একদিন সারাদিন কাটিয়ে এলে সেই আনন্দের রেশ আরও কয়েকদিন মনের মধ্যে আনাগোনা করবে। সম্পদকে যক্ষের ধনের মতো পাহারা দিতে গিয়ে স্বার্থপরতার বৃত্তে বন্দী হয়ে লাভ কী?

            লেখক : কথাসাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর