বৃহস্পতিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

অতিথি পাখি

আফতাব চৌধুরী

অতিথি পাখি

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দ্রুত বনায়ন বাস্তবায়নে পাখির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ঋতুচক্রের পরিবর্তনের ফলে উত্তর গোলার্ধের শীতপ্রধান অঞ্চলে যখন প্রচণ্ড বরফ পড়ে তখনই বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা দক্ষিণ গোলার্ধের অপেক্ষাকৃত উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে ছুটে আসতে থাকে। তাই আমরা দেখতে পাই প্রতিবছরই হেমন্তের বিদায় লগ্নে যখন শিশির ঝরা শুরু হয় মৌসুমি হাওয়ায় শোনা যায় শীতের আগমনী ধক্ষণি, তখনই সুদূর সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পালে পালে ডানা ঝাপটিয়ে নানা ধরনের পাখি আমাদের দেশে ছুটে আসে। একইভাবে শীতপ্রধান অঞ্চলসমূহে আবার বরফ গলা শুরু হলে এসব পাখি নিজ নিজ দেশে ফিরে যায়। আমাদের দেশে এসব পাখি অতিথি পাখি নামে সমধিক পরিচিত। অতিথি পাখি আসতে শুরু করলে আমাদের দেশের চরাঞ্চল, জলাভূমি, বিল-হাওর ইত্যাদি এদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। জলকেলিতে কিচির মিচির ছন্দে এরা তখন জলাভূমির পরিবেশকে মোহনীয় করে তোলে। বিশেষ করে সাগর তীরবর্তী বিভিন্ন চরাঞ্চলে ঘন সবুজ বন বনানীতে এসব অতিথি পাখি তাদের সাময়িক নিবাস গড়ে তোলে। আমাদের দেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, বাগেরহাট এলাকার নদীবিধৌত অঞ্চলে এবং সিলেট, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহের বিভিন্ন হাওর ও বিলে শীতের মৌসুমে হাজার হাজার অচেনা পাখির মেলা বসে।

এ সময় কিছু শিকারি এসব পাখি শিকারে তৎপর হয়ে ওঠে। তারা বিভিন্নভাবে জাল ও ফাঁদ পেতে রাখে পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে। তারা ফাঁদে ফেলে এসব পাখি বন্দী করে অত্যন্ত নির্মমভাবে শহরে, বাজারে নিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে থাকে। আমরা জানি আমাদের দেশে পাখি শিকারিদের জন্য কড়া আইন বলবৎ রয়েছে কিন্তু আইন থাকলে কি হয়, তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। দেখা যায় আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নিষিদ্ধ অভয়ারণ্যে পাখি শিকারিরা অবাধ বিচরণ করে থাকে। তারা বিভিন্ন জাতের হাটস ও অন্যান্য প্রজাতির পাখি নির্বিচারে নিধন করে থাকে। এসব শিকারি জ্যান্ত পাখিদের বন্দী করে খাঁচায় পুরে এদের মুক্ত জীবনকে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দেয়। ভাষাহীন এসব জীবের তখন আর কিছু করার থাকে না। ধুঁকে ধুঁকে শুধু মরতে থাকে। পাখি কিন্তু আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম সহায়ক এ কথাটি নানা কারণে স্বীকৃত। প্রধানত পাখির মল ত্যাগের ফলে চারা উৎপাদনের মাধ্যমে দ্রুত বনায়ন সম্ভব হয়ে ওঠে। এদিকে পাখির বিষ্টা ভূমির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়। অন্যদিকে বসতি বিস্তার, ফুল থেকে ফল উৎপাদনে পাখির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব ছাড়াও পাখিরা ফলমূল, পোকা-মাকড়সা এবং কীটপতঙ্গ খেয়ে জীবনধারণ করে থাকে। ফলে জমির ফসলকে কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষা করতে পাখি এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।

বর্তমানে আমাদের দেশে গাছপালা নিধনসহ বনজঙ্গল উজাড় যেন দিন দিন এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফলে অসহায় এসব পাখি তাদের সঠিক আবাসস্থল হারিয়ে ফেলতে বসেছে। অন্যদিকে খেত খামারে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে অমূল্য সম্পদ কীটপতঙ্গ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এতে করে দিন দিন পাখির সংখ্যা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। বন বনানীর ছায়ায় ঘেরা পাখির গুঞ্জন ও কূজন থেকে আমরা যেন ক্রমাগত অনেক দূরে সরে যাচ্ছি। যান্ত্রিকতা ও নগর সভ্যতার জটিলতা এখন গ্রাস করতে চলেছে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে। কাজেই এসব পক্ষীকুল একদিন আমাদের পরিবেশ রক্ষায় অপরিহার্য ছিল, এখন পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

আসলে সত্যি বলতে কী আমাদের পরিবেশের প্রধান অংশ হলো পাখি। এসব পাখি ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ কীটপতঙ্গ ময়লা ও আবর্জনা থেকে পোকামাকড় খেয়ে পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে থাকে। পাখি নিধন এভাবে অব্যাহত থাকলে কীটপতঙ্গ ও পোকা মাকড়ের বংশ বৃদ্ধি পেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য আরও বিনষ্ট হবে বৈকি!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর