শনিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ডাক্তারি জীবনের কথকতা

ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

ডাক্তারি জীবনের কথকতা

১৯৮০ সালের কথা। সবে ডাক্তারি পাস করে ইন্টার্নশিপ কমপ্লিট করার পর সরকারি চাকরি নিয়ে থানায় পোস্টিং পেলাম। খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম, কারণ আগেই জানতাম থানায় পোস্টিং হওয়া মানেই নানারকম প্রতিকূলতা। থাকা-খাওয়ার সুবিধা নেই, নিরাপত্তার অভাব, চিকিৎসাব্যবস্থা, ওষুধ আর সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতা তো আছেই। আমরা চিকিৎসকরা ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’-এর মতো জোড়াতালি দিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলাম। হাসপাতালে কী নেই, সে তালিকা করতে গেলে ফর্দ অনেক দীর্ঘ হবে, তার চেয়ে কী আছে সে হিসাব রাখাই ভালো। বহির্বিভাগে নানারকম রোগী আসে, সবারই চিকিৎসা দিতে হয়। দরিদ্র রোগীর সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি খোঁজ রাখতে হয় ভর্তি থাকা রোগীদেরও।

দু-এক দিন না যেতেই বহির্বিভাগে সকালে রোগী দেখছি, হঠাৎ কয়েকজন লোক আমার কাছে এসে হাজির। তাদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। খুব অনুনয়-বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করলেন দ্রুত তাদের সঙ্গে যেতে। এক মহিলা প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছেন। ব্যথা উঠেছে অনেক আগেই, কিন্তু বাচ্চা আটকে আছে, বের হচ্ছে না। মায়ের অবস্থাও ভালো নয়। বাচ্চার অবস্থাও ক্রমে খারাপের দিকে যাচ্ছে। আরও দেরি হলে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে। আমি নবীন ডাক্তার। তা ছাড়া পুরুষ হিসেবে ডেলিভারি করানোটা তখনো সামাজিকভাবে গ্রামে-গঞ্জে ততটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও মহিলা ডাক্তার কেউ ছিল না। তাই ইতস্তত করছিলাম। অনেক অনুরোধের পর মনে অনেকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর ভয়ভীতি নিয়েই রোগী দেখতে গেলাম। গিয়ে আঁতকে উঠলাম, দেখি বাচ্চার শরীর বের হয়ে আছে কিন্তু মাথা ভিতরে। এ অবস্থায় কোনো হাসপাতালে নেওয়াও সম্ভব ছিল না। খুব বিপদে পড়ে গেলাম, কী থেকে কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। মাথায় একটাই ভাবনা, কীভাবে ডেলিভারিটা করা যায়। হাতে যে এক জোড়া গ্লাভস পরব, সেই সুযোগ কই? নানা ঝক্কি-ঝামেলা করে নারিকেল তেল ব্যবহার করে বাচ্চা বের করে আনলাম। মা ও বাচ্চা দুজনই আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেল। আমার ডাক্তারি জীবনের প্রথম বড় কোনো সার্থকতার দিন সেটি। নবজাতকের স্বজনরা সেদিন আমায় যে কত কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছিলেন, তা বলে বোঝাতে পারব না। কিন্তু আমি যদি সেদিন সফল না হতাম, তাহলে? হয়তো বা নিশ্চিতভাবেই জুটত ধিক্কার, গালাগালি আর লাঞ্ছনা। কয়েক বছর আগে আমার বর্তমান কর্মস্থলে বসে কাজ করছি। এমন সময় এক ভদ্রলোক খুব সুন্দর একটি ছেলেকে নিয়ে হাজির। চিনতে পারছিলাম না। ছেলেটাকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘এ আমার একমাত্র ছেলে, যাকে আপনি সেই ১৯৮০ সালে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছিলেন। ছেলেটি ডাক্তার হতে চলেছে। দোয়া করবেন, যেন আপনার মতো একজন ডাক্তার হয়ে দেশ ও দশের সেবা করতে পারে।’ তাদের চোখের অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধার উষ্ণ প্রস্রবণ আমার কাছে বড় কোনো পদকের চেয়ে মোটেও কম মনে হয়নি। আমিও কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। এই দীর্ঘ জীবনে এমন অনেক  মুহূর্তের সাক্ষী হতে হয়েছে আমাকে। শুধু আমি নই, সব চিকিৎসককেই কর্মজীবনে কমবেশি এসব ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবেগের কাঁটাগুলো কিছুটা ভোঁতা হয়ে আসে। আবার কখনো কখনো প্রচ্ছন্ন অহংকারে বুকটাও ফুলে ওঠে! মানুষের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যখন কারও কিছু করার সামর্থ্য থাকে না, ঠিক সেই সময়টায় আমরা চিকিৎসক হিসেবে আগ বাড়িয়ে যাই। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সেবা করার যে দারুণ সুযোগ আমাদের দিয়েছেন, সেজন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।

যে সময়ের ঘটনার কথা বললাম, তখন গ্রাম বাংলার চিকিৎসাব্যবস্থা এমনটাই ছিল। কঠিন রোগব্যাধি হলে একমাত্র আল্লাহ বা নিয়তির ওপর ভরসা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। গ্রাম্য কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ, মাজারে মানতসহ কুচিকিৎসা-অপচিকিৎসা— এসবের ওপরই মানুষ নির্ভরশীল ছিল। এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি, হাতে হাতে আধুনিক প্রযুক্তির মুঠোফোন, ইন্টারনেট— সব জায়গায় দিন বদলের ছোঁয়া। একবিংশ শতাব্দীতে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানেরও হয়েছে অগ্রগতি। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি, প্রয়োজনীয় ওষুধের আবিষ্কার— এক কথায় সব ক্ষেত্রে চিকিৎসাব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, জয় করা গেছে বহু দুরারোগ্য ব্যাধি। শল্যচিকিৎসায়ও অনেক অগ্রগতি হয়েছে। জিনতত্ত্ব জানার সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচন হয়েছে বহু জটিল রোগের কারণ ও ব্যাখ্যা। মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বাড়াতে নানা ধরনের গবেষণা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।

সময়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক আর রোগীদের মূল্যবোধ ও চিন্তাধারাও কি কিছুটা বদলায়নি? এত উন্নতির মাঝেও রোগীদের প্রত্যাশা কি শতভাগ পূর্ণ হয়েছে? প্রায়ই রোগীরা অভিযোগ করেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারকে পাওয়া যায় না, তারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনেন না, ভালো করে রোগী দেখেন না, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন না। রোগী বা তার স্বজনদের প্রত্যাশা হলো, চিকিৎসকের কাছে গেলে বা হাসপাতালে এলেই যেন তত্ক্ষণাৎ ডাক্তার পাওয়া যায় এবং চিকিৎসাও শুরু হয়। অনেক সময় নিয়ে, মনোযোগ দিয়ে রোগীকে ভালো করে দেখা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, চিকিৎসা শুরু হওয়া মাত্রই যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হওয়া যায় ইত্যাদি। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের আরও অভিযোগ— ওষুধ নেই, বিছানাপত্র ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি ঠিক নেই, খাবারের মান ভালো নেই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, এমনকি ডাক্তার-নার্স আসেন না, ভালো করে দেখেন না ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এগুলো রোগীদের আকাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত। অন্যদিকে চিকিৎসকের কথাই ধরা যাক। নানা সীমাবদ্ধতা আর প্রতিকূলতার কারণে চিকিৎসকরা এখনো সেবার জন্য নিজেকে পুরোপুরি উজাড় করে দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। তাদেরও যে ভুলভ্রান্তি, দোষত্রুটি, অদক্ষতা বা অবহেলা নেই, তা নয়। রোগী আর তার স্বজনরাও স্বাভাবিকভাবেই সন্তুষ্ট নন, আস্থা বা ভরসা রাখতে পারছেন না চিকিৎসকের ওপর। নিতান্ত বাধ্য হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু কোথায় যেন একটা অপ্রাপ্তির রেশ আর বিশ্বাসের ফারাক। চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন, কিন্তু রোগীর প্রত্যাশা মিটছে না।

দেশে জনসংখ্যা বেশি, তাই রোগীও বেশি। হাসপাতালগুলোয় রোগীর অত্যধিক চাপ। গ্রামগঞ্জ, উপজেলা এমনকি জেলাসমূহেও প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তার, জনবল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রচণ্ড অভাব। ফলে ডাক্তাররা, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা চাপের মধ্যে থাকেন, চিকিৎসা দিতে হিমশিম খান। আবার অসংখ্য রোগী আর দায়িত্বের চাপে পিষ্ট চিকিৎসকও রোগীর কথা সময় নিয়ে শোনার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। কারণ তিনিও তো মানুষ। রোগীর প্রত্যাশার পরে প্রাপ্তি না পেলে শুরু হয় হতাশা। ডাক্তারের প্রতি অবিশ্বাসের আর আস্থাহীনতার শুরুটা এভাবেই। রোগীদের বিশেষ করে গ্রামের অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষের বিশাল একটি অংশ চিকিৎসকের সামর্থ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। অনেকেই মনে করেন, হাসপাতালে ভর্তি সব রোগীই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবেন। তাদের ধারণা চিকিৎসকদের কাছে সর্বরোগের সমাধান আছে। সত্যিকার অর্থে জটিল রোগে আক্রান্ত কিংবা কোনো দুর্ঘটনায় দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। অনেক জটিল রোগী যেমন স্ট্রোক, হার্ট, কিডনি বা লিভার নষ্ট হয়ে গেলে ব্লাড বা অন্য অনেক ক্যান্সার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য নয়। মুমূর্ষু রোগীদের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়, সেখানে মৃত্যুর হারও বেশি। শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া কখনই সম্ভব নয়। মৃত্যু অমোঘ, চিরন্তন। মৃত্যুর হাত থেকে চিকিৎসক কেন, কেউই বাঁচাতে পারবে না। চিকিৎসক শুধু রোগ নিরাময় আর রোগীকে রোগের উপশম দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। অথচ রোগীরা তা মানতে নারাজ। কেউ মারা গেলে স্বাভাবিকভাবেই আত্মীয়স্বজনরা আবেগপ্রবণ হয়ে চিকিৎসককে লাঞ্ছিত করে বসেন, হাসপাতাল বা ক্লিনিকে শুরু করেন ভাঙচুর, যা একান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত। যেহেতু হাসপাতালে নিরাপত্তাব্যবস্থা যথেষ্ট নেই, তাই বেশির ভাগ চিকিৎসককেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়। নিরাপত্তার এ সমস্যা শুধু গ্রামেই প্রকট নয়, শহরের বড় বড় হাসপাতালেও। আবার অনেকের মানসিকতা হলো উন্নত সেবা চাই, কিন্তু টাকা খরচ করতে চাই না। অথচ অন্য অনেক খাতে আমরা ঠিকই টাকা খরচ করি। এসবের কারণে ডাক্তার ও রোগীর মাঝে ভুল বোঝাবুঝি এবং দূরত্ব থেকেই যাচ্ছে।

যদিও রাজধানী বা বড় বড় শহরে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে বেশকিছু ক্লিনিক বা হাসপাতালে আধুনিক চিকিৎসাসেবা চলছে, তবু দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য খাত কি সমানভাবে এগোতে পেরেছে? দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সরকারি খাত নিয়ে কথা বললে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর কথাই সবার আগে আসে। সেখানে সেবাদানের সুযোগ কি খুব বেশি বেড়েছে? এখনো কি অপারেশন থিয়েটারগুলোয় নিয়মিত অপারেশন হচ্ছে? আধুনিক চিকিৎসাসেবা দেওয়া কি সম্ভব হচ্ছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে? বাস্তব অবস্থা হলো, নানা কারণেই তা হয়নি। আমাদের দেশে রোগীর সংখ্যা বেশি, চিকিৎসার সরঞ্জামাদি ও ওষুধপত্র সীমিত, ডাক্তারসহ অন্য লোকবলও সীমিত। ফলে সত্যিকারের সেবাদান সম্ভব হচ্ছে না। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোয় এখনো অধিকাংশ চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা অনুপস্থিত। এ অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়নি, তা নয়। হাসপাতাল ভবনের সম্প্রসারণ ও আসন বাড়ানো হয়েছে। রোগীর চাপও বেড়েছে সমানতালে। প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তির পরিমাণ আসলেই কম। হাজারো প্রতিকূলতা ঠেলে অজপাড়াগাঁয়ের মানুষের কাছে এখনো উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছেনি। স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখনো পারেনি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে। তবু আশার কথা, কিছুটা হলেও প্রতি বছর লাখ লাখ রোগী এখান থেকে সেবা পাচ্ছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারছেন স্বজনদের কাছে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি না পাওয়ায় অনেকের মাঝে অসন্তোষ থেকেই যাচ্ছে। বেশির ভাগ হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নড়বড়ে কিছু চেয়ার-টেবিলে বসে চিকিৎসকরা সেবা দেন। নিয়ম-কানুনও এখানে চেয়ার-টেবিলের মতোই নড়বড়ে। এখনো আগের মতোই ‘নেই নেই’-এর ছড়াছড়ি। সীমিত বাজেটের বিপরীতে আকাশচুম্বী চাহিদার কাছে আমরা অনেকটাই অসহায়। স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে প্রশিক্ষিত জনশক্তিও লাগে সমানতালে। সেখানে সীমাবদ্ধতা আরও বেশি। সার্জন নেই, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট নেই, নার্স নেই, টেকনোলজিস্ট নেই, সুইপার নেই, নিরাপত্তারক্ষী নেই। প্রয়োজনের তুলনায় জনবলও কম। হাসপাতাল অপরিষ্কার থাকছে। প্রয়োজনের তুলনায় ওষুধপত্রও কম। জরুরি সেবা কার্যক্রমও সীমিত। সব চলছে জোড়াতালি দিয়ে। সরকারি হাসপাতালে এসেও অধিকাংশ ওষুধ কিনতে হচ্ছে রোগীদের নিজ খরচে। খাবারের মান নিয়েও সমস্যা। চিকিৎসকদেরও প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটছে না। তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা নেই, নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। বিশেষ করে মহিলা ডাক্তারদের এগুলো আরও বেশি প্রয়োজন। এত সীমাবদ্ধতা আর পশ্চাৎপদতা দেখে চিকিৎসকরাও আগ্রহ খুঁজে পান না গ্রামে থেকে চিকিৎসাসেবা দিতে। একসময় হতাশ হয়ে কর্মস্থল থেকে ট্রান্সফার নিতে চেষ্টা-তদবির শুরু করেন। ফলে নড়বড়ে অবস্থা নড়বড়েই থেকে যায়।

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের মাঝে স্বাস্থ্যসচেতনতার অভাব সুবিদিত। চিকিৎসার জন্য সামান্য খরচের সামর্থ্যটুকুও অনেকের নেই। তাই নিরুপায় হয়ে চিকিৎসককে এড়াতে গিয়ে অপচিকিৎসার শিকার হন, দ্বারস্থ হন হাতুড়ে ডাক্তার, কবিরাজ, ওঝা-বৈদ্য এমনকি ভণ্ড পীরের। এই তথাকথিত গ্রাম্য চিকিৎসকরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক বা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে, এটাসেটা ভুলভাল বুঝিয়ে রোগীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় মোটা অঙ্কের টাকা। অনেক রোগীর অবস্থা আরও জটিল হয়ে যায়, কখনো চলে যায় নাগালের বাইরে। এ অনিয়মের বিরুদ্ধে কে কথা বলবে? এমনকি আমাদের দেশে একটি কার্যকর রেফারাল সিস্টেম তৈরি হয়নি। ফলে সব রোগীকে যথাযথভাবে চিকিৎসকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে আনা সম্ভব না হলে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই অধোগতি ঠেকানো অসম্ভব।

জেলা সদর ও বড় শহরের হাসপাতালে অবশ্য চিকিৎসাব্যবস্থা অনেকটা ভালো। সীমাবদ্ধতা আর অনিয়ম থাকলেও বিশালসংখ্যক রোগী এসব হাসপাতাল থেকে নিয়মিত সেবা পাচ্ছেন। সরকারি খাতে সবচেয়ে ভালোমানের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখানে মূলত চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের প্রাপ্যতা ও সেবার গুণগত মান তুলনামূলক বেশি। অনেক ব্যয়বহুল আর জটিল অপারেশন এখানে হচ্ছে প্রায় বিনামূল্যে। যদিও অধিকাংশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট আসনের চেয়ে রোগী অনেক বেশি থাকে, তাই সীমিত বরাদ্দ থেকেই এত বেশি রোগীর সেবা দিতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয়। সম্ভব হয় না কাঙ্ক্ষিত মান রক্ষা। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতের প্রবৃদ্ধি দারুণভাবে এগিয়ে চলেছে। বিগত কয়েক দশকে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের যে পরিবর্তন হয়েছে, তা চোখে পড়ার মতো। আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে যেসব আধুনিক হাসপাতাল হচ্ছে, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন। অনেক সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যবিষয়ক সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। দেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার নেটওয়ার্ক। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাত্রারও ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো বিশ্বের উন্নয়নশীল অনেক দেশের জন্য মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাস, পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ, ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিক চালু, শিশুস্বাস্থ্য পরিসেবা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের স্বাস্থ্য পরিসেবা ব্যবস্থা, চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের জন্য ফ্রি চিকিৎসাব্যবস্থা, টিকাদানে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবার উন্নয়নে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন, নতুন হাসপাতাল চালু, স্বাস্থ্য খাতে ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রমসহ উন্নয়নমূলক অনেক উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে। চিকিৎসাব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে যুগান্তকারী। আগে যেসব রোগে ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, আমেরিকার বিকল্প ছিল না; এখন এর চিকিৎসা হামেশা দেশেই হচ্ছে। বিভিন্ন জটিল ও ব্যয়সাধ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখন যথেষ্ট কম খরচে হচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতালে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসাসহ শত শত অপারেশন সফলভাবে করা হচ্ছে। এমনকি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট, হূদরোগের বাইপাসসহ হার্টে রিং পরানো, বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট, নিউরোসার্জারিসহ অনেক আধুনিক চিকিৎসা উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেই হচ্ছে। এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে, আমাদের দেশেও ভালোমানের চিকিৎসক অনেক আছেন, যদিও সংখ্যা খুব সীমিত। কিন্তু এ উন্নয়নের ফাঁকতালে কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী চিকিৎসাসেবার নামে লুটতরাজ আর দুর্নীতি যে করছেন না, তা বলার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেভাবে দুর্নীতি বাসা বেঁধে আছে, স্বাস্থ্য খাতে যে তা থাকবে না, এমনটা আশা করা বাতুলতা। তবে এ দুর্নীতির জাল কীভাবে ছেঁড়া যায়, সে ব্যাপারে সময়োপযোগী উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। কিছু কিছু নামিদামি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ এতই আকাশচুম্বী যে, গরিব-নিম্নবিত্ত এমনকি অনেক মধ্যবিত্তের পক্ষেও সেখানে সেবা নেওয়া অসম্ভব। দেখা যায়, অনেকেই না জেনে নামিদামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান, কিন্তু চিকিৎসা শেষে যখন বিশাল অঙ্কের বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়, তখন শুরু হয় অসন্তোষ এমনকি ভাঙচুর। অনেক রোগীর অভিযোগ, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার চেয়ে বাণিজ্যই চলে বেশি। অনেকে ওইসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসেন। মনঃক্ষুণ্ন হয়ে গালিটা চিকিৎসককেই দেওয়া হয়। অথচ চিকিৎসক এজন্য মোটেই দায়ী নন। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা যখন হয় পণ্য, তখন তার গুণগত মান হয় নিম্ন।

স্বাস্থ্যব্যবস্থার যথাযথ তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের জন্য শক্তিশালী ও বাস্তবমুখী কর্মপদ্ধতির অভাব দারুণভাবেই অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু এতসব সীমাবদ্ধতা আর সংকটের মাঝেও বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাত দারুণ সম্ভাবনাময় একটি ক্ষেত্র। সঠিক দিকনির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারলে আন্তর্জাতিক মানের একটি উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে, পাশের দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাংলাদেশ অর্জন করেছে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। এখন প্রয়োজন শুধু দুর্নীতি আর অনিয়মের জগদ্দল পাথর ধ্বংস করে দেশপ্রেমের আলোকে জাতিকে উজ্জীবিত করে সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ়প্রত্যয়ে আপসহীন পথচলা। জ্ঞানবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি ও অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিকিৎসাব্যবস্থাকে সঠিক ও সুন্দর পথে এগিয়ে নিতে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে যারা এই মহান পেশার সঙ্গে জড়িত।

লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর