রবিবার, ৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভূমিহীন থেকে ভূমি মালিক—লক্ষণীয় আবর্তন

শাইখ সিরাজ

ভূমিহীন থেকে ভূমি মালিক—লক্ষণীয় আবর্তন

ঐতিহ্যগতভাবেই কৃষি একটি পারিবারিক পেশা। পরিবারের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করার ধারণা থেকেই প্রাচীন মানুষ সভ্যতার সূচনা ঘটায় কৃষির মাধ্যমে। প্রকৃতি ও পরিবারই ছিল কৃষির মূল নিয়ামক। আধুনিক যুগে এসে কৃষি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হলো। কিন্তু সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যত নতুন নতুন পেশা তৈরি হলো তার সবই কৃষিকে ঘিরে। আজ বিকশিত সভ্যতার যুগে শত সহস্র পেশা পৃথিবীতে যুক্ত হয়েছে।  কিন্তু পেশাগুলোর সঙ্গে কৃষির যোগসূত্র যেন দিনে দিনে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীব্যাপীই পারিবারিক কৃষি ঐতিহ্যে এক রকমের ধস নেমেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক হিসাবে দেখা যায়, পৃথিবীতে প্রায় ৫৭ কোটি খামার রয়েছে যেগুলো নির্দিষ্ট পরিবার দ্বারা পরিচালিত। অবশ্য আগে কখনো এই পারিবারিক কৃষি খামারের হিসাব গুরুত্বের সঙ্গে করা হয়নি। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতি মোকাবিলা ও নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে পারিবারিক কৃষির গুরুত্ব নতুনভাবে অনুভূত হতে থাকে। সেই চিন্তা থেকেই ২০১৪ সালকে আন্তর্জাতিক পারিবারিক কৃষিবর্ষ হিসেবে উদ্যাপন করেছিল জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা।

কৃষি উৎপাদন তথা খাদ্য নিরাপত্তায় পারিবারিক কৃষি যখন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ তখন বাস্তবতায় ঐতিহ্যবাহী বা বংশানুক্রমিক কৃষক পরিবার দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আজকের দিনে বাণিজ্যব্যবস্থা, বিশ্বায়ন ও সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মকে কৃষির প্রতি বিমুখ করে তুলছে। লাভালাভের বিবেচনায় কৃষি থেকে দূরে চলে যাচ্ছে একেকটি কৃষক পরিবার। বেছে নিচ্ছে অর্থ উপার্জন ও পেশার অন্য পথ। কৃষক পিতা যেমন সন্তানকে কৃষক হিসেবে গড়ে তুলতে চান না, একইভাবে সন্তানও কৃষির সঙ্গে তার সম্পর্ক রাখাকে খাটো মনে করেন। আমাদের মতো দেশগুলোয় কৃষককে মর্যাদা দিতে পারেনি রাষ্ট্র। অন্যদিকে ইউরোপ, আমেরিকার প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। কৃষি পেশা এবং কৃষক সমাজ রাষ্ট্রের কাছে স্বীকৃত ও মর্যাদাপূর্ণ। তার পরও দেখা যায়, যে কৃষকসন্তান একবার গ্রাম ছেড়ে শহরে গেছে সে আর গ্রামে ফিরতে চায় না। গেল বছর অক্টোবরের দিকে ইংল্যান্ডের শর্পশায়ারে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ ধারণ করতে সে এলাকার ঐতিহ্যবাহী কৃষক স্টিফেনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। এই দম্পতির চার ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় দুই ছেলে কৃষিতে টিকে থাকলেও ছোট ছেলে ও ছোট মেয়ে কৃষিতে ফিরে আসতে মোটেও ইচ্ছুক নন। একজন ব্যাংকার আর একজন সাংবাদিক। ফলে স্টিফেন পরিবার তার মোট জমির প্রায় ৫০ ভাগ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে দেখভাল করার লোকের অভাবে। আবার আমেরিকার কৃষিনগরী খ্যাত আইওয়াতে শতবর্ষী বেশ কিছু একান্নবর্তী কৃষক পরিবারকে দেখেছি। এসব পরিবারকে যে কোনোভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার অনেক বেশি আন্তরিক। পরপর কয়েক প্রজন্ম একই জমিতে, একই সুবিধায়, একই ধারাবাহিকতায় কৃষিকাজ করছে। সেখানে কৃষিকাজের সুবিধা দিন দিন বাড়ছে। খামার যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও উচ্চ ফলন শীল বীজ ঢুকছে। কৃষকের জন্য বাজারব্যবস্থা বাড়ছে। আর এসব সুবিধার কারণেই, যেখানে দাদা ছিলেন ৫০ একর জমির মালিক, এখন তিন প্রজন্ম মিলে সেখানে জমির আয়তন দাঁড়িয়েছে ৩০০ থেকে ৫০০ একরে, কখনো তারও বেশি। শতবর্ষী একটি কৃষি খামারে নেলস ও কেনি লা দম্পতি কথাগুলো বলছিলেন বেশ আত্মমর্যাদা নিয়ে। ২০০৪ সালে প্রথম চীনের হুনান প্রদেশের বিভিন্ন কৃষি এলাকা সফর করে মাঠপর্যায়ে যে চিত্র দেখেছি, সেখানে চোখে পড়েছে মাঠে মাঠে কর্মরত কৃষক। আবার ২০১৬-এর মধ্যভাগে সেই চীনেই ফসলের ভর মৌসুমে মাঠে কোনো কৃষক খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই ১২ বছরে পরিবর্তনটি লক্ষণীয়। ১৪০ কোটি জনমানুষের দেশ চীনে কৃষি থেকে জনগণ সরে যাচ্ছে টের পেয়ে সে দেশের সরকার বাধ্য হয়েছে কৃষিকে শতভাগ যান্ত্রিকীকরণ করতে। বিশ্বব্যাপী কৃষি ক্ষেত্রে এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।  তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কৃষকের দেশ। একসময় পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষক ৫-১০-২০ বিঘা জমিতে কৃষিকাজ করেছেন। কিন্তু বাণিজ্যিক কৃষির যুগে কৃষকের জমির অংশীদারিত্ব কমে যাওয়াসহ নানা কারণেই কৃষিতে আর লাভ খুঁজে পাচ্ছেন না। কৃষি এখন পুরোপুরি বিনিয়োগ ও শ্রমমুখী হয়ে ওঠায় চুলচেরা হিসাব কষে জমি লিজ বা ভাড়া দিয়েই বেশি লাভবান জমির মালিকরা। দেশের অধিকাংশ জেলাতেই লিজ বা বর্গা প্রথা চালু রয়েছে। প্রায় ৮০ ভাগ কৃষক এ দেশে বর্গা বা লিজ চাষি।

 

 

দেশের কৃষি বৈচিত্র্যের হিসাবে গত এক দশকে সবচেয়ে সামনে চলে এসেছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা। উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদ ও সবজিতে এ উপজেলার কৃষকের সাফল্য আজ দেশজোড়া। এ উপজেলার সিংহভাগ জমি এখন আবাদ করছেন বর্গা চাষি। দেখার বিষয় হচ্ছে, এরা কিছু দিন আগেও ছিলেন পুরোপুরি কৃষিশ্রমিক বা খেতমজুর। আর ভূমিমালিক কৃষকরা চলে গেছেন বিনিয়োগমুখী অন্য পেশায়। ঈশ্বরদীর মুলাডুলি গ্রামের কথা বলছি। এখানে শত শত বিঘায় হচ্ছে শিমের আবাদ। খেতে গিয়ে কিছু কৃষকের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম, এরা বছরখানেক আগেও ছিলেন কৃষিশ্রমিক। এখন বর্গা চাষি। শান্ত মুলাডুলি গ্রামের এক তরুণ কৃষক। যিনি লিজ নিয়ে জমি চাষ করেন। কয়েক বছর আগেও ছিলেন শতভাগ ভূমিহীন। পরিবারের সবার শ্রম বিনিয়োগ করে লিজ চাষের মধ্য দিয়ে তিনি ১ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন পাঁচ বছরে। যে ভূমি মালিকের জমিতে পাঁচ বছর আগে ছিলেন শ্রমিক, সেই জমিতে লিজে কৃষিকাজ করতে করতে রূপান্তরিত হয়েছেন ভূমি মালিকে। বলা যায়, কৃষি ক্ষেত্রে শ্রম, বিনিয়োগ, উদ্যোগী মনোভাব ও তত্পরতার ভিত্তিতে এই আবর্তন ঘটছে। পাঠক লক্ষ্য করুন, কৃষিশ্রমিক থেকে বর্গা চাষি, বর্গা চাষি থেকে আবার ভূমি মালিক— কৃষক হচ্ছে একটি শ্রেণি। এ পরিবর্তনগুলো দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণের বিষয় হতে পারে। কীভাবে ভূমি মালিক ভূমিহীন হচ্ছে আর ভূমিহীন হচ্ছে ভূমির মালিক। এ দৃশ্যটি বাংলাদেশের সব জেলাতেই কমবেশি লক্ষ্য করছি। গৃহস্থ জমি লিজ দিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট লাভ পেয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে বর্গা চাষি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফসলের বেশি ফলন নিশ্চিত করতে গিয়ে মাটির গুণ রক্ষার প্রতি সুবিচার করতে পারছেন না। মুলাডুলির উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রুমানা পারভীন বলছিলেন, শিমপ্রধান এই এলাকায় চাষিরা বেশি উৎপাদনের আশায় গাছের গোড়ায় লবণের ব্যবহার করেন। এতে সত্যিকার অর্থে ভূমি বা মাটি অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল। এটা ভবিষ্যৎ কৃষির জন্য এক অশনি সংকেত।

 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে এ এলাকায় অর্থাৎ মুলাডুলি ব্লকে গ্রাম রয়েছে ৮টি। ৮টি গ্রামে কৃষিখানা বা কৃষক পরিবারের সংখ্যা ২ হাজার ৩৮৫। এর মধ্যে ভূমি মালিকের সংখ্যা ১ হাজার ২১৯। বর্গা চাষি ১ হাজার ১৬৬। কিন্তু বাস্তবে ভূমি মালিকদের মধ্যে নিজেরা চাষাবাদ করেন, এই হিসাবটি একেবারেই কম।

শিম খেতে কাজ করছিলেন কৃষক হামিদুর রহমান ও তার স্ত্রী। কয়েক বছর আগে হামিদ এ খেতেই কাজ করতেন কৃষিশ্রমিকের। বছর পাঁচেক আগে প্রথম ১ বিঘা জমি লিজ নিয়ে শিম আবাদ শুরু করেন। এখন ১০ বিঘায় তার শিমের আবাদ। সাফল্যও পেয়েছেন আশাতীত। জমি কিনেছেন ১৫ কাঠা। বাড়ি বানিয়েছেন। কৃষিতে পুনর্বিনিয়োগ করার পর্যাপ্ত অর্থও আছে হাতে। হামিদের কাছে বিষয়গুলো আরও পরিষ্কার। কৃষির পরিবারচক্রে যেমন পরিবর্তন আসছে, পরিবর্তন আসছে সামগ্রিক কৃষিতেও। মাঠের পাশেই হামিদের বাড়িতে গেলাম। সাজানো-গোছানো ছোট্ট একটি বাড়ি। তিন ভিটিতে তিনটি ঘর। একসময় এ ভিটিতে হামিদের বাবা ফয়জুদ্দিনের একটি ঘরই ছিল। স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে হামিদের ছোট্ট পরিবার। ঘরে ঢুকে প্রথমেই চোখ গেল সোফাসেট, এক কোণে একটি টেলিভিশন ও ফ্রিজের দিকে। বুঝে উঠতে পারলাম হামিদের জীবন-জীবিকায় পরিবর্তন এসেছে। হামিদের স্ত্রী পান্নাকে জিজ্ঞাসা করলাম ফ্রিজের ব্যবহার সম্পর্কে। তিনি জানালেন কোরবানির মাংস সারা বছর রেখে খাওয়া যায়।  আর? বললেন, উনি (স্বামী) মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা পানি চান। কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকল স্কুলফেরা হামিদের বড় মেয়ে রাত্রি।

পাঠক, বলতেই হবে উন্নতির ঠিকানা ঠিক এখানেই। ভূমিহীন খেতমজুর থেকে বর্গা চাষি, সেখান থেকে ভূমি মালিক এবং সচ্ছল কৃষক।  এ উন্নতি যেন এসে মিলেছে মেয়ে রাত্রির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার জিপিএ-৫ পাওয়া ফলে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর