সোমবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও আজকের বাংলাদেশ

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও আজকের বাংলাদেশ

আগামীকাল ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকার পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে লন্ডন দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন। ৪৫ বছর পর সে ঘটনার দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখি বঙ্গবন্ধু ফিরে আসায় সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় এবং সুরক্ষিত হয়। আবার এও দেখি তিনি ফিরে এসে তার আজীবন সংগ্রামের ফসল যে বাংলাদেশ আমাদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সেটি আমরা হারিয়ে ফেলি পঁচাত্তরের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে, যা ফিরে পাওয়ার সংগ্রামের পথে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আজও আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেরণা ও শক্তি বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন। তাই ১০ জানুয়ারির মতো দিবস আমাদের জাগ্রত করে বলেই তার মূল্য ও গুরুত্ব আমাদের কাছে অপরিসীম। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে অতি অল্প সময়ে বঙ্গবন্ধু তার ভুবনমোহনী ক্যারিশমার জোরে যেরকম সব অসম্ভবকে সম্ভব করেন, তা এক কথায় ভাবা যায় না, ইতিহাসে তার উদাহরণ বিরল। রাজনৈতিক সমঝোতা অথবা নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি। এ স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র বিপ্লব, যুদ্ধ এবং ৩০ লাখ মানুষের জীবন গেছে মাত্র ৯ মাসে। ১০ মাস পর প্রিয় জন্মভূমির মাটিতে পা রেখে বঙ্গবন্ধু দেখলেন দেশের সম্পদ বলতে মাটি এবং বেঁচে থাকা মানুষ ব্যতিরেকে আর কিছু নেই। ৩০ লাখ নিহত মানুষের বেঁচে থাকা স্বজনদের বুকফাটা কান্না এবং ৪ লাখ ইজ্জতহারা নারীর সব হারানোর আর্তনাদের নির্মম করুণ স্পর্শে তিনি চোখের পানি ফেলেছেন, আবার বলেছেন বাঙালি মানুষ হয়েছে, আমার জীবনের স্বপ্ন বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। দেশে ফেরার পরপরই তিনি কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হন। কোনো সমস্যারই সহজ ও তাত্ক্ষণিক সমাধান নেই। প্রতিটি সমস্যার সঙ্গে মানুষের জীবন ও নবজাত স্বাধীনতার টিকে থাকা না থাকার প্রশ্ন জড়িত। ১৬ ডিসেম্বরের পর পলাতক আল বদর, রাজাকার, জামায়াতি ক্যাডার বাহিনী এবং বিহারিদের কাছে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। ৯ মাসের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে এসব দেশীয় বিশ্বাসঘাতকের অপরাধ পাকিস্তানিদের চেয়েও অনেক বেশি। তাই এদের বিরুদ্ধে শেষ যুদ্ধটা করার জন্য প্রায় দুই লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে হুকুমের অপেক্ষায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিশাল হৃদয় আর কোনো রক্তক্ষরণ চায়নি। দেশের ভিতরে লুকিয়ে থাকা পরাজিত ও স্বাধীনতার শত্রুদের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে বিচার করার ঘোষণা দিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য হুকুম দিলেন। কেউ টুঁ-শব্দ না করে সব মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র জমা দিয়ে দিলেন। এতবড় সাহসী সিদ্ধান্ত তখন কেবল বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই নেওয়া সম্ভব ছিল। বঙ্গবন্ধু আরও অন্তত ১০ বছর দেশ শাসন করতে পারলে নিশ্চয়ই এ সিদ্ধান্তের সুফল আমরা পেতাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনরুত্থান এবং মুুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনকে তছনছ করা দেখে মনে হয় মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন যদি শেষ লড়াইটার সমাপ্তি ঘটাতে পারতেন তাহলে আজ আমরা অন্যরকম বাংলাদেশ দেখতাম। তখন ঘোষণা অনুযায়ী স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারের জন্য আইন ও ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের আগ পর্যন্ত বিচার চলছিল। বঙ্গবন্ধু যথাসময়ে ফিরে আসার ফলেই অল্প দিনের মধ্যে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বিশ্বের সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে বিরল। রাশিয়া, চীন, কিউবা, যে কোনো বিপ্লবের ইতিহাস পড়লে দেখা যায় প্রতিক্রিয়াশীল শাসকের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পরেও পরবর্তী আরও প্রায় পাঁচ-সাত বছর ধরে বিপ্লবী শাসন এবং সে সময়ে আরও অগণিত মানুষের রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে তারপর আইনের শাসন ও স্থিতিশীলতা এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে বিজয় অর্জনের পরপরই ওয়েস্ট মিনিস্টার স্টাইলের সংসদীয় পদ্ধতির পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। মাত্র ১০ মাসের মাথায় বিশ্বের সেরা একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা স্বাভাবিক স্ট্যান্ডার্ডে ভাবা যায় না।

 

 

এ জন্যই বঙ্গবন্ধু অনন্য এবং মহান নেতা। এখানেই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফিরে আসার মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব। রাজনৈতিক সমঝোতা ও আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পরেও ভারতের সংবিধান প্রণয়নে প্রায় সাড়ে তিন বছর, আর পাকিস্তানের প্রায় নয় বছর সময় লাগে। আরও কতগুলো অতি জটিল বিষয়ও বঙ্গবন্ধু তাড়াতাড়ি মীমাংসা করে ফেললেন। পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী প্রসঙ্গ ও তাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ভারতের সেনাবাহিনী ফেরত যাওয়া অথবা আর কতদিন থাকা প্রয়োজন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত, দেশীয় পরাজিত গোষ্ঠীর অস্ত্রসহ আত্মগোপনের বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমাদান প্রসঙ্গ, পাকিস্তানি আটকেপড়া বাঙালিদের ফিরিয়ে আনা এবং সর্বোপরি নতুন সরকারের ধরন, গঠন ও নেতৃত্ব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের ভিতরের অন্তর্দ্বন্দ্ব বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। এমনিতেই সদ্য স্বাধীন দেশের সবকিছু ভঙ্গুর অবস্থায়, তার ওপর অন্তর্দ্বন্দ্বে নিয়ন্ত্রণহীন কিছু ঘটলে নিজেদের দুর্বলতার সুযোগে দেশের ভিতরে লুকিয়ে থাকা পরাজিত গোষ্ঠী এবং দেশের ভিতর-বাইরে পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠাকারীদের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতাবিরোধী রাষ্ট্রগুলোর যোগসাজশে পুনরায় আরেকটি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারত। তখন যুদ্ধ হতো বহুমুখী এবং একাধিক বিদেশি বাহিনীর সংশ্লিষ্টতায় বাংলাদেশ আরেকটি ভিয়েতনামে পরিণত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সঠিক সময়ে দেশে ফিরে আসায় তার ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব এবং সব ইস্যুতে রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদৃষ্টিপূর্ণ সিদ্ধান্তের ফলে তখন আমাদের স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় এবং সুরক্ষিত হয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রামের ধাপে ধাপে পুঞ্জীভূত বাঙালি জাতির পরিপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেন, যার বৈশিষ্ট্য পরস্ফুিটিত হয় বাহাত্তারের সংবিধানে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে এটা সম্ভব হতো না। তাই বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এক ও অভিন্ন। স্বাধীনতার ৪৫ বছরের পর অনেকে বহুরকম কথা বলেন। অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত নেতানেত্রীরা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অর্বাচীনমূলক মন্তব্য করেন। তাদের বলি বুকে হাত দিয়ে একবার বলুন তো বঙ্গবন্ধু ছয় দফা প্রণয়ন না করলে সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় না পেলে এবং একাত্তরের মার্চ মাসে যদি বঙ্গবন্ধু ছয় দফার সঙ্গে আপস করতেন তাহলে কি একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো? কিন্তু ট্র্যাজেডি হলো, ৪৫ বছর পরে এসেও বঙ্গবন্ধুর প্রণীত বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্য এখনো আমাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে, আজও এদেশের মানুষকে একই কারণে জীবন দিতে হচ্ছে। কিন্তু ৪৫ বছর পরে এসে আবার পাল্টাপাল্টি রক্তক্ষরণ কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশের মানুষকে ভাবতে হবে। ২৩ বছরের সংগ্রাম এবং ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে আহরিত ও আকাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে বা পাশ কাটিয়ে দেশের উন্নতি, সমৃদ্ধি ও মর্যাদা অর্জন সম্ভব নয়। হবে না। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে তা প্রমাণিত হয়ে আছে। তাই দেশের জনগণকে সঠিক রাজনৈতিক মূল্যায়ন করতে হবে। দেশের সব রাজনৈতিক দল হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। বিশ্বের দুটি দেশে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রয়েছে। প্রথমটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর দ্বিতীয়টি বাংলাদেশ। এটি আমাদের জন্য অনন্য মর্যাদার স্বাক্ষর। গত প্রায় আড়াইশ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের প্রতি সফল দল, সব নাগরিক অকুণ্ঠচিত্তে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসছেন, একটি কথাও আজ পর্যন্ত ওঠেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে যারা অমান্য করে, অসম্মান করে তাদের কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বা মানুষ বলা যায়? ছয় দফা, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের উজ্জ্বলতাকে যারা আড়াল করে, খাটো করে এবং ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চায় তারা কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের? যার জন্ম না হলে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, সেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যারা মর্যাদা দেয় না, তার সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ কথা ও অর্বাচীনমূলক মন্তব্য করে, তাদের কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বা মানুষ বলার সুযোগ আছে। অনেক ঝড় তুফানের মধ্যেও মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের রাজনৈতিক শক্তির হাতে সবকিছু তুলে দেয়নি বলে আজ আবার বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। গত ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল, ‘সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশ।’ এ কথা শুধু বাংলাদেশের মানুষের মুখের নয়। বিশ্বের সব নামিদামি গবেষণা সংস্থা, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, সবাই গত পাঁচ-সাত বছরের সূচক বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার কথা বলছেন। বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন স্থিতিশীল, প্রাণোদীপ্ত এবং অগ্রসরমান। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ দারিদ্র্যমুক্ত হবে বাংলাদেশ। রাজনীতি পরিপূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের ধারায় ফিরে এলে অগ্রায়নের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে। সংগ্রাম চলছে। অগ্রগতিও আছে। তবে এখনো যেতে হবে বহু দূর।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

নিউ অরলিনস, ইউএসএ

সর্বশেষ খবর