শিরোনাম
বুধবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

গণতন্ত্রের আর্তনাদে ওয়ান-ইলেভেনের পরাজয়

পীর হাবিবুর রহমান

গণতন্ত্রের আর্তনাদে ওয়ান-ইলেভেনের পরাজয়

ঘটনাবহুল বাংলাদেশের রাজনীতিতে ওয়ান-ইলেভেন অনেকগুলো দগদগে ক্ষতের মতো এখনো রয়ে গেছে। ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা বিভ্রান্তির পথে জনগণের গণতান্ত্রিক আর্তনাদের কাছে ব্যর্থ হয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে গেছেন। নদীতে জল অনেক গড়িয়েছে, স্রোতের মতো সময় বসে থাকে না। বসে থাকেওনি। সেনাসমর্থিত ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই ভালো আছেন।  সেই সময়ে ক্ষমতাধর সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ আমেরিকায় ক্যান্সারের সঙ্গে লড়লেও ক্ষতি হয়নি। তারপরই ক্ষমতাধর লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়ায় হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তেজগাঁও-গুলশান ১ নম্বরের লিঙ্ক রোডে তার প্রতিষ্ঠিত পিকাসো রেস্টুরেন্ট অভিজাতদের জন্য উপাদেয় খাবারের ব্যবস্থা করেছে। বাণিজ্যিকভাবেও ব্যবসাসফল রেস্তোরাঁটি। ব্রিগেডিয়ার থেকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি নিয়ে অবসরে যাওয়া আমিন কোথায় জানি না। সেই সময়ের আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা চৌধুরী ফজলুল বারী সেনাকর্মকর্তা হিসেবে প্রাপ্য সুবিধাবঞ্চিতই হননি, যুক্তরাষ্ট্রে জীবনের কঠিন যুদ্ধে নিয়োজিত।

ওয়ান-ইলেভেনে বহুল আলোচিত ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেরই ক্যারিয়ার জীবনের ইতি ঘটেছে। মাঠের দায়িত্ব পালনে নিয়োজিতদের অনেকের বাড়াবাড়ি যেমন সীমা অতিক্রম করেছিল; তেমনি অনেকের পেশাগত জীবনের ইতিও ঘটেছে অকালে। এদের মধ্যে চৌধুরী ফজলুল বারী সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক ও মানসিক বিপর্যয়ে পড়েছেন। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি অপরাহ্নে বঙ্গভবন থেকে বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহমেদ দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই সময়টা ছিল এক অবরুদ্ধ সময়। ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপির মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ এবং নির্বাচনী সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে মহাজোটের আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ সহিংস রূপ নিয়েছিল।

এদিকে বিএনপি ছিল আরেক দফা নিজেদের সাজানো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও প্রশাসনের মাধ্যমে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনে মরিয়া। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিচারপতি কে এম হাসানের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল। বিব্রত কে এম হাসান শুরুতেই প্রধান উপদেষ্টা হতে আপত্তি জানিয়ে সরে দাঁড়ান। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের অভিযোগ ছিল, কে এম হাসান এক সময় বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বিএনপি বাড়িয়ে ছিল কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা করার জন্য। কে এম হাসান বিব্রত পরিস্থিতিতে দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করলে আওয়ামী লীগ জোট চেয়েছিল বিচারপতি মাহমুদুল আমিন চৌধুরী বা বিচারপতি মোস্তফা কামাল; যাকেই প্রধান উপদেষ্টা করবে তার অধীনেই তারা নির্বাচনে যাবে।

সেদিন বিএনপির প্রভাবে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন সংবিধানের ধারাকে কাজে লাগিয়ে নিজেই প্রধান উপদেষ্টা হয়ে যান। নির্বাচনকালীন ক্ষমতার কেন্দ্র বঙ্গভবন হয়ে উঠলেও নাটাই পড়ে থাকে হাওয়া ভবনে। সমঝোতা চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী, সি এম সফি সামী এবং অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করে নেয়। মাঝখানে এরশাদের মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করা হলে তা নির্বাচন বর্জনের দিকে আওয়ামী লীগ জোটকে ঠেলে দিতে অবদান রাখে। বিএনপির পছন্দের বিচারপতি এম এ আজিজ ও তার নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও আওয়ামী লীগ জোটের আপত্তি ছিল। সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে বিচারপতি আজিজ রীতিমতো ভাঁড়ের ভূমিকায় নিত্যদিন নিজেকে উন্মোচিত করেন। সব দলের বর্জনের মুখে বিএনপি-জামায়াত জোট একতরফাভাবে সেই নির্বাচন করে ফেলতে চাইলে কার্যত গোটা দেশ সহিংসতার পথে অচল হয়ে পড়ে। এমনি পরিস্থিতিতে বিদেশি কূটনীতিকরা তত্পর হয়ে ওঠেন। পর্দার অন্তরালে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেও নানা মহলের বৈঠক ও বার্তা বিনিময় জোরদার হতে থাকে। সেই অনিশ্চিত, সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ওয়ান-ইলেভেনে বঙ্গভবনে সেনা হস্তক্ষেপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃতাধীন নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রশক্তিই নয়; দেশের জনগণও সমর্থন জানায়। এক কঠিন পরিস্থিতি থেকে সেই জরুরি অবস্থা ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগমনে মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

যে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের সামনে স্বপ্নের চিত্রকল্প তুলে ধরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন নিয়ে এসেছিল, দুই বছরের মাথায় তা শূন্যের কোঠায় চলে যায়। তারা নির্বাচন কমিশনে সংস্কার ও ১ কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোটার বাদ দিয়ে একটি নতুন, পরিচ্ছন্ন ভোটার তালিকা সম্পন্ন করলেও নানামুখী পদক্ষেপ তাদের জনবিচ্ছিন্ন করে ও জনরোষে ফেলে দেয়। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা অসহায়ের মতো নির্যাতনে পতিত হলেও কোনো প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেননি। তাদের প্রেসক্রিপশনে রাজনীতিতে সংস্কারের ঢেউ ওঠে। দেশের মানুষ সংস্কার চাইলেও পরবর্তীতে প্রমাণ হয়েছে, দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিতে নেতারা যে সংস্কারের কোরাস তুলেছিলেন তা কার্যত তাদের দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্রের ফর্মুলা হয়ে ওঠে। এতে সংস্কার গালিতে পরিণত হয়ে যায়।

 

 

দুই দলের অভ্যন্তরে দুই নেত্রীর সামনে যারা কথা বলতে পারতেন না, সেই তারাই তাদের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। সংস্কারের পক্ষে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি নেতৃত্বের একটি বড় অংশ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব মরহুম আবদুল মান্নান ভূঁইয়া সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণাকালে দলের বড় অংশের নেতাদের পাশে পেয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে সংস্কারের পক্ষে অনেকে অবস্থান নিলেও যে নেতারা নিজেদের বাসভবনে গণমাধ্যম কর্মীদের ডেকে সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করেছিলেন, সেখানে দলের নেতাদের পাশে পাননি। আওয়ামী লীগের সংস্কারপন্থি নেতারা ছিলেন মাঠের কর্মী বিচ্ছিন্ন। মাঠকর্মীরা ছিলেন শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত। তাই সংস্কারপন্থি নেতাদের সঙ্গে তাদের অনুসারীরা প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে আসতে চাননি বলে তারা আলাদাভাবে নিজ নিজ বাড়িতে গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে নিয়ে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আজকের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে জুন মাসে নির্বাচন চেয়েছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে আজিজকে সরিয়ে ড. শামসুল হুদার যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিল, সেটি শক্তিশালী হয়েছিল, গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছিল। জুন মাসে শেখ হাসিনার নির্বাচনের দাবি দলের ওয়ার্কিং কমিটিতে সংস্কারপন্থি নেতারা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং সেটি স্থগিত করতে বাধ্য করেছিলেন। পরদিন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ধানমন্ডির কার্যালয়ে এ কারণে আওয়ামী লীগের আজকের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম কর্মীদের নিয়ে সংস্কারপন্থি নেতাদের সঙ্গে অশোভন আচরণও করেছিলেন। এ জন্য পরবর্তীতে তাকে পলাতক জীবনযাপন করতে হয়েছে।

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেই পরিবর্তনের যে চিত্রপট তুলে ধরেছিলেন, তাতে সমর্থনও পেয়েছিলেন। গণমাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও নিজ দায়িত্বেই আমরা অনেকে আবেগের সীমা ছাড়িয়ে অতিমাত্রায় উৎসাহী হয়ে উঠেছিলাম। গণমাধ্যম সেদিন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ডকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল। নিউ এজ সম্পাদক নরুল কবীরই শুধু সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। বাকিরা আমরা সবাই ভুলে গিয়েছিলাম যে, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কার্যত সেমি মার্শাল ল’তে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রের সঙ্গে, মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে এই শাসন ছিল বিপরীতমুখী। কিন্তু অতীতে রাজনীতিতে যে নেতিবাচক ধারা তীব্র হয়ে উঠেছিল; তাতে হতাশা-ক্ষুব্ধ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন পেয়েছিল সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কথিত আছে, সেদিনের সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ পাঁচ তারকা জেনারেলই হননি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গণতন্ত্রের বিপরীতে সেনাশাসনের পক্ষে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে দিল্লি কেউ তাকে সমর্থন জানায়নি। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলেছিল, তারা আরেকজন পারভেজ মোশাররফ তৈরি করতে চায় না। পাকিস্তানের সেনাশাসক পারভেজ মোশাররফকে নিয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট তখন সুখী ছিল না। দেশটিকে গণতন্ত্রের উত্তরণে নিয়ে যেতে চিন্তা করছিল।

অনেকেই বলেন, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যর্থতার নেপথ্যে রয়েছে তাদের অদূরদর্শিতা ও অপরিপক্বতা। সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ না করে রাজনৈতিক দল গঠনের পথ না নেওয়ায় এমনটি ঘটেছে। ষাটের দশকের ছাত্রলীগের সভাপতি ও পরবর্তীতে বিএনপি নেতা ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীকে দিয়ে তারা একটি প্রাথমিক দল গঠনও করেছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী ও আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থন না পাওয়ায় সেটি সফল হয়নি। নব্বই-উত্তর সেনাবাহিনী গণতন্ত্রের পক্ষেই তার অবস্থান দৃঢ় রেখেছে। ওয়ান-ইলেভেনে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনরত কিছু কিছু সেনা কর্মকর্তা যারা পরবর্তীতে অবসরে গেছেন মানুষের ওপর তাদের বাড়াবাড়ি ছিল সীমাহীন।

অনেকে বলেন, সেই সরকার একদিকে দেশের রাজনৈতিক শীর্ষ নেতা-কর্মীদের পরিবার-পরিজনসহ সামাজিকভাবে অপদস্ত করেছে। অন্যদিকে দুর্নীতির মামলায় জেল খাটিয়েছে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের। না হয় দেশছাড়া করেছেন, রিমান্ড-নির্যাতন চালিয়েছেন। তাতে করে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ জন্ম দিয়েছিল। তারা একদিকে বিজয় সরণির র্যাংগস ভবন ভেঙে দিয়েছেন, অন্যদিকে ফুটপাথের দোকানও গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। তারা একদিকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ শীর্ষ রাজনীতিবিদ, আমলাদের হয় জেলে পুরেছেন, রিমান্ডে নিয়েছেন, না হয় দেশত্যাগে বাধ্য করেছেন। তেমনি, তৃণমূলে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপরও নির্যাতন, হয়রানি চালিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এতে করে গোটা দেশ দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। যার বিস্ফোরণ ঘটেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উত্তাল প্রতিবাদ বিক্ষোভে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে যেদিন টেনেহিঁচড়ে গ্রেফতার করে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই দৃশ্য মানুষকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে। এর আগে শেখ হাসিনা দেশের বাইরে গেলে তাকে ফিরতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে জোর করে দেশত্যাগে বাধ্য করার দৃশ্যপট ও তার পক্ষে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান গ্রহণ দেশের মানুষকে সংক্ষুব্ধ করে তোলে। শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি অনুগত নেতা-কর্মীরা হয় জেল না হয় বিদেশে পলাতক জীবন বেছে নেন। অনেকের বিরুদ্ধে আবার মামলাগুলো ছিল সামাজিকভাবে হেয় করার শামিল। কখনো মদ পান না করেও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মদের মামলায় ফেলে তার বাড়ি তছনছ করা হয়। তাকে পলাতক জীবনে চলে যেতে হয়। আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের অনেকেই বিদেশ থেকে টেলিফোনে নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করেন। দুই দলের নেতারাই সেটি করেছেন। আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম এবং আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম জানামতে রোজ এ কাজটি করেছেন। সেই সরকারের গ্রেফতারি পরোয়ানার মুখে বিদেশে পলাতক শেখ হাসিনার তৎকালীন একান্ত সচিব আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম বিদেশ থেকে সংস্কারপন্থি নেতাদের টেলিফোনে হতাশ করে দিতেন। প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতেন, এদের পতন আসন্ন। আপনারা শেখ হাসিনার পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন।

শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের পর ধানমন্ডির কার্যালয়ে ওয়ার্কিং কমিটির সভা থেকে বের হওয়ার পর সংস্কারপন্থি নেতাদের বাইরে দাঁড়ানো কর্মীরা কাউকে কাউকে লাঞ্ছিত করতেও ছাড়েননি। আওয়ামী লীগের নেতাদের যে অংশটি শেখ হাসিনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের কারও কারও স্বপ্ন ছিল রাজনীতিতে শেখ হাসিনা মাইনাস হলে তারাই শেখ হাসিনার পক্ষের শক্তি হিসেবে ক্ষমতাধর হবেন। সংস্কারপন্থিরা দলে ভাঙন সৃষ্টির তত্পরতাও চালিয়েছিলেন। কিন্তু গভীর প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে ধীরস্থিরভাবে ঠাণ্ডা মাথায় সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার মুক্তি পর্যন্ত দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে যে মানুষটি ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি সেদিনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান।

অন্যদিকে বিএনপির হাল ধরেছিলেন দলের মরহুম মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও মরহুম ব্রিগেডিয়ার আ স ম হান্নান শাহ। বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান সেই সময় খালেদা জিয়ার পক্ষে সাহসিকতার সঙ্গে মাঠে নামলেও পরবর্তীতে তার কেন দলে জায়গা হয়নি; তা বুঝিনি। আমার মূল্যায়নে ওয়ান-ইলেভেন প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের জনগণ কার্যত দুই নেত্রীর প্রতি আস্থাশীল, জনগণের সমর্থন শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার প্রতিই রয়েছে। দুই দলে যত বড় বড় নেতাই থাকুন না কেন; তারা কার্যত তাদের নির্বাচনী এলাকার দল মনোনীত নেতায় পরিণত হয়ে গেছেন। রাজনীতিবিদরা তাদের নির্বাচনী এলাকার বাইরে মাঠকর্মীদের জন্য কখনো শক্ত অবস্থান না নেওয়ায়, তাদের বাড়ির দরজা সারা দেশের কর্মীদের জন্য খুলে না রাখায় নেতা-কর্মীরা কার্যত শেখ হাসিনার প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে অনড় ও এই অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। দেশের রাজনীতিবিদরা কার্যত কর্মী ও জনবিচ্ছিন্ন হতে হতে মানুষের আস্থা, বিশ্বাস অর্জনের জায়গা থেকে সরে যাওয়ায় দুই নেত্রীর করুণাশ্রিত হয়ে পড়েছেন।

সেই সময় জেলখাটা ও পলাতক সবাই যে বিতর্কিত ছিলেন, অপরাধী ছিলেন; তা নয়। অনেকে সেই শাসকদের রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। তেমনি কারান্তরীণ ও পলাতক অনেক রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা দুই নেত্রীর প্রতি অনুগত। একই সঙ্গে যারা মুক্ত ছিলেন তারা সবাই যে সেনাশাসকদের সঙ্গে আঁতাতের জন্য বা সংস্কারপন্থি হওয়ার কারণে মুক্ত ছিলেন; সেটিও সত্য নয়। এদের অনেকেও ক্লিন ইমেজের ছিলেন। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিলকে অসুস্থ অবস্থায় কারাগারে নিয়ে যে নির্যাতন করা হয়েছিল তা ছিল শেখ হাসিনার প্রতি আনুগত্যের কারণে। এমনি অনেকের নাম বলা যায়।

যে সন্ধ্যায় ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, সেই রাতে সুধা সদনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত দলের নেতাদের বলেছিলেন, এ ঘটনা রাজনীতিবিদদের জন্য শুভ হবে না। পরে তাই হয়েছে। শেখ হাসিনাও অসীম সাহসিকতার সঙ্গে শুরু থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে স্বাগত জানালেও নির্বাচনের দাবি থেকে যেমন সরেননি; তেমনি সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদ করতে ছাড়েননি। মুখ খুলেছেন অহর্নিশ। তাকে যেখানে বাধা দেওয়া হয়েছে, সেখানেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন। দলের কর্মী ও মানুষের প্রতি তার যে আস্থা এবং তা থেকে যে সাহস উৎসারিত হয়েছিল; সেটিই তাকে শক্তি জুগিয়েছে। তিনি একদিকে তার বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতি মামলায় আইনজীবী নিয়োগ করেছেন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন; তেমনি সেখানে বলতে দ্বিধা করেননি- এটি প্রহসনের বিচার। এখানেই তার নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও সাহসের বিজয় সূচিত হয়েছে। কারাবন্দিকালে ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীও তার জন্য সাহসী ভূমিকা রেখেছেন।

যে আন্তর্জাতিক শক্তি ওয়ান-ইলেভেন ঘটিয়েছিল, রাজনৈতিক সহিংসতার সুবাদে চেয়েছিল তাদের মতো সেনাসমর্থিত জাতীয় সরকার গঠন করতে; তারাও দেখেছেন হিসাব করে দুই নেত্রীকে মাইনাস করে সরকার গঠন করা হলে সেখানে জনসমর্থন মিলবে না। অন্যদিকে যাদের নিয়ে জাতীয় সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা তাদের সঙ্গে দলের কর্মীরা নেই। আওয়ামী লীগের সব মাঠ নেতা-কর্মী শেখ হাসিনার প্রতি অবিচল, বিএনপিতেও সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মী খালেদা জিয়ার প্রতি অনুগত। অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাজনীতির ট্রাম্পকার্ড ও বিএনপি জামানায় তাদের অপশাসনের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া জনমতের কারণেই ২০০৮ সালের নির্বাচন শেখ হাসিনার মাথায় বিজয়ের মুকুট তুলে দেয়।

ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরাজয়ের নেপথ্য কারণ তিনটি। ১. তাদের ভ্রান্ত নীতিতে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের গণহারে দমন, নির্যাতন, জনগণের আস্থাশীল দুই নেত্রীকে মাইনাসকরণ। অন্যদিকে এদেশের মানুষের গণতন্ত্রের জন্য যে আকুতি ও ক্রন্দন তার ভাষা শেখ হাসিনা ধারণ করে সাহসী ভূমিকা নিয়েছিলেন বলেই দুই বছরের মাথায় পরাজয়বরণ করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতে হয়েছে। আর সেই নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লবে অভিষিক্ত হন শেখ হাসিনা অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট।

বিএনপিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে যারা পাল্টা কমিটি করেছিলেন সেই কমিটির নেতাদের দলে নেওয়া হলেও তাদের অনুসারী নজির হোসেন, জহির উদ্দিন স্বপনদের কেন নেওয়া হয়নি, তা রহস্যময়। তেমনি শেখ হাসিনার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে যারা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সংস্কারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের দলের মনোনয়ন বোর্ড, সংসদ, মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টামণ্ডলীতে ঠাঁই দিলেও তাদের অনুসারীদের আওয়ামী লীগ করার সুযোগটুকু না দেওয়া রহস্যময়। এদের মধ্যে  অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, মুকুল বোস, মেহেরপুরের অধ্যাপক আবদুল মান্নান, হাবিবুর রহমান খান অন্যতম। সাবের হোসেন চৌধুরী, আবদুল মান্নান, খ ম জাহাঙ্গীর সংসদে এলেও দলের জন্য গৌরবময় অতীত অবদান থাকার পরও রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য ইমেজ থাকলেও সুলতানরা কেন ঠাঁই পাননি— এ প্রশ্ন থেকেই যায়। মাহমুদুর রহমান মান্নার বিষয়টি নাই বা আনলাম। কারণ তিনি নাগরিক ঐক্য করে সরকারবিরোধী প্লাটফর্ম করে কারাদহনও ভোগ করেছেন।

ওয়ান-ইলেভেনের কারা নির্যাতন নিয়ে আওয়ামী লীগের ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও বিএনপির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দালিলিক বই লিখেছেন। সংসদে ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, মরহুম আবদুল জলিল ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম তাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে কুশীলবদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলেছিলেন। কারা নির্যাতিত ওবায়দুল কাদের শুধু বলেছিলেন, রাজনীতিবিদদের জন্য এটি শিক্ষাগ্রহণের পাঠশালা। ওয়ান-ইলেভেনে দেশের ব্যবসায়ীদের কারা নির্যাতন ও দেশান্তরী করে দেশের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবিরই করে দেওয়া হয়নি; বলা হয়েছিল, দেশকে অর্থনীতিতে ২০ বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে রাখা হয়েছিল। একদিকে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে লোকসানের পাল্লা গুনতে হয়েছে, অন্যদিকে তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ১২শ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেন শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে সবাই যার যার প্রাপ্য ফিরে পেলেও ব্যবসায়ীরা তাদের ওপর জুলুম করে নেওয়া এ টাকা ফেরত পাননি। এ নিয়ে সংসদের ভিতরে-বাইরে প্রশ্ন উঠলে সরকার থেকে বলা হয়েছিল, একটা কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে কীভাবে ফেরত দেওয়া যায় তা খতিয়ে দেখা হবে। পরবর্তীতে আবার বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে চলে গেলে সেটি আর ফেরত দেওয়া যায় না। খরচ হয়ে যায়, ফেরত দিতে গেলে অনেক জটিলতা। বাজেটে তার বরাদ্দ দিতে হয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে জোর করে নেওয়া এ টাকা কেন ফেরত পাবেন না?

সবচেয়ে বড় বিষয়, জনগণের গণতন্ত্রের জন্য আর্তনাদের ভিতর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। জনগণের গণতান্ত্রিক আকুতির কারণেই সামরিক শাসনের অবসান ঘটেছে। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার করুণ গ্লানি নিয়ে বিদায় নিয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্রের বিজয় সূচিত হয়েছে। শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে গেছেন। কিন্তু টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত সুশাসন ও গণতন্ত্র।

গণতন্ত্রের নব বসন্তে বাংলাদেশের রাজনীতি পু্ষ্পশোভিত কতটা করবেন— আগামী নির্বাচন ঘিরে সেটিই প্রশ্ন। এখনো সরকারবিরোধী শক্তিশালী রাজনৈতিক দলটির নাম বিএনপি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসুক, অসুবিধা নেই।  কিন্তু একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও সরকারবিরোধীদের সভা-সমাবেশ করার অধিকার কতটা দেওয়া হবে সেটি নিয়েই আলোচনা চলছে। গণতন্ত্রের সংগ্রামের রাজনীতিতে বারবার বিজয়ী নেতৃত্ব শেখ হাসিনার কাছেই মানুষের এ নিয়ে প্রত্যাশা।  কারণ এদেশে যত শাসনই আসুক, মানুষের কাছে সর্বোত্তম গণতান্ত্রিক শাসন।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি নিউজ।

ইমেইল: [email protected]

সর্বশেষ খবর