বুধবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ : শ্রদ্ধাঞ্জলি

কাজী সালাহউদ্দীন

সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ : শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের নাম, ব্যক্তিত্বের প্রভা বিচারালয়ের চার দেয়ালের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রগাঢ় মানবতাবোধসম্পন্ন আলোকিত মানুষ ছিলেন তিনি। যুদ্ধ-উত্তর (১৯৪৩) ব্রিটিশ-ভারতে মানবতার সেবায় আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম সংস্থাটির মাধ্যমে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।  দেশ ভাগের আগে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে দাঙ্গা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনে তিনি অংশ নেন।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে তার ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবি, যা ২১ দফারই সারাংশ হিসেবে ইতিহাসবেত্তাদের কাছে বিবেচিত। ঊনসত্তরের ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে ১১ দফা দাবির প্রতিপাদ্য যে একই সূত্রে গাঁথা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব দাবি প্রণয়নে যার প্রজ্ঞা, মেধা এবং মনন ক্রিয়াশীল ছিল তিনি অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী কমিটি গঠনে তিনি তৎকালীন সরকারের সব বাধা উপেক্ষা করে অগ্রনায়কের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। কবি শামসুর রাহমান এক স্মৃতিচারণে এ প্রসঙ্গে লেখেন : মনে পড়ে সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে স্টেজে তার পাশে বসবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি সভাপতির ভাষণ পাঠ করেছিলেন তার জলদমগ্ন কণ্ঠস্বরে আর আমি পড়েছিলাম রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত একটি কবিতা। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম বিচারপতি মোরশেদের সুলিখিত ভাষণ। সেই ভাষণ ছিল কুিসতের বিরুদ্ধে সুন্দরের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে ঔদার্যের প্রতিবাদ। এখনো মনে পড়ে তার সেই ঋজু দীর্ঘ দণ্ডায়মান মূর্তি, সেই প্রগঢ় উচ্চারণ। মনে হয় এখনো তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে, সেই আলোময় মণ্ডপে ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’।

১৯৬৮ সালে যখন কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান তখন তার কৌঁসুলি স্যার উইলিয়ামসের সবচেয়ে নিকটতম সহকর্মী ছিলেন বিচারপতি মোরশেদ। প্রথম সাক্ষাতে বিচারপতি মোরশেদ টম উইলিয়ামসকে বলেছিলেন, ‘আমি আপনার সহকারী হিসেবে কাজ করে যাব।’ জবাবে টম উইলিয়ামস তাকে বলেছিলেন : ‘একজন প্রধান বিচারপতি সব সময়ের জন্যই প্রধান বিচারপতি। সুতরাং আপনি আমার উপদেষ্টা হিসেবেই কাজ করবেন।’ টম উইলিয়ামস যতদিন ছিলেন ততদিন বিচারপতি মোরশেদকে তিনি প্রধান বিচারপতি বলেই সম্বোধন করতেন। বিচারপতি মোরশেদ সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে কোনো দিন বিচ্ছিন্ন হতে দেননি। তার মেধা এবং প্রজ্ঞার বলে তিনি বিচারকের মনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের মনের সংমিশ্রণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। মানুষের মৌলিক অধিকারকে মূল্য দিতে গিয়ে শাসক গোষ্ঠীর কাতারে না দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়িয়েছিলেন। এ কারণেই প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে জনগণের সম্মান এবং ভালোবাসা তিনি লাভ করেছিলেন। তিনি সেদিন নির্ভীকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এমন নজির তৎকালীন পাকিস্তানে আর কেউ সৃষ্টি করতে পারেননি। এ কারণেই জাতি তাকে অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তার সুচিন্তিত ‘ওয়ান মেন-ওয়ান ভোট’ পদ্ধতিতেই ৩০০ আসনের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ১৬৯টি আসন লাভ করেছিল। বর্তমান সময়ের এই ক্রান্তিকালে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের গৌরবোজ্জ্বল জীবন নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনাসমূহ প্রকাশের ব্যবস্থা অচিরেই নেওয়া প্রয়োজন আমাদের জাতীয় স্বার্থেই। এতে দেশ, জাতি ভীষণভাবে উপকৃত হবে।  আমাদের মনে রাখতে হবে তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস, বাতিঘর। তার প্রতি জানাই অনন্ত শ্রদ্ধা।

লেখক :  কবি, সচিব, বিচারপতি মোরশেদ স্মৃতি কমিটি।

সর্বশেষ খবর