শনিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

অসামান্য ক্ষতি

লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.)

অসামান্য ক্ষতি

‘সামান্য ক্ষতি’ রবিঠাকুরের একটি কবিতার নাম। রানী তার পরিচারিকাদের নিয়ে প্রমোদ ভ্রমণে বেরিয়েছেন। দিনভর আনন্দ করেছেন। গ্রামে ঘুরেছেন। নদীতে সাঁতার কেটেছেন। জলকেলি করেছেন। ফেরার পথে ঝমঝম বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টিতে ভিজে রানী শীতার্ত হয়েছেন। রানীর কষ্ট হচ্ছে। তিনি শীতকষ্ট লাঘবে কাছের গ্রামের গরিব মানুষদের কুঁড়েঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে বললেন। আগুনের লেলিহান শিখায় পুরো গ্রাম ভস্মীভূত হয়ে গেল। রাজা ঘটনা জেনে রানীকে প্রশ্ন করলেন। রানী বলেন, মাত্র কয়েকটা কুঁড়েঘরই তো পুড়েছে। এ কী আর এমন। এ সামান্য ক্ষতি।

গুলশান ১ নম্বরের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মার্কেট অতিসম্প্রতি আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। অগ্নিকাণ্ড প্রচণ্ড ব্যাপকতা পেয়েছিল। দীর্ঘ ২০ ঘণ্টা দমকল বাহিনী যুদ্ধ করে আগুন নেভাতে পারেনি। দমকল বাহিনীর অক্ষমতা এ অগ্নিকাণ্ডে নগ্নভাবে বেরিয়ে আসে। তারা আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে মোটেও সজ্জিত নয়। দমকল বাহিনীর জন্য এটি একটি বড় ধরনের লেসন বলে আমি মনে করি। আধুনিক সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির সঙ্গে আধুনিক প্রশিক্ষণেরও বিশাল অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। এর আগে ঢাকার মতো বিশাল মহানগরীতে আমরা বার বার অগ্নিকাণ্ড হতে দেখেছি এবং দমকল বাহিনীর যথাযথ প্রস্তুতি, দক্ষতা ও তত্পরতার অভাবে প্রাণহানিসহ বিপুল ক্ষয়ক্ষতি প্রত্যক্ষ করেছি। দমকল বাহিনীর ব্যর্থতার নগ্ন পরস্ফুিটন বাহিনীর আধুনিকায়নে সরকারের প্রচেষ্টায় গতি আনতে পারেনি। তা অতীতের মতো এখনো চরম মন্থরই থেকে গেছে। সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। আরও কত বড় অগ্নিকাণ্ড সরকারের চেতনাকে জাগ্রত করবে জানি না।

রবিঠাকুরের কবিতায় ‘সামান্য ক্ষতি’ রাজমহিষীর চোখে হয়তো কয়েকটি কুঁড়েঘর মাত্র। আর কিছু নয়। কিন্তু যাদের গেছে তাদের  তো সবকিছু পুড়ে অঙ্গার— ঘর, ঘরের মালামাল, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, সর্বস্ব। রাজা দয়ালু। রাজা প্রজাবৎসল। রাজা ন্যায়পরায়ণ। তিনি রাজমহিষীর আচরণে ও সামান্য ক্ষতির ব্যাখ্যায় প্রচণ্ড রাগান্বিত হন। প্রাসাদ থেকে তাকে বের করে দেন। প্রতিটি ভস্মীভূত পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়ে রানীর কথার ‘সামান্য ক্ষতি’ পূরণের আদেশ দেন এবং একমাত্র ক্ষতিপূরণ শেষে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করতে বলেন।

 

 

ডিএনসিসি মার্কেট নিয়ে বহুদিন ধরে বহু রকমের আলোচনা ছিল। বেশ কয়েক বছর ধরে এ মার্কেট ভেঙে বহুতল বাণিজ্য কেন্দ্র  (ট্রেড সেন্টার) নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল কর্তৃপক্ষের। এজন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দফায় দফায় চুক্তিও সম্পাদিত হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগে কাজের গতি থেমে গিয়েছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রেস বিজ্ঞতিতে চুক্তিটি অনেক আগে হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সংশয় ছিল। চুক্তি কার্যকরের মেয়াদও পার হয়ে গিয়েছিল। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অনেক মামলা চলছিল। মার্কেটের জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের বিষয়ে আমলাতান্ত্রিক ও আইনি জটিলতা ছিল।

গুলশান মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তাদের উচ্ছেদ করার জন্যই নাশকতামূলক আগুন লাগানো হয়েছে। গুলশান কাঁচা মার্কেটের সভাপতি বলেছেন, কয়েক দিন আগেও ব্যবসায়ীদের সিটি করপোরেশনে ডাকা হয়েছিল। নতুন মার্কেটে বর্তমান ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা নিরাশ হয়ে চলে আসেন। এ আগুন তাই তাদের মতে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদে ষড়যন্ত্রের একটা অংশ। সংবাদকর্মী, মিডিয়া ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের সবার একই ধারণা— এটি নিশ্চিত নাশকতা।

এ বিষয়ে যথাযথ বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া অতীব প্রয়োজন। বিষয়টি যদি নাশকতা হয় তাহলে সেটি গভীর উদ্বেগ ও চরম দুঃখজনক। নাশকতার বিষয়টি ডাহা মিথ্যা, নিছক বাজে কথা বলে উড়িয়ে দেওয়া সমীচীন হবে না বলে অনেকে মনে করেন। নিশুতি রাতে প্রজ্বলিত হয় এ আগুন। দমকল বাহিনীর ২৩টি ইউনিট যথাসাধ্য চেষ্টা করেও আগুন আয়ত্তে আনতে ব্যর্থ হয়। বিষয়টি মানুষের মনে গভীর সংশয়ের সৃষ্টি করেছে। সন্দেহ দানা বেঁধেছে।

গুলশান মার্কেটের আগুন নিয়ে কালের কণ্ঠে ৬ জানুয়ারি, ২০১৭-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ পড়ছিলাম। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত এমন একজন মানুষ কুমিল্লার জোছনা আরা বেগম। তার তিন ছেলেরই গুলশান মার্কেটে দোকান আছে। মঙ্গলবার ভোরে আগুনের কথা শুনে বৃদ্ধ জোছনা আরা কুমিল্লা থেকে ছুটে আসেন গুলশানে। চোখের সামনে ছেলেদের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ধ্বংস হতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘দেশের সব জায়গা-জমি বিক্রি করে পোলাগো দিছিলাম। এখন  তো আমার সব শেষ হয়ে গেল। গ্রামেও কিছু থাকল না। এখানেও কিছু রইল না। ছিলাম কোটিপতি এখন পথের ফকির।’ তিনি তার নাতি-নাতনিদের জড়িয়ে ধরে শুধুই আর্তনাদ করছিলেন।

গুলশান কাঁচা মার্কেটে আগুন লাগার কয়েক দিন পরও ধ্বংস্তূপের ভিতর থেকে অনবরত ধোঁয়া বেরিয়েছে। ধ্বংসস্তূপের গভীরে পানি নিক্ষেপ করে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন দমকল কর্মীরা। আগুন লাগার কয়েক দিন পরেও ধ্বংসস্তূপ থেকে ধোঁয়া বের হওয়া অগ্নিকাণ্ডের গভীর ভয়াবহতাকেই ইঙ্গিত করে। বুলডোজার ব্যবহার করে দমকল বাহিনী ধ্বংসস্তূপের অংশবিশেষ ও আবর্জনা সরিয়ে ফেলার কাজ করছে। মার্কেটের ভস্মীভূত দোকান মালিকরা তাদের দোকানের তছনছ হয়ে যাওয়ার অন্তিম দৃশ্য দেখছেন।

গুলশান ১ ডিএনসিসি মার্কেটের পুড়ে ধ্বংস হওয়া অংশটি অভিজাত, চোখ-ধাঁধানো, বাতি ঝলসানো, হাইফাই মার্কেট ছিল না। দোকানের মালিকরা স্যুটেট-ব্যুটেট, অত আধুনিক ছিলেন না। কিন্তু এই মার্কেটটি সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাবার-দাবার, কাঁচাবাজার সরবরাহ এরাই করতেন। ঢাকা মহানগরীর এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ এরাই সরবরাহ করতেন।

গুলশান মার্কেট ঘিরে এখনো চারপাশে শুধু পোড়া গন্ধ, মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার আর কান্না। চোখের সামনে জীবনের শেষ সম্বল পুড়ে ছাই হতে দেখলে যে কারও পক্ষে সহ্য করা দুঃসহ। নিছক দুর্ঘটনা হলে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু কাজটা যদি নাশকতা হয় এ অমার্জনীয় অপরাধ। কখনই মেনে নেওয়া যায় না। যথাযথ নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। গরিব-নিঃস্ব দোকান মালিকদের ক্ষতিপূরণও একান্ত প্রয়োজন।

লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর