শনিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

তিতির পালনে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা

শাইখ সিরাজ

তিতির পালনে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা

বাংলাদেশের কোনো মানুষের কাছেই তিতির অচেনা নয়। কিন্তু ইদানীং আর এ পাখিটি দেখা যায় না। মাংস ও ডিমের চাহিদা পূরণে ব্যাপক ভিত্তিতে পোলট্রি খামার গড়ে উঠতে শুরু করায় শৌখিন এ পাখিটি পালনের রেওয়াজ এখন আর নেই বললেই চলে। মধ্যযুগে আফ্রিকায় এ পাখিটি গৃহপালিত হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে। পরে মাংস ও ডিমের চাহিদা ছাড়াও সৌন্দর্যের কারণে পাখিটি ইউরোপীয়দের আকৃষ্ট করে। প্রাকৃতিক পরিবেশ অথবা খাঁচা দুই ভাবেই মানুষের কাছাকাছি এ পাখিটি লালন-পালনে বেশ সুবিধা থাকায় এটি দ্রুতই ছড়িয়ে যায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে। ৩০০ বছর আগে ঔপনিবেশিক শাসকদের মাধ্যমে এ পাখিটি বাসস্থান গড়ে এ উপমহাদেশে। একসময় সে সঙ্গী হয়ে ওঠে আমাদের দেশি মোরগ-মুরগির। গ্রামীণ পরিবেশ ও জলবায়ুর সঙ্গে দারুণ খাপ খাইয়ে চলতে শুরু করলেও বাণিজ্যিক পোলট্রির যুগে এ পাখিটি সমান গুরুত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারেনি। সম্প্রতি সময়ের প্রয়োজনেই বাণিজ্যিকভাবে তিতির পালন হতে পারে। এর ব্যাপক সম্ভাবনা উদ্ঘাটন করেছেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সুবাসচন্দ্র দাস বাণিজ্যিকভাবে তিতির লালন-পালন নিয়ে ছোট একটি গবেষণা পরিচালনা করছেন ৬ বছর ধরে। তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই একটি বিষয়ে জানলাম গিনি ফাউল বা তিতির পালনকারীদের একটি আন্তর্জাতিক সমাজও গড়ে উঠেছে এরই মধ্যে। ভারতের তামিলনাড়ুতেও বেশকিছু খামার রয়েছে তিতিরের। আমাদের দেশে এখনো এ পাখির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আফ্রিকায় জন্ম হলেও এটা ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ উপনিবেশের মাধ্যমে আমেরিকা, ইউরোপে ছড়িয়ে যায়। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এ দেশে ব্রিটিশের আধিপত্য বিস্তারের সময় তিতির মুরগি আসে; যা স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেখা গেলেও পরে প্রায় বিলীন হয়ে যায়। বাংলাদেশে উত্তরবঙ্গের অনেক জেলা, অন্যদিকে মাদারীপুর, সিলেট, ফরিদপুরে তিতির পাখির চাষ চলছে। তবে পোষা পাখি হিসেবেই লালন-পালন হচ্ছে বেশি। ড. সুবাসের মতে ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে জাত উন্নয়ন করতে পারলে এর উৎপাদন ও সম্প্রসারণ বাড়ানো সম্ভব। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রিবিজ্ঞান অনুষদের ভিতরে পুরনো একটি শেডে স্থান পেয়েছে সম্ভাবনাময় এ তিতির। শেডটিতে গিয়ে দেখলাম ১ বছর বয়সী ২০০ তিতির আছে। আছে কিছু প্যারেন্টস স্টক। ২ দিন বয়সী বাচ্চা থেকে শুরু করে ১ মাস বয়সী বাচ্চা।

 

 

স্থানীয় পর্যায়ে খামারিদের মাঝে বাচ্চা বিতরণের কাজটিও হচ্ছে এখান থেকে; যাতে তিতির পাখির চাষ সম্প্রসারিত হতে পারে। তিতির পালনে বিভিন্নমুখী বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে এ খামারে। যে বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমাদের দেশি মোরগ-মুরগির তুলনায় বাণিজ্যিক লাভ, বেশি মাংস ও ডিম উৎপাদনের বিষয়টি। ৬ মাসের মধ্যে তিতিরের ওজন হয় ১৪০০ থেকে ১৫০০ গ্রাম। আমাদের দেশি মোরগ-মুরগির চেয়ে ওজন হয় দেড় গুণ বেশি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তিতিরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ফার্মের মুরগির থেকে অনেক বেশি। যেভাবে অতীতে আমরা দেখতাম গৃহস্থ বাড়ির মুরগি ছেড়ে দিয়ে পালছেন। খড়কুটা খেয়ে বড় হচ্ছে। তিতিরের ক্ষেত্রেও তাই। সাদামাঠা খাওয়া খাওয়ালেও এর বৃদ্ধি হবে। তবে খামার করতে গেলে খাওয়া-খাদ্যের হিসাবটা নিশ্চয়ই অন্য রকম হবে। অন্যদিকে তিতিরের মাংস যথেষ্ট ভালোমানের ও সুস্বাদু। ঝুট-ঝামেলাহীনভাবে লালন-পালন করা যায় তিতির। পাঠক! এ কথাগুলো বলার কারণ হলো পোলট্রিশিল্পে আমরা প্রায়ই ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখি। সে ক্ষেত্রে এই সময় অনুভব করছি আমাদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যগুলো ফিরিয়ে আনার বিষয়। রোগব্যাধি পোলট্রিতে এত বেশি বাড়ছে যে, এসব ক্ষেত্রে তিতির পাখির বাণিজ্যিক আবাদ করতে পারলে কিছুটা হলেও সংকট কাটবে। কারণ তিতিরের কোনো রোগবালাই নেই বললেই চলে। কথাগুলো আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। ছোটবেলা নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে বন-বাদাড়ে অসংখ্য তিতির দেখেছি, যেগুলোকে সে সময় আমরা ‘চীনা মুরগি’ বলে ডাকতাম। দেখেছি পাখিটি তার নিজের ডিম লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখত। আমরা খুঁজে পেতাম না। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটলেও মা তিতির সেভাবে বাচ্চাদের নিরাপত্তা দিত না। নানী বলতেন, এগুলোর জান বড় শক্ত। আরও দেখেছিলাম মুন্সীগঞ্জ অঞ্চলে ‘গলাছিলা মুরগি’। এ-জাতীয় পাখিগুলো যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। দেশি মুুরগি যেখানে বছরে ৫০-৬০টি ডিম দেয় সেখানে তিতির দেবে ১২০ থেকে ১৩০টি। আমাদের লেয়ার মুরগি বছরে ২৮০ থেকে ৩০০টি ডিম দেয়। বলে রাখা ভালো, বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট, সবকিছু মিলিয়েই অধিক ডিম ও মাংস উৎপাদনের প্রয়োজনে ১৯৮০ ও ’৯০-এর দশকে প্রচুর মোরগ-মুরগির বাণিজ্যিক লেয়ার ও ব্রয়লার পালন কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে তিতির কেউ কেউ হয়তো পালছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চলছে গবেষণা। এগুলো সবই আশার কথা। হয়তো বা এ তিতিরই একসময় বাণিজ্যিক মোরগ-মুরগি পালনের জায়গাটি দখল করে নেবে।

এখানে পাশাপাশি শেডগুলোয় তিতিরের বিভিন্ন বয়সী বাচ্চা রয়েছে। যা দেখে সহজেই তিতিরের জীবনচক্র, জন্ম-মৃত্যুহার ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। লেগ প্যারালাইসিস নামে একটি রোগের সন্ধান অবশ্য মিলেছে। তবে এ রোগের কারণ অনুসন্ধান নিয়ে গবেষণা চলছে। প্রতি ১০০ বাচ্চার মধ্যে ৪-৫টির এ রোগ হয়। অনেক ক্ষেত্রে লেগ প্যারালাইসিস রোগে বাচ্চা মারা যায়। তিতির পালনের ক্ষেত্রে সমস্যা নেই বললেই চলে। তার পরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদনের হার বা ঐধঃপযধনরষরঃু জধঃব কম। ১০০ ডিম থেকে অন্তত ৭৫টি বাচ্চা পাওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যায় ৩০% ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে না। যদিও গবেষণা বলছে ৭৫% বাচ্চা পাওয়ার কথা। এর কারণ কী, তা এখনো গবেষণাধীন। পরিমিত খাওয়া, সঠিক তাপমাত্রায় তিতির লালন-পালন করলে বাচ্চা উৎপাদনের হার বাড়বে বলে মনে করেন গবেষকরা। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, তিতিরের বাচ্চা উৎপাদনের ডিম বা ঐধঃপযরহম ঊমম আমাদের দেশি মুরগির ডিমের চেয়ে বেশি ওজন ও পুরুত্বের। দেশি মুরগির ডিমের ওজন যেখানে ৩৫ থেকে ৩৮ গ্রাম সেখানে তিতিরের ডিমের ওজন ৪০ থেকে ৪২ গ্রাম। তিতিরের ডিমের খোসার পুরুত্ব দেশি মুরগি ও হাঁসের তুলনায় দেড় গুণ বেশি। এতে ডিম ভাঙার প্রবণতা কম। সব মিলিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তিতির পালনের বিষয়টি জানান দিচ্ছে নতুন সম্ভাবনা। একদিকে সৌন্দর্য অন্যদিকে সবচেয়ে পুষ্টিমাণসম্পন্ন মাংসের উৎস— এ দুই গুরুত্ব মাথায় রেখেই তিতির পালন হতে পারে বেশ লাভজনক। ড. সুবাসচন্দ্র দাস প্রকল্পটির সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে বলছেন, তিতির পালন প্রকল্পটি আকারে খুবই ছোট। তিনি চাইছেন সরকারি বা বেসরকারি কিংবা বিদেশি কোনো সহায়তায় যাতে এর ফাউন্ডেশন স্টকটি ধরে রাখা যায় যা ভবিষ্যতে তিতির সম্প্রসারণে বিরাট অবদান রাখবে। তিনি মনে করেন, এ শেডে ২ থেকে ৩ হাজার প্যারেন্ট স্টক রাখতে পারলে কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ আরও দ্রুত হবে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ও খামারের নিকটতম ময়মনসিংহ সদরের দাপুনিয়া বাজার এলাকায় ইব্রাহিম খলিলের তিতিরের খামার। সেখানে গিয়ে দেখলাম তরুণ ব্যবসায়ী ইব্রাহিমের খামারে রয়েছে ২০০ পাখি। এর মধ্যে ১৫০টি তিতির ও ৫০টি টার্কি। তার হিসাবে কক ও পোলট্রি পালনের চেয়ে তিতির পালন অনেক বেশি লাভজনক। ইব্রাহিম ১৫০টি তিতির এনেছেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রিবিজ্ঞান অনুষদ থেকে। তিনি জানালেন, বাড়ির আশপাশে এমন কোনো গাছ, লতাপাতা নেই যা তিতির খায় না। এর মানে দাঁড়ায়, প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে তিতির বড় হতে পারে। তবে ধান খেতে পছন্দ করে তিতির পাখি। ইব্রাহিমের খামারে ১ দিনে ৬ কেজি ধান খাচ্ছে ২০০ তিতির, যার বাজারমূল্য ১০০ টাকা। পোলট্রি মুরগি হলে সমপরিমাণ মুরগির পেছনে খাদ্য খরচ পড়ত কমপক্ষে ৪০০ টাকা। সেখানে মাত্র ১০০ টাকায় ২০০ তিতিরের খাওয়ার খরচ মিটছে। পোলট্রি পালনে খাদ্যের মূল্য যেখানে গুরুত্বপূর্ণ সংকট, সেখানে তিতিরের এ খাদ্য খরচ নিঃসন্দেহে উৎসাহ জাগানিয়া।

প্রিয় পাঠক! অনেক দিক বিবেচনায় তিতির পালন আগামী দিনের লাভজনক এক কৃষি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। কারণ, পোলট্রি খাদ্যের মান ও উপাদান নিয়ে মাংস ও ডিমের ভোক্তাদের মধ্যে নানা সংশয় দেখা দিচ্ছে। প্রাকৃতিক খাবারে অভ্যস্ত পাখির প্রতি এখন আকর্ষণ স্বাভাবিকভাবেই বেশি। তিতির পালন নিয়ে আরও কার্যকর গবেষণা, ১ দিনের বাচ্চা উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের জন্য দেশি-বিদেশি সহায়তায় আরও দীর্ঘ ও ব্যাপক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়ার উপযোগিতা রয়েছে। বিষয়টি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বিবেচনায় নেবে এমনটাই বিশ্বাস রাখি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

সর্বশেষ খবর