শনিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিজেপিতে যেতে মমতার আপত্তি নেই

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বিজেপিতে যেতে মমতার আপত্তি নেই

জ্ঞান-বুদ্ধি, মেধা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজেকে ‘নম্বর ওয়ান’ মনে করেন। সে দাবি তিনি করেও থাকেন। তিনি একাধারে রাজনীতিক, কবি, সাহিত্যিক, ভাষাবিদ, সংগীতকার, চিত্রশিল্পী— কী নন! অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র ভাই মোদিও কম না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি বলে থাকেন কতটা মেধা এবং রাজনৈতিক বোধ থাকলে একজন চা বিক্রেতা থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায়। যা তিনি হয়েছেন। এখানে পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার সম্প্রতি কী কী মণিমুক্তা তিনি চারপাশে ছড়িয়েছেন। তিনি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার একটু ‘সফট কর্নার’ রয়েছে। আরেকবার বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজিকে ফলের রস খাইয়ে অনশন ভঙ্গ করিয়েছেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ মারা যান ১৯৪১ সালে। আর ওই অনশন হয় ১৯৪৭ সালে কলকাতার দাঙ্গার সময়। একবার বলেছিলেন, ডহরবাবু কোথায়। একটা অনুষ্ঠানে সাঁওতাল কবির সিধো-কানোর কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি ওই ডহরবাবুর নাম করেন। কলকাতায় একটি রাস্তার নাম সিধো কানহো ডহর। সাঁওতাল ভাষায় ডহর শব্দের অর্থ পথ বা রাস্তা। সেই ডহরকেই তিনি ডহরবাবু বলে খুঁজছিলেন।

সম্প্রতি তিনি ‘জাতীয় সরকার’ নিয়ে মাতামাতি শুরু করেছেন। এর অর্থ হলো সব কটি দলকে নিয়ে (বিজেপিসহ) একটি জাতীয় সরকার তৈরি করা। সেখানে নরেন্দ্র মোদি থাকবেন না, কিন্তু লালকৃষ্ণ আদভানিসহ বিজেপির বাকি নেতারা থাকবেন। তার এ উক্তির পর অবিজেপি সব রাজনৈতিক দল একই সুরে বলেছে, দিদি একটু জ্ঞানটা বাড়ান। আপনি কি সংবিধান পড়েছেন? যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কি জাতীয় সরকার সম্ভব? যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বলতে আপনি কী বোঝেন? এ ব্যাপারে সংবিধানে কী লেখা আছে তা তিনি পড়েননি। কারণ অত পড়ার সময় তার নেই। তিনি এখন ব্যস্ত চিটফান্ড কাণ্ডে ধরা পড়া সংসদ সদস্যদের ছাড়ানোয়। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে ১০-১২ বছর গোটা পশ্চিমবঙ্গের অলিগলিতে পোস্টার দিতেন সততার প্রতীক মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু গত সাড়ে পাঁচ বছরে তিনি নিজে, তার পরিবার ও দলের দুর্নীতি ভারত ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বে পৌঁছে গেছে। দুর্নীতির বাইরে তিনি কিছু ভাবতে পারেন না। এই দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসে যাওয়ায় এখন তিনি বিষোদগার শুরু করেছেন তদন্তকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে। মমতা, তার পরিবার এবং গোটা দলের যোগসাজশ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি।

মোদি ক্ষমতায় এসেই পুরনো সম্পর্কের জেরে সেই তদন্ত চাপা দিয়েছিলেন। নভেম্বরের ৮ তারিখে নোটবন্দীর পরই একদিকে যেমন আড়াই বছর ঘুমিয়ে থাকার পর জেগে উঠেছে, তাতেই রাতের ঘুম উড়ে গেছে মমতার। বিভিন্ন চিটফান্ড ও অন্যান্য বিশেষ বিশেষ দেশ থেকে যে ধন সংগ্রহ করেছিলেন, সেই অর্থে টান পড়েছে। এ বিপুল টাকা তিনি জোগাড় করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লক্ষ্যে। তাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নভঙ্গ হওয়াতেই জনসভাগুলোয় তিনি যে ভাষা প্রয়োগ করছেন, তা বাংলা বা রবীন্দ্রনাথের ভাষা নয়। তা ছাপার অক্ষরে লেখা যায় না। তিনি এখনো মনে করেন, একদা ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও বন্ধু নরেন্দ্র মোদি নোটবন্দী প্রত্যাহার করে নেবেন। মমতা দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে টুঁ-শব্দটিও করছেন না। কেন করছেন না? তিনি নিজে ফেঁসে যাবেন বলে? জনসভায় দাঁড়িয়ে তার পুত্রতুল্য অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে বলেছেন, সিবিআই তাকে গ্রেফতার করবে। তিনি কী করে জানলেন তা অবশ্য বলছেন না।

দিল্লির এক বিজেপি নেতা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, মমতা যতই চিৎকার করুন না কেন, তার আসল উদ্দেশ্য কোনো দিনই সফল হবে না। বিরোধী দলগুলো যখন কংগ্রেসের ছাতার তলায় এসে মোদিবিরোধী আন্দোলন করছে, ততই তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে জোট ভাঙার চেষ্টা করছেন নানা কৌশলে।

তাই হঠাৎ তিনি বলেছেন, নরেন্দ্র মোদিকে বাদ দিয়ে বিজেপির নেতৃত্বে সরকারে আপত্তি নেই তার। অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদি যদি চলে যান, তাহলে এলডিএ সরকারকে সমর্থন করতে আপত্তি নেই তার। বস্তুত মমতার এ বক্তব্যকেই হাতিয়ার করে আক্রমণ শানিয়েছে বামপন্থিরা ও কংগ্রেস। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মন কষাকষি চলছিল বলেই এত চিৎকার করছিলেন তিনি। এর থেকে প্রমাণ হয়, যে কোনো দিন বিজেপির সঙ্গেই ফের হাত মেলাবেন তিনি। আসলে বিজেপিকে বার্তা দিতেই এ মন্তব্য করেছেন মমতা। এক সপ্তাহ ধরে তৃণমূলের বাকি নেতারা দিল্লিতে পড়ে রয়েছেন। একের পর এক বিজেপি মন্ত্রীর কাছে তদবির করছেন তারা। যাতে জেলবন্দী সংসদ সদস্যদের ছাড়িয়ে আনা যায়।

এর আগে সারদা কেলেঙ্কারির সময় এ দৌত্য করেছিলেন মুকুল রায়। কলকাতা হাই কোর্ট সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছে, সারদা মামলায়ও অদূর ভবিষ্যতে সিবিআই তদন্ত হতে পারে। তার পরই দিল্লির সঙ্গে বার্তা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। সম্প্রতি রাহুল সিনহা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলেছেন, নোট বাতিলের পর চিটফান্ডের সব টাকা নষ্ট হতে বসেছে। তাই তিনি উত্তেজিত হয়ে আছেন।

মমতা জাতীয় সরকার প্রসঙ্গে তিন বিজেপি নেতার নাম করেছেন— লালকৃষ্ণ আদভানি, রাজনাথ সিং ও অরুণ জেটলি। উল্লেখ্য, এরা সবাই মমতার প্রতি নরম। রাজনাথ মনে করেন, মমতাকে চটিয়ে কোনো লাভ নেই। বরং তাকে হাতে রাখা ভালো। অরুণ জেটলির সঙ্গে মমতার সম্পর্কও সর্বজনবিদিত। আর লালকৃষ্ণ আদভানি তো মমতাকে মেয়ের মতো দেখেন। মমতা বলেছেন, ওরা চালাক না দুই বছর। অসুবিধার কী? ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট আসুক। তাতে যদি লালকৃষ্ণ আদভানিজি দায়িত্ব নেন, আমার আপত্তির কিছু নেই। অথবা প্রেসিডেনশিয়াল ফর্ম অব গভর্নমেন্ট হোক। আমার তাতেও আপত্তি নেই। আমি বলছি না সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার ভেঙে দিতে। আমি তো কেন্দ্রে রাষ্ট্রপতি শাসন চাইতেই পারতাম।

নরেন্দ্র মোদিকে তীব্র ব্যঙ্গ করে তিনি বলেছেন, বর্তমানে যিনি বসে আছেন তিনি মহাকবি কালিদাস। যে ডালে বসে আছেন, সে ডালটাই কাটছেন। সব রাজনৈতিক দলকে বলছি, ভুলে যান কে কোন রাজনৈতিক পার্টি করেন। কমন মিনিমাম এজেন্ডার ভিত্তিতে আমরা জাতীয় সরকার গড়ে তুলি।

লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর