শিরোনাম
সোমবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

মোনাজাতের প্রভাব যেন মুছে না যায়

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মোনাজাতের প্রভাব যেন মুছে না যায়

আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। আগামী শুক্রবার শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। এরপর আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এক বছরের জন্য পর্দা নামবে বিশ্ব ইজতেমার। তুরাগ তীরে ইজতেমা প্রেমিকদের আনাগোনা কমতে থাকবে ক্রমান্বয়ে। ১৩ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ইজতেমার পর্দা ওঠলেও ইজতেমা মাঠে প্রেমিক মুসল্লিদের পদচারণা শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই। তিন মাস আগ থেকেই মাঠ সাজানোর জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ইজতেমার মতো বিশ্ব সম্মেলনের জন্য নেই কোনো চাঁদা কালেকশন কিংবা মাইকিং-পোস্টার। প্রেমিকদের স্বপ্রণোদিতদানেই গড়ে ওঠে তিন দিনের কালেমার বাগান। ইজতেমা শেষে আবার সবাই যার যার বাঁশ, খুঁটি, চট-চালা নিয়ে যায়। এভাবেই চলে আসছে ইজতেমা আয়োজন। তিন দিনের ইজতেমায় আম বয়ান ও খাস বয়ানে জীবন চলার পাথেয় স্বরূপ অনেক দিকনির্দেশনা দেন মুরব্বিরা। বয়ান ছাড়াও ইসলামী জিন্দেগির বাস্তব প্রশিক্ষণ পাওয়া যায় জামাতের আমির এবং অন্য সদস্যদের থেকে। দুঃখজনক হলেও সত্য! ইজতেমার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইজতেমার মাঠেই পড়ে থাকে, বাস্তব জীবনে আর প্রয়োগ হয় না। শুধু ইজতেমাই নয়, ওয়াজ-মাহফিল দারসুল কোরআন, দারসুল হাদিস, যাই বলি না কেন সব কিছু এখন অনুষ্ঠানসর্বস্ব হয়ে পড়েছে। অথচ রসুল (সা.)-এর সময় এত আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। ছিল প্রাণের ছোঁয়া। মিসরের অন্যতম আলেম সাইয়েদ কুতুব শহীদ ‘মাআলেম ফিত তারিক’ গ্রন্থে লেখেন- ‘আমাদের এবং সাহাবিদের মধ্যে পার্থক্য হলো তাদের সামনে রসুল (সা.)-এর দেহসত্তা বিরাজমান ছিল, আমাদের সামনে নেই। তাছাড়া সাহাবিদের মাঝেও কোরআন ছিল, রসুলের আদর্শ ছিল; আমাদের মাঝেও তাই আছে। প্রশ্ন হলো, শুধুমাত্র একটি দেহসত্তার উপস্থিত থাকার কারণেই কী সাহাবিরা এত মর্যাদাবান মানুষ হতে পেরেছেন? অর্থাৎ সাহাবিদের মতো নির্মল মানুষ হওয়ার জন্য কী ‘মুহাম্মাদ’ নামক মানুষটির দেহসত্তা সামনে থাকা শর্ত? উত্তর হলো, না। বরং সাহাবিরা তিনটি কারণে  এমন সোনার মানুষ হতে পেরেছেন। তার মধ্যে প্রধান কারণ হলো- তারা যে হেদায়াত পেয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে তাই জীবনে ধারণ করেছেন। একটি উদাহরণ দিই। আরবের প্রিয় পানীয় ছিল মদ। আল্লাহপাক ঘোষণা করলেন, মদ নিষিদ্ধ করা হলো। এ হেদায়াত জানানোর জন্য কোনো ইজতেমা বা মাহফিলের আয়োজন করা হয়নি। বরং রসুল (সা.)-এর নির্দেশে একজন ঘোষক রাস্তায়-রাস্তায়, অলিতে-গলিতে, হাটবাজারে ঘোষণা করে দিলেন- ‘মদের ব্যাপারে আয়াত নাজিল হয়েছে। মদ হারাম।’ ব্যস এতেই যথেষ্ট। যার কানেই এ ঘোষণা গেছে সেই সঙ্গে সঙ্গে এ নির্দেশ মানার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে। কেউ মদ পানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, সে পানের ইচ্ছা ছেড়ে দিল। কেউ পানপাত্র ঠোঁটের কাছে নিয়েছে, ঘোষণা শুনে ফিরিয়ে আনল। আবার কেউ মদ মুখে নিয়েছে, গিলার আগেই তা কুলি করে ফেলে দিল। যার ঘরে যত মদের বোতল ছিল, মটকা ছিল, ড্রাম ছিল সব মদিনার রাস্তায় ফেলে দিল। কিতাবে লেখা রয়েছে, সেদিন এত বেশি মদ রাস্তায় পড়েছে যে, নতুন কেউ দেখলে ভাবত, এটা বুঝি মদের নদী বা মদের শহর। বলছিলাম, ইসলামের কোনো নির্দেশ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। কী ইজতেমা, কী ওয়াজ, কী দারসুল কোরআন, কী দারসুল হাদিস যেখানেই কোরআনের যে শিক্ষা ও নির্দেশ পাব সঙ্গে সঙ্গে তা বাস্তবায়ন করতে হবে জীবনে। তাবলিগের মুরব্বিরা সব সময় একটি কথা বলেন- ‘ভাই আমলের নিয়তে শুনি’। আসল কথা হলো নিয়ত পরিশুদ্ধ করতে হবে। আমরা এখন ইজতেমায় যাই সওয়াবের নিয়তে। মাহফিল শুনি সওয়াবের নিয়তে। সুতরাং এসব জায়গা থেকে সওয়াব ছাড়া আমরা আর কিছু নিয়েই বাড়ি ফিরতে পারি না। কিন্তু সাহাবিরাও কি সওয়াবের নিয়তেই কোরআন পড়তেন? না বরং তাদের নিয়ত ছিল আমলের। ধর্ম কর্মের সওয়াব তো আমলের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই আসুন! ইজতেমার শিক্ষাকে জীবনে ধারণ করি। এ মাঠে যেভাবে একজন আরেকজনের সহযোগিতায় সচেষ্ট ছিলাম, সমাজে এসেও এ আমলের চর্চা করতে হবে। হে আল্লাহ! আপনার কাছে তাওফিক চাচ্ছি। আমাদের তাওফিক দিন। আমরা যেন আমলকারী সাহাবিদের মতো হতে পারি। ইমান এবং আমলে নিজেকে গড়ে তুলতে পারি।

লেখক : মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

            ww.selimazadi.com

 

সর্বশেষ খবর