মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

জনগণের নেতা কমরেড অমল সেন

ফজলে হোসেন বাদশা

জনগণের নেতা কমরেড অমল সেন

কমরেড অমল সেনকে আমি যখন প্রথম দেখলাম সেই স্মৃতি আজ মনে পড়ছে। অনেক নেতার নামই তো আমরা জানতে পারি, কিন্তু কীভাবে নেতাকে চেনা যায়, জানা যায় তাই বলব। এ রকমই এক চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। আমি সবে ছাত্র রাজনীতি ছেড়েছি, সম্ভবত আশির দশকে ঝিনাইদহের একটি স্কুলের ক্লাসরুমে তখনকার কমিউনিস্ট লীগের একটি কর্মিসভায় অতিথির ভাষণ দিতে এসেছিলেন কমরেড অমল সেন। আমরা পৃথক পার্টিতে থাকলেও তিনি আমাদের পার্টির কর্মিসভায় বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেদিনই আমরা প্রথম কমরেড অমল সেনকে রাজনৈতিকভাবে, মতাদর্শগতভাবে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলাম। সেদিন আমার মনে হয়েছিল, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ গঠনের আগে কিংবা ওয়ার্কার্স পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আগেই কমরেড অমল সেন আমাদের, কমিউনিস্ট লীগের কর্মীদের মতাদর্শ ও রাজনৈতিকভাবে দৃষ্টি খুলে দিয়েছিলেন। তার রাজনৈতিক মতাদর্শগত অবস্থানের কারণে আমরা তার প্রতি মাথা নত করেছিলাম। তিনি তার সুদীর্ঘ জীবন ধরে যা করেছিলেন তা আমাদের আগামী দিনের পাথেয় হয়ে থাকবে। তার চিন্তাধারা, চেতনাবোধ, তার বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির ধারণা ও সেই বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার ধারণার সঙ্গে শ্রেণিসংগ্রাম ও জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে লড়াই করার দৃষ্টিভঙ্গির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যদি বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার ধারণা ও রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে চর্চার বিচ্ছেদ ঘটাই তাহলে আমরা কমিউনিস্ট, বামপন্থি থাকতে পারব কিনা কিংবা আমরা সুবিধাবাদী কোনো ভুল রাজনৈতিক ধারায় নিমজ্জিত হব কিনা, সে কথাও আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের জন্য কমরেড অমল সেনের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার ধারণা আজ অনেক অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। সেই চিন্তা অনুশীলন করার প্রয়োজন আজ অতীতের চেয়েও বেশি।

কমরেড অমল সেন নড়াইল থেকে শুরু করেছিলেন তার শ্রেণিসংগ্রাম। ‘নড়াইলের তে-ভাগা সংগ্রামের সমীক্ষা’য় আমরা দেখতে পাই নারীদের বিপুল অংশগ্রহণ। কমরেড অমল সেনের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছুই জেনেছি। তিনি বলেছেন, নড়াইলের তে-ভাগা সংগ্রাম বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তে-ভাগা সংগ্রাম থেকে আলাদা। এর কারণ হিসেবে তিনি বিশ্লেষণ করে বলেছেন, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছিল বেশি, কিন্তু নড়াইলে জনগণের সম্পৃক্ততায় গণসংগ্রামের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল বেশি। এটা তাত্পর্যপূর্ণ পার্থক্য। নড়াইলের তে-ভাগা সংগ্রামে দেশের অন্য অনেক অঞ্চলের থেকে জনগণের অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি। যখন পুলিশের নির্যাতনে পুরুষরা পেছনে সরেছেন, তখন নড়াইলের সংগ্রামী নারীরা কোমরে শাড়ি পেঁচিয়ে এগিয়ে এসেছেন স্বৈরাচারী সরকার ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। ফলে সামাজিক বৈষম্য ও জনগণের ঐক্যবদ্ধতা ছিল অনেক দৃঢ়, অনেক ইতিবাচক। আজকের দিনেও আমরা যে পরিবর্তনের কথা বলি, সেখানেও নারী-পুরুষের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কমরেড অমল সেনের তে-ভাগা সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমরা দেখি, আমরা যারা রাজনীতি করি, তাদের ঘরের নারীরা গৃহস্থালি করেন। সেই ঘর কখনো বিপ্লবী হতে পারে না, সেই ঘর থেকে সমাজ পরিবর্তনের শক্তিও বের হয়ে আসতে পারে না। যদি বিপ্লব করতে হয়, সমাজ পরিবর্তন করতে হয়, তবে ঘরের ভিতরে সবাইকে বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। কমরেড অমল সেন এমন একটা সময়ে তে-ভাগা সংগ্রামে ছিলেন যখন ভারতবর্ষকে সাম্রাজ্যবাদ সাম্প্রদায়িক চক্রান্তে বিভক্ত করতে সক্রিয়। সাম্প্রদায়িকতা তে-ভাগা সংগ্রামের সফল যৌক্তিক পরিসমাপ্তি টানতে দেয়নি। ফলে আজকে যখন আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলি, তখন কমরেড অমল সেনের কষ্ট, দুঃখবোধ, বেদনাবোধ, সাম্প্রদায়িকতা দ্বারা বিভক্ত ভারতবর্ষের সংকট তার লেখায় দেখতে পাই। আজও সেই সংগ্রাম চলছে, একদিকে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার সংগ্রাম, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধের সংগ্রাম। শত বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় এ সংগ্রাম চলছেই। কমরেড অমল সেনকে আমরা পেছনে ফেলে বা অতীতের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে এগিয়ে যাব, তার কোনো অবকাশ নেই। আমাদের কাছে সে কারণেই কমরেড অমল সেন প্রতিদিনের সংগ্রামে প্রাসঙ্গিক। মুসলিম লীগের বিরোধিতা করার কারণে একজন জনপ্রিয় মুসলিম জননেতাকে কীভাবে সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন মানুষ প্রত্যাখ্যান করতে পারে সেই ঘটনার কথা কমরেড অমল সেন তার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছেন। কমরেড অমল সেন বলেছিলেন, তিনি ইতিহাস লিখতে চান না, তাই কয়েকটি ঘটনাপ্রবাহ তুলে দিয়ে গেছেন। তে-ভাগা সংগ্রামও এক উজ্জ্বল ইতিহাস। সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তিনি আমাদের কাঁধে দিয়ে গেছেন। এখন সেই দায়িত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন করব কিনা তা আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বাম প্রগতিশীলদের ঐক্যবদ্ধ করে সমরযুদ্ধে ভূমিকা রাখতে কমরেড অমল সেনের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করার এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে ভারতের বামপন্থি শক্তি এগিয়ে এসেছিল। সেই সমন্বয় কমিটিতে যেমন কমরেড রাশেদ খান মেনন ছিলেন একই সঙ্গে কমিটির প্রধান ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

আমরা যারা কমরেড অমল সেনের রাজনীতির ধারাবাহিকতা ধারণ করি, আমাদের বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কেবল আওয়ামী লীগের একক অবদান নয়। কমরেড অমল সেন ও আজকের ওয়ার্কার্স পার্টিও সেই মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার এবং তার গৌরবের অন্যতম অংশীদার। সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলে একসময় পার্লামেন্টারি সংগ্রাম থেকে বামপন্থিরা দূরে সরে এসেছিলেন। বর্তমান মুহূর্তেও যে পার্লামেন্টের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা আছে তা কমরেড অমল সেন উপলব্ধি করেছিলেন। যে মুহূর্তে জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার সংগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ, তখনো পার্টি পার্লামেন্টকে ব্যবহার করে জনগণের মাঝে পার্টির শক্তি বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। পার্লামেন্টারি সংগ্রাম প্রসঙ্গে কমরেড অমল সেনের একটি বক্তব্য সবার উপলব্ধির জন্য তুলে দিচ্ছি : ‘জীবন-জীবিকার শ্রেণিসংগ্রামগুলোর মধ্য দিয়েই তাদের এই বিকল্প শক্তিকে বিকশিত করে তুলতে হবে। এবং এই কালে পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থা চালু থাকা আমাদের মধ্যবর্তী কাজের পক্ষে তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক।’ অথচ আমরা জনগণের জীবন সংগ্রামকে গুরুত্বও দিচ্ছি না, আবার পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় নিজস্ব পার্লামেন্টারি শক্তি বাড়ানোর কাজও করছি না। স্থানীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে পার্লামেন্টকে শ্রেণিসংগ্রামের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে কাজে লাগানোর গুরুত্ব কমরেড অমল সেন উপলব্ধি করেছিলেন।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ২০০১ সালের পর থেকে ক্রমাগত দেশের বাস্তবতায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লড়াইয়ে অবতীর্ণ রয়েছে। একদিকে পার্টির শক্তি-ভিত মজবুত করা, জনগণের মধ্যে পার্টির শক্তি বিকশিত করা ও ক্রমাগত ধাপে ধাপে এ দেশের অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের মূল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়া— এটাই যদি আমাদের সংগ্রামের লক্ষ্য হয়, তবে কমরেড অমল সেনের জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার চেতনাবোধকে অনুশীলনে না নিয়ে আমরা কি সফল হতে পারব? কখনই নয়। আমাদের সংবিধানে আছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মালিক হচ্ছে দেশের জনগণ। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের ইচ্ছার যখন প্রতিফলন ঘটে তখনই বুঝতে হবে জনগণের সচেতন শক্তি বিকল্পে পরিণত হয়েছে। দেশের বাস্তবতায় স্পষ্টভাবেই জামায়াত-বিএনপি-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলা এবং একই সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে জনগণের ন্যায্য সংগ্রাম সংগঠিত করেই আমাদের এগোতে হবে। ধৈর্য, সহনশীলতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে এই রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। জনগণের সঙ্গে থেকেই সবকিছু করতে হবে। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আজ সমাজকে গ্রাস করতে চলেছে তাকে প্রতিহত করার সাহস অর্জন করতে হবে। আমরা পথ হারাব না, কারণ আমাদের সঙ্গে আছে কমরেড অমল সেনের মূল্যবান শিক্ষা।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং সংসদ সদস্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর