বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

দঙ্গলের মেয়ে

তসলিমা নাসরিন

দঙ্গলের মেয়ে

ভারতবর্ষের মানুষ সিনেমার লোকদের জন্য পাগল। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা মারা যাওয়ার পর ৭০ জনেরও বেশি আত্মহত্যা করেছে। জয়ললিতা কোনও এককালে তামিল সিনেমায় অভিনয় করতেন। আগের মুখ্যমন্ত্রী অভিনেতা এমজিআর রামাচান্দ্রানের মৃত্যু হলে ৩০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তামিল অভিনেতা রজনীকান্ত মারা গেলে, শুনেছি, হাজারও লোক নাকি আত্মহত্যা করবে। সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের জন্য এই অদ্ভুত আবেগ তামিলদেরই আছে।

সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা পলিটিক্সের কিছু না জেনে রাজ্যসভার সদস্য বনে যাচ্ছেন। জয়া ভাদুরি, হেমা মালিনি, জয়াপ্রদা, গোবিন্দ, মিঠুন চক্রবর্তী, রেখা, শাবানা আজমী, শত্রুঘ্ন সিনহা— কে নয়? ওদিকে পশ্চিমবঙ্গেতর মমতা ব্যানার্জি রুপোলি পর্দার মানুষকে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, পাকা পলিটিশিয়ানদেরও হারিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। দেবশ্রী, তাপস পাল, দেব, মুনমুন সেন, আরও কত কেউ।

দঙ্গল আমির খানের ছবি। ব্যাপক জনপ্রিয়। ভারতের সর্বত্র দঙ্গলের ভূয়সী প্রশংসা। হরিয়ানার পিছিয়ে থাকা সমাজের দুটো মেয়ে গীতা ফোগাট, আর ববিতা ফোগাট দেশ বিদেশ থেকে কুস্তি লড়ে সোনার মেডেল নিয়ে এসেছে। লোকেরা বলছে, দেখেছো মেয়েরা কী ভীষণ সাহসী হতে পারে, গাঁয়ের মেয়ে হয়েও অলিম্পিকে গিয়ে কী রকম সোনা ছিনিয়ে আনতে পারে! মেয়েদের সাহস আর মনোবল অবশ্য বাস্তবে পছন্দ না হলেও সিনেমায় পর্দায় সেটি মানুষের বেশ পছন্দ। মেয়েদের অত বাড় বাড়লে চলে না— এ কথা শতবার বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা লোকগুলোই দঙ্গল দেখে হাততালি দেয়। মেয়েদের যৌনদাসী ভাবা লোকেরাও দঙ্গল নিয়ে উচ্ছ্বসিত।

গীতা আর ববিতা ফোগাটের বাবা মহাবীর সিং ফোগাটকে প্রায় ঈশ্বরের মতো শ্রদ্ধা করছে দঙ্গলের দর্শককুল। কারণ, দুটো মেয়েকে তিনি কুস্তি শিখিয়ে সফল কুস্তিগীরে পরিণত করেছেন। অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। হরিয়ানার মতো মহা পিতৃতান্ত্রিক মহা নারীবিরোধী সমাজে মহাবীরকে সকলে এক মহা নারীবাদীই ভেবে নিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মহাবীর কি তাঁর পুত্র সন্তান থাকলে কন্যাদের কুস্তিগীর বানাতে চাইতেন? উত্তর আমরা জানি, চাইতেন না। আর সব মেয়েকে যেমন অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন বাবারা, তেমনই বিয়ে দিয়ে দিতেন। মহাবীরের স্ত্রী যেমন সংসারের জন্য খেটে আর রেঁধে বেড়ে জীবন পার করেন, মহাবীরের কন্যাদেরও তাই করতে হতো। মহাবীরের পুত্ররা মহাবীরের মতো পালোয়ান হতেন। যেহেতু পুত্র নেই, অগত্যা মহাবীর তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতেই মেয়েদের পালোয়ান বানালেন। পুত্র নিয়ে যে স্বপ্ন ছিলো তাঁর, সেই স্বপ্ন পূরণ করতে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মরিয়া হয়ে ওঠার ভুল অনুবাদ করেছি আমরা। আমরা ভেবে সুখ পেয়েছি মহাত্মা মহাবীর নারী পুরুষে কোনও পার্থক্য করেন না।

 

 

দঙ্গল ছবিতে যে মেয়েরা অভিনয় করেছে, তারা এখন দেশের হিরো। তারা এখন বাস্তবের গীতা আর ববিতা ফোগাটের চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। গীতা আর ববিতাকে নয়, তাদের চরিত্রে অভিনয় করা মেয়েদেরই ভাবা হচ্ছে অসম সাহসী মেয়ে, তাদেরই ভাবা হচ্ছে ইয়ং মেয়েদের রোল মডেল। এর মধ্যে জাইরা ওয়াসিম নামের এক কাশ্মীরি মেয়ে, যে গীতা ফোগাটের চরিত্রে অভিনয় করেছিল, দেখা করেছে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির সঙ্গে। মেহবুবা মুফতি আবার জাইরাকে প্রকাশ্যে ‘রোল মডেল’ বলার পর কাশ্মীরিদের অনেকে রেগে আগুন হয়ে গেছে। কয়েক মাস যাবত্ ভারতীয় সেনার গুলিতে, বোমায়, কাশ্মীরি তরুণেরা মরেছে, আহত হয়েছে, অন্ধ হয়ে গেছে— আর সেসব দেখেও যে মুখ্যমন্ত্রীর কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, কোনও বিকার নেই,— সেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা কেন! জানি না কী ধরনের হুমকির সামনে পড়েছিলো জাইরা। তড়িঘড়ি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। নিজের ফেসবুক পোস্টও ডিলিট করে দিয়েছে। বলেছে আমি যা করেছি ভুল করেছি, এমনটি আর হবে না, আমি কারও রোল মডেল নই ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘটনা ঠিক কী ঘটেছে— তা আমরা জানি না। অনুমান করছি জাইরাকে শাসিয়েছে লোকে। বাঁচার জন্য সম্ভবত ক্ষমা চেয়েছে সে। চারদিক থেকে এখন সব শুভাকাঙ্ক্ষী বলছে— ‘জাইরা তুমি খুব সাহসী মেয়ে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমরা আছি তোমার সঙ্গে।’ রামের চরিত্রে অভিনয় করলে লোকে অভিনেতাকে মনে মনে ভগবান রামকে যেমন শ্রদ্ধা করে, তেমন করে। জাইরাকেও মনে মনে লোকে গীতা ফোগাট ভেবে নিয়েছে, তাই ভেবে নিয়েছে জাইরা অসম্ভব সাহসী মেয়ে। গীতা ফোগাট যেভাবে চ্যালেঞ্জ করেছিলো মেয়ে হয়ে ছেলেদের মতো সে কুস্তিগীর হবে, দুনিয়াকে দেখিয়ে দেবে মেয়েরাও পারে, সেভাবে সবাই হয়তো ভাবছে জাইরাও কিছু একটার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেছে। মুসলমান মেয়ে হয় সিনেমায় নেমেছে— এতে হয়তো সাহসের পরিচয় মেলে। কিন্তু মুসলমান মেয়েদের সিনেমায় নামা তত অসম্ভব নয়, যত অসম্ভব হরিয়ানার নারীবিদ্বেষী সমাজে মেয়েদের কুস্তিগীর হওয়া। জাইরা যদি সাহসী হতো, সে এভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ভুল করেছে, অভিনয়ে নেমে ভুল করেছে বলে বলে কাঁদতোও না, ক্ষমাও চাইতো না। মুখ্যমন্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তার দেখা না করার কোনও কারণ নেই। জাইরা রাজনীতির মেয়ে নয়। কাশ্মীরে যে অন্যায় ঘটছে তার দায় জাইরার নয়। মুখ্যমন্ত্রী যদি ভুল করে থাকেন, তাহলে সে ভুল জাইরার নয়, মুখ্যমন্ত্রীর। জাইরার বয়স ১৬। এই বয়সটা এটুকু বোঝার এবং দুষ্ট লোকের চোখ রাঙ্গানোতে ভয় না পাওয়ার এবং সামান্য হলেও আত্মবিশ্বাস অর্জন করার বয়স। এই বয়সেই তো মানুষ রুখে ওঠে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে।

কোনও একটা সাহসী চরিত্রে অভিনয় করলে সে সাহসী, কোনও একটা ভীতুর চরিত্রে অভিনয় করলে সে ভীতু, হাসির খোরাক দেয় এমন কারও চরিত্রে অভিনয় করলে সে বাস্তব জীবনেও কমেডিয়ান, ভগবানের চরিত্রে অভিনয় করলে সে ভগবান— এরকমই সাধারণ মানুষের যুক্তিহীন আবেগ। আমার মনে আছে, কলকাতার টেলিভিশনে যখন আমার লেখা একটি উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে বানানো সিরিয়াল চলছিলো এক মাসব্যাপী, ওই সিরিয়ালের অভিনেত্রী কনিনীকা বন্দ্যোপাধ্যায় সকাল বেলা একটা পার্কে হাঁটতে গিয়েছিল, দেখে ছুটে এসেছিলো লোকজন। কী, ও কী করে বাড়ি থেকে বেরোলো, শাশুড়ি কি তাকে বেরোতে দিল? সিরিয়ালের ঝুমুরকে শাশুড়ি বাড়ি থেকে বেরোতে দেয় না, কিন্তু কনিনীকা তো ঝুমুর নয়, ঝুমুর চরিত্রে সে শুধু অভিনয় করছে। দর্শক প্রায়ই দুটো মানুষকে এক করে ফেলে।

যেমন জাইরা ওয়াসিম আর গীতা ফোগাটকে এক করে ফেলে। সিনেমা পাগল মানুষেরাই হয়তো করে। দুটো মানুষ এক নয়। রবিন উইলিয়ামস ফিল্মে লোক হাসানোর অভিনয় করতেন, ব্যক্তিজীবনে তিনি কিন্তু ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন। পশ্চিমের দেশগুলোয় এভাবে অভিনেতা আর চরিত্র— দুটোকে এক করতে দেখিনি। একবার অবশ্য এক করেছিল একজন। সে বাস্তবে নয়, ফিল্মেই। ‘দ্য ফ্রেঞ্চ লেফটেন্যান্টস উওম্যান’ উপন্যাসের চার্লস আর সারা’র চরিত্রে অভিনয় করছিল অ্যান আর মাইক। চার্লস যেমন করে ভালোবাসতো সারাকে, সেভাবেই মাইক ভালোবাসতে থাকে অ্যানকে। একসময় অ্যান যখন শুটিং শেষে তার স্বামীর সঙ্গে চলে যেতে থাকে, মাইক ছুটে এসে অ্যানকে পেছন থেকে ডাক দেয়, ডাক দেয় সারা বলে। নিজের ডাকেই নিজে চমকে ওঠে মাইক। চরিত্রের সঙ্গে খুব বেশি একাত্ম হয়ে গেলে এভাবেই ডাকা সম্ভব!

কথা হচ্ছিল জাইরাকে নিয়ে। আমি গীতা ফোগাটকে সাহসী মেয়ে বলতে পারি, কিন্তু জাইরাকে নয়। জাইরা সেইসব মেয়ের মতো, যারা ভয়ে পিছিয়ে যায়, আশঙ্কায় মুখ বন্ধ করে রাখে, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোনও পদক্ষেপ রচনা করে না। জাইরা এরকমই রয়ে যাবে, অথবা নিজেকে বদলাবে- জানি না। তবে বলিউডে স্পষ্টভাষী সাহসী মানুষের বড় অভাব, সে কারণে মনে হয় না সিনেমার জগতে এসে বলিউডের পরিবেশে থেকে তরুণীদের রোল মডেল বনে যাবে জাইরা। শুনেছি জাইরাকে তার বাবা মা সিনেমায় নামতে দিতে চাননি। হয়তো তাকে আর অভিনয়ই করতে দেবেন না তার বাবা মা। অভিনয় করুক না করুক, তাকে রাজনীতির শিকার করাটা মোটেও উচিত হচ্ছে না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর