বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

শহীদ জিয়ার শেষ জন্মদিনের স্মৃতি

রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী

শহীদ জিয়ার শেষ জন্মদিনের স্মৃতি

জিয়া সাহেব বললেন, দেশের সেরা মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে— ‘তোমাদেরকে আমি এখানে এ বঙ্গোপসাগরে কেবল প্রমোদ-ভ্রমণে নিয়ে আসিনি, এনেছি আমার কিছু কথা আছে তোমাদের উদ্দেশে, তা বলার জন্য।’ জাহাজের ভিতরে আড়াই/তিন হাজার যাত্রী আমরা, সবাই খানিকটা অবাক— প্রেসিডেন্ট ও বিএনপি নেতা জিয়াউর রহমান যিনি আমাদের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মহান এক নেতা, কী বলতে চান সবার উদ্দেশে!

ঘটনাটা ১৯৮১ সালের জানুয়ারির ১৯ তারিখের। আমরা তখন মধ্য-বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রগামী জাহাজ হিযবুল বাহারে। ঘটনাচক্রে সেটা ছিল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের উদ্ভাবক ও বাস্তবায়নকারী জিয়া সাহেবের পঁয়তাল্লিশতম জন্মবার্ষিকীর দিন। সে এক রোমাঞ্চকর স্মৃতি, তার মূল্য তখন অতটা বুঝিনি আমি, এখন বুঝি হূদয়ে-মগজে। তার সেই বাণীগুলো আমার মাথার ভিতরে ঘুরপাক খায়, প্রতিদিন তার মূল্য বাড়ছে আমার কাছে। আজ যখন শহীদ জিয়াউর রহমান আমাদের কাছে থেকে হারিয়ে গেছেন না ফেরার দেশে, তখন বংলাদেশি জাতীয়তাবাদের উদ্ভাবকের সেসব উপদেশের দাম বোঝা যায়।

আগের দিন ১৮ জানুয়ারি, প্রচণ্ড শীতের সেই সকালে ৯টা/১০টা নাগাদ আমরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে উঠলাম হিযবুল বাহারে। আমাদের সমুদ্র-বিহার তিন দিনের— ১৮, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি। হিযবুল বাহার এক সমুদ্রগামী যাত্রীবাহী জাহাজ, হাজিদের মক্কা যাওয়া-আসার উদ্দেশ্যে কিনে আনা হয়েছিল, তখন সেটি বন্দরে নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। সেই জাহাজটিতে আমরা চড়ে বসলাম— অত বড় সমুদ্রগামী জাহাজে মধ্য-বঙ্গোপসাগর যাত্রা, আমাদের সবাইকেই একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি এনে দিয়েছিল। কারণ, নিরানব্বই শতাংশের বেশি যাত্রীরই এ ধরনের সমুদ্র-ভ্রমণে সেটা প্রথম অভিজ্ঞতা। বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী-সংগঠকদের পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট ও বিএনপি প্রধান জিয়া সাহেব সঙ্গে নিয়েছিলেন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের একটা বিশাল গ্রুপ।

আমরা প্রায় আড়াই/তিন হাজার যাত্রী। আমাদের সেই যাত্রার আয়োজক ও যাত্রাসঙ্গী স্বয়ং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বিএনপির মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ড. আর এ গনি এবং আরও অনেক নেতা ছিলেন সেই সমুদ্রযাত্রায়। বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের অনেকেই ছিলেন আমাদের যাত্রাসঙ্গী।

আমাদের জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)-এর সভাপতি কবি আল মাহমুদ তো ছিলেনই, জাসাস মহাসচিব হিসেবে আমি আর আমাদের কেন্দ্রীয় নেতা-সংগঠকদের প্রায় পঁচিশজন। বিশাল আয়োজন, খোদ প্রেসিডেন্ট যখন তার উদ্যোক্তা, তখন তাতে ব্যাপক সাজ সাজ রব উঠেছিল যাত্রার শুরুতেই, সেটাই স্বাভাবিক ঘটনা। সেই অভিযাত্রা ছিল নজিরবিহীন এক আয়োজন। দেশের প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান তার শাসনকালের বছর-পাঁচেকের চমত্কার-অভিজ্ঞতা লাভের পরে, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি পরিচালনার বিশাল অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ হয়ে এ আয়োজন করেছিলেন অনেক ভেবেচিন্তে। আমরা জাহাজের সব যাত্রীই এ আয়োজনকে উপভোগ করছিলাম মন-প্রাণ ভরে। সবার মধ্যেই প্রবল উত্তেজনা, আনন্দ-উচ্ছ্বাস। সবাই হৈচৈ করে কাটাচ্ছিলাম। আর জাহাজের খাবার-দাবার উপভোগ তো সবার জন্যই এক বিশাল অভিজ্ঞতা, মজার অভিজ্ঞতা। কারণ এ ধরনের জাহাজে ফোর-স্টার/ফাইভ স্টার হোটেলের কিচেন-স্ট্যান্ডার্ডের সুবিধাদি থাকে, আবাসিক সুবিধাদিও সেই মানের। সবারই মন ভরে যায় সেসব দেখলে। সে যাই হোক!

প্রথম দিন তো কেটে গেল, আমাদের বহনকারী জাহাজ ‘হিযবুল বাহার’ মধ্য-বঙ্গোপসাগরের শেষ প্রান্তে হিরণ পয়েন্ট অবধি চলে এসেছে। দ্বিতীয় দিনে মানে ১৯ জানুয়ারি সকাল ১০টা/সাড়ে ১০টার দিকে, বিএনপি মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী আমাকে ডেকের একদিকে ডেকে নিয়ে বললেন— ‘একটা চমক আছে। আজকে (১৯ জানুয়ারি) প্রেসিডেন্ট জিয়া সাহেবের জন্মদিন। কাউকে কিছু বলা যাবে না, আমরা তাকে একটা চমক দিতে চাই। বদরুদ্দোজা চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা অল্প কয়েকজন গোপনে জাহাজের ক্যাপ্টেনকে অনুরোধ করলাম প্রেসিডেন্ট সাহেবের জন্মদিনের কেক তৈরি করতে। যথারীতি তিনি তা করলেন। আমরা একটা বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু সবকিছু গোপন রাখলাম প্রেসিডেন্টকেও জানতে দিলাম না। সন্ধ্যাবেলা প্রেসিডেন্ট জিয়া সাহেবকে মিলনায়তনে এনে তাকে উদ্দেশ্য করে সবাই উঁচু কণ্ঠে গেয়ে উঠলাম— ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউয়ো মি. প্রেসিডেন্ট স্যার’। জিয়া সাহেব অনেকটা হতবাক। তিনি ভাবতেই পারেননি আমরা তার জন্মদিন উপলক্ষে এমন একটা আয়োজন করে ফেলেছি। আমরা তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানালাম। তারপরে তাকে কেক কাটতে আহ্বান জানালাম। সবকিছুই মাইক ব্যবহার করে হচ্ছিল পরিপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতায়। তাকিয়ে দেখলাম জিয়া সাহেবের চোখের কোণায় খুব সামান্য অশ্রু উঁকি দিচ্ছে। আনন্দাশ্রু। জিয়া সাহেব নিজে তার জন্মদিনের কেক কাটলেন না, একটু লাজুক হেসে আমাদের ইঙ্গিত করলেন— ‘আমার আবার জন্মদিন! এসব তো আমি কখনো করি না। কেক যখন বানিয়েই ফেলেছ, তোমরা কেক কাট’। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা জিয়াউর রহমান জন্মদিনের কেক কাটার মতো আনুষ্ঠানিকতায় কখনো আবেগে ভাসতে চাইতেন না। তিনি ছিলেন সিরিয়াস যোদ্ধা, আবার সিরিয়াস রাজনীতিক, সিরিয়াস রাষ্ট্রনায়ক। হয়তো সামান্য অভিমানও তার মধ্যে কাজ করে থাকতে পারে— বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে পুরো জাতিটিকে উদ্বুদ্ধ করতে তখনো তেমন সাফল্য পাচ্ছিলেন না যেটা তার কাঙ্ক্ষিত ছিল। দেশকে একটা সফল অর্থনৈতিক ভিত্তি দেওয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা সাফল্যের পথে যথাযথভাবে এগোতে পারছিল না, সেই ব্যর্থতার অভিমান! তার ওপরে সামরিক বাহিনীর ভিতরে তার বিরুদ্ধে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত চক্রান্ত চলছিল, সেটাও তার মনোবেদনার কারণ ছিল। তাছাড়া তিনি ছিলেন সব লোভলালসা আর ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠা এক মহান নেতা।

আমরা তার হয়ে কেক কাটলাম। তিনি কেক খেলেন না। তিনি গম্ভীর থেকেও সবকিছুতে সাড়া দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারপর এক পর্যায়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হলো। সেই অনুষ্ঠানের মধ্যে তিনি আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন— ‘রেজাবুদ্দৌলা, তোমরা কি জান আমাদের মহাসচিব বদরুদ্দোজা সাহেব ভালো গান গান! তাকে একটা গান গাইতে বল, মাইকে ঘোষণা দাও। আমি যথারীতি ঘোষণা দিলাম মাইকে—‘এবার আমাদের বিএনপি মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী সাহেব গান করবেন’। ডা. চৌধুরী সাহেব গাইলেন রবীন্দ্রসংগীত ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’। চমত্কার কণ্ঠে গাইলেন তিনি, জোর করতালি দিলেন প্রেসিডেন্ট সাহেব নিজে এবং যথারীতি আমরা সবাই।

তারপরে মহাসচিব ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী আমাকে ডেকে বললেন—‘এবার প্রেসিডেন্ট জিয়া সাহেবকে বল, তাকে গান গাইতে হবে’। আমরা মাইকে ঘোষণা দিলাম। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সহাস্যমুখে এগিয়ে গেলেন মাইকের দিকে, যন্ত্রশিল্পীদের নির্দেশ দিলেন, ‘ধরো, (ইঙ্গিত করলেন তার প্রিয় সেই বিখ্যাত গানের সুর ধরতে)’। তিনি শুরু করলেন— ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার, শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার, মরণ বাংলাদেশ’। তিনি আমাদের সবাইকে হাতের ইশারায় তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে নির্দেশ দিলেন। জিয়া সাহেব গাইলেন, আমরা সবাই তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলালাম। দারুণ সে অভিজ্ঞতা। সবার মধ্যে সে কী উত্তেজনা!

একেবারে শেষে, প্রেসিডেন্ট জিয়া মাইক নিলেন হাতে বললেন দরাজ-গলায়, মেধাবী ছাত্রছাত্রী ও তরুণদের বিশেষভাবে উদ্দেশ করে— ‘আমি তোমাদের এখানে এ বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রযাত্রায় এনেছি কি শুধু প্রমোদ-ভ্রমণের জন্য? না, তা নয়। আমি এ যাত্রায় তোমাদের কিছু কথা বলতে চাই। শোনো, আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা এ দেশের জন্য আমাদের ভবিষ্যত্ নির্মাণের জন্য অনেক আত্মত্যাগ করে গেছেন, তারা অনেককিছু দিয়ে এ জাতি-রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে দিয়ে গেছেন। তাদের অনুসরণ করে আমরা যুদ্ধ করে এদেশ স্বাধীন করেছি, আমাদের স্বাধীনতা কারও দয়ার দান নয়। বিশাল আত্মত্যাগের মাধ্যমে এ দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। এ স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে একটি সুখী-সমৃদ্ধ আত্মমর্যদাসম্পন্ন জাতি গঠনের লক্ষ্যে আধিপত্যবাদী শক্তির সব চক্রান্ত থেকে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করা, আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্যে তোমাদের ভবিষ্যত্ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। সে জন্য চাই যথাযথ প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতি তোমরা এখন থেকে নেবে।’ আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম তার ভাষণ। অন্য সবাইও তুমুল করতালির মধ্যে সেই বক্তৃতা শুনছিলেন। বঙ্গোপসাগরের জলরাশির উর্মিমালার উত্থান-পতনে আর জিয়া সাহেবের অমর বাণীর ছন্দে যেন এক মোহজাল সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল সবার অগোচরেই— যার কোনো তুলনা মেলে না।

জিয়াউর রহমান আরও বললেন, ‘আমাদের এ বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় ৪০ হাজার বর্গমাইল এলাকা জাগতে চলেছে— সেটি হবে আরেকটি বাংলাদেশের সমান। এ ভূমি, আর আমাদের তেল, গ্যাস সম্পদের ওপরে আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর লোলুপ-দৃষ্টি, তারা এসব গ্রাস করতে চাইবে, আমরা তা কখনোই হতে দেব না, তোমরা আমাদের মেধাবী তরুণ প্রজন্ম, তোমরা যারা আমাদের এ রাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ নেতা, তোমরাই নেতৃত্ব দেবে আমাদের এসব সম্পদ আধিপত্যবাদের হাত থেকে রক্ষা করতে। আমরা আমাদের জেনারেশনের লোকেরা এদেশের জন্য যা করার করে দিতে চেষ্টা করেছি, আমাদের অসমাপ্ত কাজের উত্তরাধিকার তোমাদের কাছে দিয়ে যেতে চাই, এখন দায়িত্ব নিতে হবে তোমাদের।’

শহীদ জিয়া সাহেবের সেই ভাষণ আজও আমার কানে বাজে। তাকে আধিপত্যবাদী শক্তির চক্রান্তে শহীদ হতে হয়েছে। তিনি আমাদের উদ্দেশে, আমাদের মেধাবী তরুণ সমাজের উদ্দেশে যা বলে গেছেন তা প্রতিদিনই আমাদের কাছে অমর বাণী হয়ে ধরা দেয়। তাই শহীদ জিয়া অমর। তার সেসব বাণী এ রাষ্ট্রকে পথ দেখায়। আজকের বাংলাদেশের সমৃদ্ধির পেছনে যে ভিত্তি তা তৈরি করে দিয়ে গেছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া।

     লেখক : সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বিএনপি

সর্বশেষ খবর