শুক্রবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

আমরা কি আল্লাহর দাস হতে পেরেছি

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আমরা কি আল্লাহর দাস হতে পেরেছি

তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে। নিজেকে আল্লাহর দাস বানানোর দাওয়াত দিয়ে থাকে তাবলিগ জামাত। সূরা যারিয়াতের ৫৪ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘ওয়ামা খালাকতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিয়াবুদুন’। অর্থাৎ ‘আমি জিন এবং মানুষকে এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা শুধু আমারই দাসত্ব করবে।’ এ থেকে বোঝা যায় যে, আমরা মহান মাবুদের দাস। দাস ওই সত্তাকে বলা হয়, যাকে নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময় কেনা হয়। বিক্রির পর দাসের আর কোনো ইচ্ছা থাকে না। মালিক যা বলবেন তা-ই করবে। মালিকের সন্তুষ্টির জন্য নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দেবে দাস। এখন প্রশ্ন হতে পারে, উপরের আয়াতে আল্লাহ আমাদের দাস বলেছেন— তার মানে কি আল্লাহ আমাদের কিনে নিয়েছেন? উত্তর, অবশ্যই কিনে নিয়েছেন, সূরা তাওবায় আল্লাহ বলেছেন, ‘ইন্নাল্লাহাশতারা মিনাল মুমিনিনা বিআমওয়ালিহিম ওয়া আনফুসিহিম আন্না লাহুমুল জান্নাহ’। অর্থাৎ ‘যারা নিজেদের বিশ্বাসী দাবি করে, তাদের সম্পদ এবং জীবন আল্লাহ কিনে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়।’ এর মানে হলো— আমরা জান্নাতের বিনিময় আল্লাহর কাছে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছি। এখন আমরা আল্লাহর দাস বা গোলাম। এখন আমাদের নিজস্ব ইচ্ছা বলতে কিছু নেই। সব প্রভুর খুশিমতো করতে হবে। এভাবে যখন নিজের ইচ্ছাকে প্রভুর খুশির কাছে সমর্পণ করব, তখনই আমরা হয়ে যাব মুসলিম তথা আত্মসমর্পণকারী।

দাসের মতোই আরেকটি শ্রেণি আছে। তারা হলো কর্মচারী। মালিকের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময় কাজ করে। মালিকের সঙ্গে তাদের এর চেয়ে বেশি কোনো সম্পর্ক নেই। একটি উদাহরণের মাধ্যমে দাস এবং কর্মচারীর পার্থক্য বোঝানোর চেষ্টা করব। ‘বেলাল আমার দাস। ১০ কোটি টাকার বিনিময় তাকে কিনে নিয়েছি। এখন আমার সব কথা তাকে বিনা বাক্যে মানতে হবে। আর সে যদি কখনো অসুস্থ হয় বা বিপদে পড়ে তাহলে তার দেখাশোনা করা আমার জন্য আবশ্যক নয়। তবে আমার দয়া এবং ভালোবাসা তাকে অসুস্থ অবস্থায় একলা ফেলে রাখাকে সঠিক মনে করবে না। এই হলো দাসের অবস্থা। অপরদিকে হেলাল আমার চাকর বা কর্মচারী। মাসিক বেতন ২৫ হাজার টাকা। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত আমার ফ্যাক্টরিগুলো দেখবে। কখনো যদি অতিরিক্ত সময় কাজ করানো লাগে কিংবা ফ্যাক্টরি ছাড়া অন্য কোনো কাজের প্রয়োজন হয় তবে চুক্তি অনুযায়ী হেলাল তা করতে বাধ্য নয়। নিঃসংকোচে সে আমাকে বলবে, আমি আপনার গোলাম নই, কর্মচারী। চুক্তির বাইরে কোনো কাজ এবং অতিরিক্ত সময় দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। একইভাবে আমিও তার প্রয়োজনের সময় চুক্তির বেশি এক টাকাও দেব না। এই হলো চাকরের অবস্থা।

চাকর এবং দাসের পার্থক্য বলার পর একথা বোঝার বাকি নেই যে, আল্লাহ কেন আমাদের দাস বলেছেন। এও বোঝার বাকি নেই যে, দাস হিসেবে আমাদের কীভাবে প্রভুর নির্দেশ মেনে চলা উচিত। মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকালে এবং চিন্তার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আল্লাহর সঙ্গে আমাদের চুক্তি হয়েছে দাসত্বের এবং এর দামও নির্ধারণ করা হয়েছে জান্নাত, কিন্তু আমরা আল্লাহর সঙ্গে আচরণ করছি কর্মচারীর। সকাল-বিকাল মসজিদে হাজিরা দিয়ে আসার পর বাকি সময়টুকু দাসত্বের রশি গলা থেকে খুলে ফেলছি। আর তাগুতি শক্তির আনুগত্য করছি। বলুন তো দশ কোটি টাকা দিয়ে কোনো দাস কেনার পর সে যদি এক হাজার টাকার কর্মচারীর সমান সেবাও না দেয় তার প্রতি আপনার কত রাগ হবে? আমাদের প্রতিও আল্লাহর অনেক রাগ। তবে মালিকের রাগের চেয়ে দয়া অনেক বেশি। তাই আমাদের এখনো ধ্বংস করে দেননি। তবে তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা যদি আমার দাসত্ব সঠিকভাবে করতে না পার তবে আমি নতুন এক জাতির উত্থান ঘটাব। যারা সঠিকভাবে আমার দাসত্ব করবে।’

প্রিয় পাঠক! আসুন! আমরা আল্লাহর দাস হয়ে যাই। দাসত্বের এ রাজ্যে কর্মচারী হয়ে থাকায় কোনো সম্মান নেই। আল্লাহ নিজেই বলছেন, ‘ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানুদ খুলু ফিসসিলমি কাফফাহ-ওহে আমর দাসেরা! তোমরা পরিপূর্ণভাবে আমাদের দাসত্বের রাজ্যে প্রবেশ কর।’ যারা খোদার দাসত্বের রাজ্যে কর্মচারীর মতো আচরণ করবে তাদের ব্যাপারেই আল্লাহ বলেছেন, ‘দাসত্ব পাকা চুক্তি হওয়ার পরও কি তোমরা আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে আর কিছু অংশ করবে অস্বীকার-অমান্য, তোমাদের মধ্যে যারা এমনটি করবে তাদের প্রতিদান এ শাস্তি ছাড়া আর কিছুই নয় যে, দুনিয়ার জীবনে তাদের গ্রাস করবে হীনতা-লাঞ্ছনা-গঞ্জনা।  আর কেয়ামতের দিন তাদের নিক্ষেপ করা হবে কঠিন আজাবে।’ (সূরা বাকারাহ : ৮৫।)

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসিসরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর