শনিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

রূপান্তর

সৈয়দ বোরহান কবীর

রূপান্তর

শহীদ মুনীর চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর নাটকের ঐতিহাসিক উক্তি হলো ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়’। মূলত বিবর্তনবাদী দর্শন থেকে এ উক্তিটি সমাজ রূপান্তরের প্রবহমানতাকেই ইঙ্গিত করে। প্রগতিশীলরা বিশ্বাস করেন, সমাজ ক্রমাগতভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। সমাজের এ রূপান্তর, বিবর্তন সব সময় ইতিবাচক হবে এমনটি নয়। রূপান্তর বা বিবর্তনকে ইতিবাচক ধারায় নিয়ে যাওয়াই হলো নেতৃত্বের কাজ। অগ্রগতি ও উন্নয়নের স্মারক।  রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির জীবনে গতিময়তার নামই হলো রূপান্তর, পরিবর্তন। কিন্তু এ পরিবর্তন সব সময় প্রগতির পক্ষে হয় না। বদলে যাওয়া মানেই ভালো না। পরিবর্তন হতে হবে ইতিবাচক এবং প্রগতির পক্ষে, মানুষের কল্যাণে, মানুষের পক্ষে।

মানুষ যেমন বদলায়, তেমনি বদলায় সমাজ, সংগঠন এবং রাষ্ট্র। ব্যক্তির কিছু পরিবর্তন হলো একেবারে প্রাকৃতিক ও জৈবিক। আর কিছু পরিবর্তন মনোজাগতিক, আদর্শিক। শিশুকাল, কৈশোর, যৌবন এবং বার্ধক্যের প্রতিটি স্তরে জৈবিক পরিবর্তন দৃশ্যমান। মনোজাগতিক ও আদর্শিক পরিবর্তন সব সময় দৃশ্যমান নয়। যৌবনে সমাজ বদলের সংগ্রাম দেখা টকবগে তরুণ বার্ধক্যে এসে সৃষ্টিকর্তার হাতে নিজেকে সঁপে দেয়। সত্জীবনের অঙ্গীকার করে সরকারি চাকরিতে ঢুকে সম্পদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। মানুষের সেবার ব্রত নেওয়া চিকিৎসক চিকিৎসাকে ব্যবসা বানিয়ে ফেলে।

সমাজ, রাষ্ট্র ও সংগঠনেও এরকম কিছু বাহ্যিক পরিবর্তন হয়, যা দৃশ্যমান আর কিছু পরিবর্তন হয় যা মনোজাগতিক। একটা সময়, আমাদের সমাজটা ছিল কেন্দ্রীভূত, একান্নবর্তী। ক্রমশ সমাজটা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এখন একেকটা মানুষ যেন আলাদা আলাদা দ্বীপের বাসিন্দা। একই দালান পাশের ফ্ল্যাটের খবর আমরা রাখি না। ‘সমাজ’-এর পৌর বিজ্ঞানের যে সংজ্ঞা তার সঙ্গে আমাদের আজকের সমাজের কোনো মিল নেই। সেই বিবেচনায়, অভিধানিক অর্থে সমাজ ব্যবস্থার বিলুপ্তি হয়েছে। তার মানে এই নয় যে মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ নয়। অফিসে কাজের সম্পর্কে আমরা গোষ্ঠীবদ্ধ। ব্যবসায়িক স্বার্থে একটা গোষ্ঠী, এরকম নানা অপরিহার্যতায় মানুষের সম্পর্কের নানা মোড়ক দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একই এলাকায় কিছু মানুষের প্রতিদিন একাত্মা হয়ে থাকা, সুখে-দুঃখে একসঙ্গে বরণ করে নেওয়া— তেমন চিত্রটা এখন ঝাপসা, বিলীন প্রায়। ব্যক্তির মতো সমাজেরও আকৃতি বেড়েছে, ঘনত্ব বেড়েছে, সম্পর্কের ক্ষেত্র বেড়েছে কিন্তু মনোজাগতিকভাবে সমাজ চেতনা যেন উইপোকায় খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সমাজের সাংস্কৃতিক আবহ ক্রমাগত ম্লান হচ্ছে।

সমাজ মূলত নিয়ন্ত্রিত হয় সংঘ বা সংগঠন দিয়ে। আগে গ্রামে শহরে সর্বত্র ক্লাব ছিল, বাজারে আড্ডা ছিল। খেলাঘর ছিল, কচিকাঁচার আসর ছিল। এখনো হয়তো কাথাও কোথাও আছে কিন্তু তা প্রাণহীন। আমাদের সংগঠনগুলোর রক্ত কোনো এক বিষধর সাপ যেন শুঁষে নিয়েছে। এখন বাংলাদেশে সংগঠন হলো রাজনৈতিক সংগঠন। রাজনৈতিক সংগঠনের বাইরে যেসব সংগঠন আছে তাও মূলত রাজনীতি দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। হোক না তা সাংস্কৃতিক, হোক না তা ধর্মীয় সব সংগঠনের আড়ালে একটা রাজনৈতিক ইশারা স্পষ্ট। এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই বাংলাদেশ একটি রাজনীতি মনস্ক রাষ্ট্র। এদেশের মানুষ রাজনীতি পছন্দ করে। রাজনৈতিক আড্ডায় মানুষ অফুরন্ত সময় পার করে। রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গেও নানাভাবে স্বেচ্ছায় অথবা বাধ্য হয়ে যুক্ত থাকে। রাজনীতি বাংলাদেশে এতটাই শক্তিশালী যে, রাজনৈতিক যোগসূত্র বা কানেকশন না থাকলে চাকরি থেকে ব্যবসা কিছু হাতের নাগালের মধ্যে আসে না। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে লেপ্টে থাকলে চাকরি পাওয়া, চাকরিতে পদোন্নতি কিংবা ব্যবসা পাওয়ার সুবিধা হয়। এ সুবিধা পাওয়ার জন্য জনগণ রাজনৈতিক পরিবেশের ওম নেয়। ১৯৯১ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর কিছু দিন আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল দেশটা। বিএনপি যখন ক্ষমতায় এলো তখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি চাকুরে, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক কর্মী, ধর্মীয় গোষ্ঠী সব একাট্টা থাকল। ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিএনপিকে হারাতে হবে, ক্ষমতায় যেতে হবে। আবার ’৯৬ সালে বিএনপিবিরোধী দলে যাওয়ার পর বিএনপিপন্থিরা একাট্টা হলো। সংস্কৃতি অঙ্গনে দুটো ভাগ, সাংবাদিকদের দুটো ভাগ, চিকিৎসকদের দুটো ভাগ, মওলানাদের দুটো ভাগ। পাঁচ বছর একপক্ষ উপভোগ করে, অন্যপক্ষ অপেক্ষা করে। কিন্তু ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন সবকিছু উলোট-পালট করে দিল। ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলো বিপুল বিক্রমে। আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার নতুন এক কাঠামো দাঁড় করাল। এটা সমাজের রাজনীতির রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করল। যাতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কেবল কোণঠাসাই নয়, অস্তিত্বের সংকটে পড়ল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু সামনে এলে বিএনপি দিগ্ব্বিদিক জ্ঞানশূন্য মানুষের মতো এদিক ওদিক হাতড়াতে থাকল। বিএনপির প্রধান মিত্র জামায়াতই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ফলে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হলো এবং তা অত্যন্ত যৌক্তিক কারণেই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জামায়াতকে স্বাভাবিক রাজনীতি করার এক অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছিল। জামায়াত যদি ’৭১-এ তাদের ভুলের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইত এবং ’৭১-এ যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িতদের দল থেকে বহিষ্কার করে নতুন আঙ্গিকে দলকে ঢেলে সাজাত তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট নতুন আঙ্গিকে হতো। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের আইনি কাঠামোর আওতায় বিচার শুরু হওয়ার পর, জামায়াতের রূপান্তর ইতিবাচক হয়নি। জামায়াত নিজের অপকর্ম থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ নেয়নি। বরং জামায়াত পরিবর্তিত হয়ে ’৭১-এর ঘাতকদের অবস্থানে চলে যায়। ’৭১-এ তারা নরহত্যা, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করেছে প্রকাশ্যে আর ২০১০ থেকে জামায়াত একই কাজ শুরু করল চোরাগোপ্তা পথে। ক্রমশ জামায়াত পরিণত হলো জঙ্গি সংগঠনে। জামায়াত রূপান্তরিত প্রক্রিয়ায় এখন একটি জঙ্গি, সন্ত্রাসী সংগঠন। রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে জামায়াতের কোনো কাজকর্ম নেই। জামায়াত এখন গুপ্তহত্যা, জ্বালাও-পোড়াও এমনকি ব্যাংক ডাকাতির মতো সন্ত্রাসী তত্পরতার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছে। আইএস বা বোকো হারামের মতোই জামায়াত তাদের অস্তিত্ব জানান দেয় কিছু সন্ত্রাসী তত্পরতা করে।

 

 

অন্যদিকে জামায়াতের প্রধান মিত্র বিএনপি জামায়াতের এ অস্তিত্বের সংকটে হতবিহ্বল। ১৯৯৮ সাল থেকেই বিএনপি জামায়াতের সহবাস। ২০০১ সালে বিএনপি বিপুল বিজয়ে ক্ষমতাসীন হয়। এ সময় জামায়াত বিএনপির মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ে। জামায়াতই বিএনপিকে গ্রাস করে ফেলে। তাই, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও জামায়াতি আদর্শ বাস্তবায়িত হতে থাকে রাষ্ট্রের পরতে পরতে। প্রশাসন, শিক্ষা, অর্থনীতি, পররাষ্ট্র নীতি এরকম সর্বক্ষেত্রে জামায়াতি এজেন্ডা বাস্তবায়িত হতে থাকে। অবশ্য বিএনপি এবং তাদের প্রধান ক্ষমতা কেন্দ্র হওয়া ভবন শুধু ব্যস্ত ছিল দুর্নীতি এবং অর্থ উপার্জনে। বিএনপির মূল নেতা তারেক রহমানের তত্ত্ব ছিল, ‘মানি ক্যান বাই এভরিথিং’। বিএনপির দেশ শাসনের দর্শন ছিল পরিষ্কার, টাকা বানাও। বিএনপি বিশ্বাস করা শুরু করে, টাকা দিয়ে ক্ষমতায় থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা সম্ভব। বিএনপি ২০০১ সাল থেকে ক্রমশ আদর্শ বিবর্জিত একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেন আসার পর বিএনপি টাকা তত্ত্ব হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। এ সময় বিএনপি আরও বেশি জামায়াতনির্ভর হয়ে পড়ে। ২০০৮ এর নির্বাচন বিপর্যয়ের পর বিএনপি আস্তে আস্তে জামায়াতে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুতে বিএনপি পুরোপুরি জামায়াতে পরিণত হয়। এখনকার যে বিএনপি সেটা ডানপন্থি কোনো গণতান্ত্রিক দল নয় বরং চরম দক্ষিণপন্থি একটি মৌলবাদী সংগঠন। জামায়াতের এক নব্য সংস্করণ। এটা প্রমাণের জন্য বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই, মুক্তিযুদ্ধ, শহীদের সংখ্যা নিয়ে বেগম জিয়া ও তার সুপুত্রের বক্তব্যের মধ্যেই বিএনপির জামায়াতিকরণের পরিচয় মেলে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে পুরনো এবং বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের বিবর্তন এবং রূপান্তর এতকাল ছিল প্রগতির পক্ষে ইতিবাচক। কিন্তু এখন কি তাই? আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে জন্ম নেওয়া দলটি ’৫৬ সালে সেকুল্যার রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। গা থেকে সাম্প্রদায়িক চাদরটা নামিয়ে ফেলে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একটি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল জনগণের রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বিকশিত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ‘সমাজতন্ত্র’কে ধারণ করে আওয়ামী লীগ প্রগতির ধারায় আরও একধাপ এগিয়ে যায়। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে শুধু ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ করেনি বরং সমাজ কাঠামোয় এর বিকাশের জন্য একটি সাংস্কৃতিক বাতায়ন তৈরিতেও কাজ করেছে। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের রূপান্তর আর প্রগতির ধারায় এগোয়নি বরং ক্রমাগত আওয়ামী লীগ রক্ষণশীলতা এবং দক্ষিণপন্থাকে আলিঙ্গন করেছে। ১৯৯১ এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের পর আওয়ামী লীগ আরও ধর্মের দিকে ঝুঁকতে থাকে। আওয়ামী লীগ নতুন স্লোগান তৈরি করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ’।

আওয়ামী লীগের নেতারা কতটা ধার্মিক, নামাজি তা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ধর্মচর্চা করা কোনো গর্হিত কাজ নয়, কিন্তু লোক দেখিয়ে প্রদর্শনী করে ধর্মচর্চা কোনো শুভ বুদ্ধির কাজ নয়। আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের প্রধান নেতা, দলের সভাপতি শেখ হাসিনাকে ধার্মিক, ইসলাম পছন্দ একজন ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এক উগ্র প্রচেষ্টা শুরু করে। শেখ হাসিনা তাহাজ্জতের নামাজ পড়েন, তিনি সকালে কোরআন পড়েন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন ইত্যাদি ধর্মীয় প্রচারণার আড়ালে হারিয়ে যায় শেখ হাসিনা একজন রবীন্দ্রভক্ত, অসংখ্য কবিতা তিনি অনর্গল আবৃত্তি করতে পারেন। রবীন্দ্র সংগীত তার প্রেরণা, তার দুঃখ তাড়ানিয়া। শেখ হাসিনা যে একজন সংস্কৃতিবান ব্যক্তি, তার শিল্পপ্রেম অনন্য— এই সত্যগুলোকে আওয়ামী লীগ সিন্দুকে তুলে রাখে। অথচ কোরআন তেলাওয়াত আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই— এ বোধ জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ অগ্রাহ্য করে। একটি সেক্যুলার সাংস্কৃতিক আবহ গড়ে তোলার যে কাজটি ’৫২ থেকে আওয়ামী লীগই একটি আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করেছিল, তার বিপরীতে আওয়ামী লীগই পাল উড়ায়। সে সময় আওয়ামী লীগের যুক্তি ছিল একরকম— ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট দেশটার মধ্যে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিষবাষ্প ছড়ানো হয়েছিল সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং  অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে সরাসরি প্রবেশ হতো আত্মঘাতী। এ যুক্তিটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার ছিল না।

’৮১-র ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর আওয়ামী লীগকে এক প্রতিকূলতার সাগর পাড়ি দিতে হয়েছে। আওয়ামী লীগকে অনেক কুৎসা এবং অপপ্রচার মোকাবিলা করতে হয়েছে। এসব আক্রমণের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল ধর্ম। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ভারতের দখলে চলে যাবে, হিন্দু রাষ্ট্র হবে, মসজিদে মসজিদে উলুধ্বনি হবে— ইত্যাদি গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। এসব অপপ্রচারকে পায়ে মাড়িয়েই আওয়ামী লীগ ’৯৬-এ ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগের যুদ্ধ এক অর্থে সাম্প্রদায়িকতা, অপ-সংস্কৃতি, মৌলবাদের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতার যুদ্ধ। এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল উপজীব্য। ২০০৮ এর নির্বাচনে এদেশের মানুষ কেবল বিএনপি এবং ওয়ান-ইলেভেনের অনাচারের বিরুদ্ধে রায় দেয়নি বরং অসাম্প্রদায়িক এক বাংলাদেশের পক্ষেও তাদের রায় দিয়েছে। এ জন্যই আওয়ামী লীগ দায়িত্ব নিয়েই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজটি শুরু করে। অসম্ভবকে সম্ভব করেই এদেশের শীর্ষস্থানীয় চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী এবং নরঘাতকের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। যাদের কোনো দিন স্পর্শ করা যাবে না বলে মনে করা হয়েছিল তারাও বিচারের আওতায় এসেছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বিকাশের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল আওয়ামী লীগই সেই সম্ভাবনাকে সমাধি দিতে চলেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগের সামনে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। এ ব্যাপারে তাদের সামনে সুপ্রিম কোর্টের রায়ও ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে ‘বিসমিল্লাহ’ কিংবা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় গড়ে ওঠে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’। আওয়ামী লীগ প্রথমে গণজাগরণ মঞ্চকে সমর্থন দেয়। পরে যখন গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ আসে, আওয়ামী লীগ তার সমর্থন গুটিয়ে ফেলে। এমনকি একের পর এক ব্লগার হত্যার পরও আওয়ামী লীগকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, ভীতসন্ত্রস্ত মনে হয়। বাংলাদেশটা যে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, অবিশ্বাসী সবার এ সত্যকে আড়াল করতে আওয়ামী লীগ যে গলদঘর্ম করছে, তা অবিশ্বাস্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগ তার সেক্যুলার চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করতে পারেনি। প্রায়ই খবর আসে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও জামায়াত থেকে দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগদান করছে। ইউনিয়ন পরিষদে ৪০ ভাগেরও বেশি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছে জামায়াত-বিএনপি থেকে আসা লোকজন। দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ। এক পক্ষ হলো আসল আওয়ামী লীগ, যারা জীবনভর আওয়ামী লীগের জন্য সংগ্রাম করেছে, জেল খেটেছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে। আর এক পক্ষ হলো নকল আওয়ামী লীগ যারা বিএনপি ও জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে এসে ঠাঁই নিয়েছে। কোথাও কোথাও এরাই শক্তিশালী। তাই এখন দেশে আওয়ামী লীগের অভাব নেই। কিন্তু এ আওয়ামী লীগ কি বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ?

এ প্রশ্নের একটা ভালো উত্তর পাওয়া যাবে এবারের পাঠ্যপুস্তকে। এ পাঠ্যপুস্তকে যেভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো হয়েছে এটা যদি অন্য কোনো দল করত তাহলে আওয়ামী লীগ কি প্রতিক্রিয়া দেখাত? এ পাঠ্যপুস্তক প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ আপস করতে করতে তার আসল চেহারাই হারিয়ে ফেলেছে।

সন্দেহ নেই, দেশ উন্নত হচ্ছে। উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আদর্শ ও চেতনাহীন উন্নয়ন আসলে কতটা টেকসই সে এক কোটি টাকার প্রশ্ন। ত্রিশ লাখ শহীদ যে স্বপ্ন নিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছিল, সেই স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে কি আমরা এগোচ্ছি, নাকি চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে জাতির ওজন বাড়ানো হচ্ছে।  ফুলেফেঁপে ওঠা মানেই সুস্বাস্থ্য নয়, মেধা, মননের বিকাশই আসল স্বাস্থ্য।

গত আট বছরে জামায়াত জঙ্গি সংগঠন হয়েছে। বিএনপি হয়েছে জামায়াত, আর আওয়ামী লীগ হচ্ছে বিএনপি। রূপান্তরের ধারায় উন্নয়নের মহাসড়কে যে দেশটি এগিয়ে যাচ্ছে সেটি কি আমার সোনার বাংলা?  সবার বাংলাদেশ? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ইমেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর