রবিবার, ২২ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

খালেদা-তারেককে অযোগ্য ঘোষণা করে নির্বাচন!

কাজী সিরাজ

খালেদা-তারেককে অযোগ্য ঘোষণা করে নির্বাচন!

আমাদের দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারি দলের সঙ্গে প্রতিপক্ষ বিরোধী দলের দ্বন্দ্ব পুরনো। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও সরকারি দল-বিরোধী দলের দ্বন্দ্ব-বিরোধ স্বাভাবিক বিষয়। তবে আমাদের দেশে তা অনেক সময় গণতান্ত্রিক-সাংবিধানিক সব সীমা লঙ্ঘন করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপান্তরিত হতেও দেখা যায়।  দুই তরফ থেকেই পরিস্থিতিটা সৃষ্টি করা হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থায় জনগণের বাক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের ও সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতা, সংগঠন করার স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ করার এবং তাতে যোগদানের স্বাধীনতা, নিজের পছন্দমতো প্রতিনিধি নির্বাচনের স্বাধীনতা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সত্পথে আহরিত সম্পদ সুরক্ষার স্বাধীনতাসহ অনেক মৌলিক অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু দেশে যদি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং তদস্থলে  কর্তৃত্ববাদী শাসন চেপে বসে তখন সে দেশে মানুষের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ পদদলিত হয়।

শাসকরা ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার অশুভ লক্ষ্যে এসব অধিকার কেড়ে নেয়। তখন সরকারের প্রতিপক্ষ গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে অবতীর্ণ হলে শাসকরা মারমুখো হয়, দলন-পীড়নের আশ্রয় নেয়। রাজনীতি তখন সহিংস রূপ নেয়। আমাদের দেশেও আমরা তা প্রায়শ প্রত্যক্ষ করি। সরকারের আক্রমণ তীব্র হলে বিরোধী পক্ষের আন্দোলনের চরিত্রও স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সীমানা অতিক্রম করে। আবার একটি জনপ্রিয় সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সাফল্য অর্জনে বারবার ব্যর্থ বিরোধী দল চরম হতাশা থেকে সহিংস পথ অনুসরণ করে সরকারকে কাবু করতে চায়, ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন ভুল পথে পূরণ করতে চায়। তাতে জনগণের সাড়া মেলে না, কিন্তু সর্বসাধারণের দুর্ভোগ বাড়ে। দেশে বিরোধী দলের কারণেও অস্বাভাবিক ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই বন্ধ্যা। সত্য বটে, সরকারের কঠোর মনোভঙ্গির কারণে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এখন কোণঠাসা। সরকার যেমন তাদের সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভে ক্ষমতা ও শক্তি প্রয়োগ করছে, দাঁড়াতে দিচ্ছে না তাদের; বিএনপিও সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের জন্য সরকারি অনুমতি প্রার্থনা করে তাদের দায়িত্ব খালাস করছে। সরকারি প্রত্যাখ্যানের মুখে নিজেদের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সক্ষমতাও দেখাতে পারছে না। এখানে সেখানে নালিশ-শালিসেই সীমাবদ্ধ তারা। কারও মারমুখী আচরণ আর কারও  আবেদন-নিবেদন রাজনীতিকে শাসকদলের কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখলেও স্বস্তি কিন্তু নেই কারও মনে। এমন পরিস্থিতিতে অস্বস্তি ভয়ঙ্কর কোনো বিস্ফোরণের পূর্ব লক্ষণ বলেও বিবেচিত হয়। আমাদের দেশের জনগণ অনেক উন্নত দেশের জনগণের চেয়েও অধিক সচেতন। তারা লক্ষ্য করছে যে, দেশে একদলীয় আইনানুগ ব্যবস্থা বলবৎ না থাকলেও একদলীয় রাজনীতিই চলছে। চারদিকের দেয়ালে, লাইটপোস্টে, খাম্বায়-তারকাঁটার বেড়ায়, ফ্লাইওভারের খুঁটিতে-ছাদে যে দিকে তাকাবেন শুধু সরকারি দলের ‘নওজোয়ানদের’ ছবি ছাড়া কিছু দেখবেন না। সব তাদের দখলে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বলুন আর অন্য কোনো মাঠ-ময়দান বলুন, সরকারি দল বা তাদের বি.টিম-সি.টিমের সভা-সমাবেশ আর রাজপথ দখল করে তাদেরই মিছিল দেখবেন। অর্থাৎ একদলের রাজনীতি। প্রতিপক্ষ মাঠে না থাকলে বা তাদের শক্তি প্রয়োগ করে মাঠে নামতে না দিলে রাজনৈতিক ময়দান সরব-উষ্ণ থাকে না। তখনই বলা হয় বন্ধ্যা রাজনীতির নিস্তরঙ্গ শান্ত পরিস্থিতি। যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা কিছুদিন এর সুবিধা ভোগ করেন ঠিক, কিন্তু তা চিরস্থায়ী তো হয়ই না, দীর্ঘস্থায়ীও হয় না। মানুষ সব বোঝে। বাংলাদেশের মানুষ বোঝেন একটু বেশি— যা আগেই উল্লেখ করেছি। এ দেশের মানুষ শান্তি ও সমঝোতাপ্রিয়। অপছন্দের বিষয় শান্তিপূর্ণ পন্থায় তারা বাতিল করতে চায়। কিন্তু বেশিদিন সে পথ আগলে রাখলে সেই শান্ত স্বভাবের মানুষই সব বেড়া-দেয়াল উপড়ে ফেলে। এ মুহূর্তে সংকট যা আছে মানুষ তা জানে ও বোঝে। কেউ যদি ভাবেন যে, মানুষ কিছু বুঝতে পারছে না, তারা ভুল করছেন। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার জনগণের ইচ্ছায় রাষ্ট্র শাসন করছেন বলে যত বড় গলায়ই দাবি করা হোক না কেন, ইতিমধ্যে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ ছিল বলে প্রচ্ছন্নে-পরোক্ষে স্বীকার করে নেওয়ার পর এ সরকারের রাষ্ট্রশাসনের পক্ষে যে দেশের সংখ্যাধিক মানুষের সম্মতি নেই তা বোঝা যায়। বিরোধী দল বিএনপিতো তা বলেই চলেছে। তাদের মতে সে নির্বাচনে ভোট দিয়েছে মাত্র ৫% ভোটার। বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন ৪০% ভোট কাস্ট হয়েছে বলে সার্টিফিকেট দিলেও দেশ-বিদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা তা সত্য  বলে  মেনে  নেয়নি। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে চিন্তাটাই  প্রবল। বলা যায়, দেশের নিস্তরঙ্গ, বন্ধ্যা একদলের রাজনীতির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে বহুদলীয় আলোচনায় রাজনীতি নতুন করে প্রাণ পেয়েছে। বিশেষ করে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠন উপলক্ষে সার্চ কমিটি কীভাবে গ্রহণযোগ্যভাবে করা যায় তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আলোচনা সর্বসাধারণের মধ্যে এক ধরনের আশাবাদ জাগ্রত করেছে। আগামী নির্বাচনটি ২০১৪ সালের জানুয়ারির মতো প্রশ্নবিদ্ধ হোক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যে তা চান না স্বয়ং তা পরিষ্কার করেছেন। অপরদিকে সরকারের আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে অনীহা এবং বিএনপির প্রতি চরম অবহেলার পরও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সার্চ কমিটি গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির আলোচনায় বিএনপির আগ্রহ ও অংশগ্রহণ এবং ইতিবাচক ভূমিকা মানুষের আশার জায়গাটাকে আরও জোড়ালো করেছে। আরও একটা বিষয় এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগের সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিষয়টি যেভাবে প্রচার পেয়েছে এবং সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বেশ গুরুত্ব পেয়েছে তাতে কারও মনে এমন ধারণা সৃষ্টি হতে পারে যে, রাষ্ট্রপতি তার নিজস্ব ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারবেন। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে ‘... প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন’ বলা থাকলেও সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতাকে ‘দুর্বল’ করে রেখেছে।

 

 

তাতে বলা আছে, ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন’। এ থেকে এটা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, নির্বাচন কমিশন গঠন উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি যা করছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমেই করছেন। অর্থাৎ সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক তা প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন। শাসক দলের পক্ষ থেকে বেশ কবার বলা হয়েছে যে, এ সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত তারা মেনে নেবেন। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ তো আওয়ামী লীগেরই নেতা ছিলেন; সাতবার নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তাদের সংসদ সদস্যদের ভোটেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি কি লীগ সরকার ও শাসক লীগের স্বার্থ পরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন? প্রশ্নটি মোটেই অবান্তর নয় ঠিক, কিন্তু পাশাপাশি এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। সে বিষয়টি হচ্ছে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে বিষয়টি আমাদের জাতীয় বিষয় হলেও তা এখন আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন বাংলাদেশে হোক আমাদের কোনো মিত্র দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীও তা চাইছে না বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রকাশ্য বক্তব্য-পরামর্শ থেকে তা স্পষ্ট হয়েছে। আন্তর্জাতিক মনোভঙ্গিরই প্রকাশ ঘটেছে প্রধানমন্ত্রীর ‘পরবর্তী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হোক তা চাই না’— এই খোলামেলা উচ্চারণ থেকে। বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলও একটি অবিতর্কিত নির্বাচন চায়। তেমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপি তাতে যে অংশগ্রহণ করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পরপর দুবার জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলে নির্বাচন কমিশনে দলটির নিবন্ধন সংকট ও মার্কা হারানোর সমস্যা ছাড়াও তাদের আরও সাংগঠনিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা আছে। তাদের জনসমর্থন তথা ‘কোর’ ভোটে এখনো সরকার ফাটল ধরাতে পারেনি— নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে অসম প্রার্থী দিয়েও প্রায় এক লাখ ভোট পাওয়া তার প্রমাণ। তবে মামলা-মোকদ্দমা, জেল-জুলুম, গুম-অপহরণ আতঙ্ক ছড়িয়ে সরকার তাদের সংগঠনকে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে। নেতৃত্ব দুর্বল ও অদক্ষ বলে প্রমাণিত। এমতাবস্থায় আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দলটি আবার ‘প্রাণ’ ফিরে পেতে পারে। সে জন্য একটি উপযুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিতে তারাও সমানভাবে আগ্রহী। তারা মনে হয় এমন কোনো অভিযোগের জন্ম দিতে চায় না যাতে সরকার আবারও একতরফা কিছু করে ফেলে। বলা যায়, এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা থেকেই রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা এবং সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক সুযোগ সম্পর্কে জেনে-শুনেই নির্বাচন কমিশন গঠনকল্পে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগকে ফলপ্রসূ করতে বিএনপি একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। শাসক দল এবং মাঠের মূল বিরোধী দল উভয়েই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে চায় বলে প্রতীয়মান হয়। পরবর্তী নির্বাচনও যদি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনের মতো বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। তেমন একটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে সে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যিনিই বাইরে যাবেন তিনিই অসহযোগিতা ও অসম্মানের সম্মুখীন হবেন, বাংলাদেশও বিশ্বদরবারে মর্যাদা হারাবে। এটা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী চান না। নির্বাচন কমিশন গঠন উপলক্ষে রাজনৈতিক দলসমূহের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি সংলাপ বা আলোচনার যে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করলেন তা সম্পূর্ণই আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই এতটা গুরুত্ব পেয়েছে। যে বাক্যটি দিয়ে লেখাটা শুরু করেছি, সে প্রসঙ্গে যেতে চাই। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখের মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। একদিকে ধরতে গেলে এটা একটা রুটিন কাজ। একটি কমিশনের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হলে নতুন কমিশন গঠিত হবে, এটা স্বাভাবিক। এর আগেও তা হয়েছে। কিন্তু এবার তা নিয়ে যত অনুকূল আলোচনা এবং রাষ্ট্রপতির বিশেষ বিবেচনা ইতিপূর্বে কখনো এমন লক্ষ্য করা যায়নি। ঘুরে ফিরে আবার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথাই আসছে। আগামী নির্বাচনটি যাতে অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য হয় সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। তেমন একটি নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন কমিশন। বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে সরকারবিরোধী সবাই বলছেন মেরুদণ্ডহীন, তাঁবেদার। আবার যদি তেমন দলানুগত একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় তাহলে আগামী নির্বাচনটি কেমন হবে সহজেই অনুমেয়। নতুন নির্বাচন কমিশনের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করবে আগামী সংসদ নির্বাচনটি সবার অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে কিনা। সবার অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটে না, সে সংসদ মর্যাদাশীল সংসদ হয় না। বিএনপি যদি নির্বাচন কমিশন নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করে এবারও নির্বাচন বর্জন করে তাহলে তাদের নিবন্ধন সংকটে পড়ার ঝুঁকি আছে। কিন্তু একটি দল যদি বলিষ্ঠ নেতৃত্বে, সাংগঠনিক শক্তিতে এবং সমর্থনে বলীয়ান হয়ে গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে পারে সে দলের জন্য নিবন্ধন সংকট তেমন বড় কোনো সংকট হিসেবে সব সময় বিবেচিত হয় না। গণ্য করার মতো শক্তি-সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে পারলে নিবন্ধনের কাগজ অফিসে পৌঁছে যাওয়াও বিচিত্র নয়। বিষয়টি সরকারও সিরিয়াসলি বিবেচনা করবে বলে মনে হয়। ঝুঁকিটা কোনো পক্ষই হয়তো নিতে চাইছে না। যে কারণে উভয় পক্ষকেই এ বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে নমনীয় মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রপতির সংলাপের সূচনা ও সমাপ্তি ভালোভাবেই হয়েছে। আলোচনায় সব পক্ষেরই আন্তরিকতার ছাপ লক্ষ্য করা গেছে। অর্থাৎ সবাই চেয়েছে এ আলোচনা ফলপ্রসূ হোক, একটি সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক। এর মানে একটি ভালো জাতীয় নির্বাচন হোক আগামীতে। শুরুর পর্ব শেষ পর্ব সম্পর্কে আমাদের আশাবাদী করছে। সবার কাছে শতভাগ না হলেও মোটামুটি মেনে নেওয়ার মতো একটি ইসি গঠিত হবে বলে সর্বত্র একটা আশাবাদ জেগেছে। রাষ্ট্রপতি সব রাজনৈতিক দলকে নিজেদের মধ্যে আলোচনার যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা অবশ্যই অর্থবহ। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম তার প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তা নাকচ করেছেন। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ অবস্থান পরিবর্তন করবে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। একটি অর্থবহ নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সমঝোতাও জরুরি। নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব, নির্বাচন-পরবর্তী আইনের শাসন পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতিতে সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদের ভিতরে-বাইরে কার্যকর ভূমিকাই প্রকৃত অর্থে একটি জাতীয় নির্বাচনকে অর্থবহ করে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সুসম্পর্ক, আলোচনা ও সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। আশা করা যায়, রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যেও আলোচনা-সংলাপ হবে। ওবায়দুল কাদের সাহেবের বক্তব্য নিশ্চয়ই তার ব্যক্তিগত, দলীয় বক্তব্য নয়।

এদিকে কথা উঠেছে, সরকার খালেদা জিয়ার জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার রায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। মামলার কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। যদি তার দুই বছরের বেশি জেল সাজা হয়ে যায় এবং তা উচ্চ আদালতেও বহাল থাকে, তাহলে তিনি মুক্তি লাভের পরবর্তী পাঁচ বছরও কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তারেক রহমান ইতিমধ্যেই একটি মামলায় সাত বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। দেশে এসে মামলা মোকাবিলা না করলে দণ্ড থেকে পরিত্রাণের কোনো সুযোগ নেই। সরকার হয়তো আশা করছে তাদের দুজনকে নির্বাচনের বাইরে রেখে আগামী নির্বাচন করা গেলে শাসক লীগ ভালো ফল করবে, আবারও তাদের ক্ষমতা নিশ্চিত হবে। কিন্তু তাতে হীতে বিপরীতও হতে পারে। বিএনপির পক্ষে জনগণের সহানুভূতি, সমর্থন আরও বেড়ে যেতে পারে। সরকারের উচিত হবে তেমন পথে পা না দেওয়া। জনগণ বিষয়টিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে বিবেচনা করবে। সরকারের উচিত হবে একটি ভালো নির্বাচন নিশ্চিত করা। সংলাপের মাধ্যমে আগেই ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর, নির্বাচন-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিজিত দলের সঙ্গে বিজয়ী দলের আচরণ, সংসদ সচল ও কার্যকর রাখা, দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ, দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখা ইত্যাদি বিষয়ে একটি সমঝোতা চুক্তিতে উপনীত হওয়া এখন খুবই জরুরি। রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সংলাপের জন্য রাষ্ট্রপতি যে পরামর্শ দিয়েছেন তা সবাই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলে লাভ হবে সবার, লাভ হবে জনগণের, সর্বোপরি লাভ হবে দেশের।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর