সোমবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

আমেরিকান ভোটারের সঙ্গে কথোপকথন

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

আমেরিকান ভোটারের সঙ্গে কথোপকথন

শাঁ করে দুটো গাংচিল মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেতেই আমি রাউজেস ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বিশাল বারান্দার একটি বেঞ্চের এক কোণায় বসে পড়লাম। আজ প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটা হয়েছে। শীতকাল হলেও নিউ অরলিনসের ঠাণ্ডাবিহীন রৌদ্রকরোজ্জ্বল আবহে এক ঘণ্টা হেঁটে একটু ক্লান্তি ভাব আসায় মাথার হ্যাটটা খুলে পাশে রেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা ১টা বাজে। তবে তাড়া না থাকায় আরও কিছুটা রিল্যাক্স মুডে বেঞ্চের ওপর গা এলিয়ে দেই। প্রশস্ত বারান্দায় বসে বহুবর্ণের মিশ্রণে পূর্ণ নারী-পুরুষের অনবরত গমনাগমন, সামনে খোলা নীল আকাশ আর পাশেই বিখ্যাত পঞ্চারট্রেইন লেকের গাংচিলদের দল বেঁধে ক্যা ক্যা করতে করতে এদিকে থেকে ওদিকে যাওয়া-আসার দৃশ্যে মনটা ভরে যায় বলে প্রতিদিন হাঁটার পর এখানে এভাবে ক্ষণিক বসে থাকি। এবার দেশ থেকে এসেছি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকান নাগরিক দুই মাস বয়সের নাতি ইহানকে সময় দেওয়ার জন্য। কিন্তু লিটল আমেরিকানের মেজাজ খারাপ হলে আমি অসহায় হয়ে পড়ি, কোনো কাজে আসি না। যা করার তখন তার নানীই করে। সুতরাং যে কাজের জন্য এসেছিলাম সেখানেও ডিসকোয়ালিফাইড। তাই আমার আর কোনো কাজ থাকে না। এর ফলে রবীন্দ্রনাথের সফলতা কবিতার একটা লাইন ইদানীং আমার মগজে সব সময় বিচরণ করে, ‘কর্মহীন আজ নষ্ট হলো বেলা, নষ্ট হলো দিন।’

 

 

আবার চিত্রা কবিতার কথাটিও অনুভূতিতে জাগে, ‘অকূল শান্তি, সেথায় বিপুল বিরতি।’ রেগুলার হাঁটাহাঁটিই বলা যায় এখন আমার একমাত্র কাজ। আমেরিকার দক্ষিণে অবস্থিত লুজিয়ানা স্টেটের নিউ অরলিনস অনেক বড় শহর। শহরের ভিতরের সব রাস্তা ছয় থেকে আট লেনের। ক্রিসক্রোস করছে সব কয়েক স্তরের ফ্লাইওভার। সব জায়গাতেই রয়েছে প্রশস্ত ফুটপাথ। আবাসিক এলাকাগুলো সুন্দর সব বাংলোতে লাইন ধরে সাজানো। তবে ফুটপাথ ধরে এক ঘণ্টা হাঁটলে দুয়েকজন মানুষের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। শহরে মানুষ আছে তা বোঝা যায় দুভাবে। প্রশস্ত সব রাস্তায় গাড়ির বহর দেখলে, আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এবং শপিং মলে গেলে। এ দুই কেনাকাটার জায়গায় গেলে আমেরিকানদের পার্সেজিং পাওয়ার এবং কনজাম্পশন পাওয়ারের পরিচয় পাওয়া যায়। স্বল্পোন্নত দেশের একজন নাগরিকের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি এবং ভাবি, এরা এত খায় আর এত পরে! আমেরিকান লোকজন আগ বাড়িয়ে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে হ্যালো বলার বাইরে বেশি কিছু বলে না। তবে ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। লেখার শুরুতে যেমনটা বলেছি, হাঁটা শেষ করে প্রায় প্রতিদিনের মতোই রাউজেস ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বারান্দায় রিল্যাক্স মুডে বসে আছি। ডানদিকে তাকিয়ে দেখি একজন বয়স্ক লোক বড় এককাপ কফির মগে পাইপ লাগিয়ে চুমুক দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। এ দৃশ্য আমেরিকাতে খুবই কমন। এদেশের ছেলেবুড়ো সবাইর জন্য কফি, আইসক্রিম আর চকোলেট থাকতেই হবে। একটু পরে দেখি বয়স্ক আগন্তুক ভদ্রলোক পাশে রক্ষিত খালি চেয়ারে না বসে হঠাৎ করে হ্যালো বলে আমার বেঞ্চের অপর কর্নারে বসে পড়ল। প্রত্যুত্তরে আমি হ্যালো বলা পর্যন্তই শেষ। দুয়েকবার তাঁর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি, পাশে খালি চেয়ার থাকা সত্ত্বেও পূর্বে যা দেখিনি সে এসে আমার বেঞ্চে বসে পড়ল কেন? ভাবতে ভাবতেই কোন ফাঁকে চোখে চোখ পড়তে সে জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘তুমি কোন দেশের লোক’? বলি বাংলাদেশের। এ মুহূর্তে আমি তাকে পাল্টা কিছু জিজ্ঞাসা করছি না এই ভেবে যে, তাতে না আবার এদেশের ভব্যতা ও সংস্কৃতির ব্যত্যয় ঘটে যায়। ভদ্রলোক নিজ থেকে আবার বলে ওঠলেন, শুনেছি বাংলাদেশে জঙ্গি সন্ত্রাসীদের নাকি খুব উৎপাত, তা এখন কী অবস্থা? এবার আমি বুঝতে পারি সে আমার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী। সঙ্কোচ ফেলে একটু দৃঢ়তার সঙ্গে বলি, তোমার ধারণাটা অর্ধেক সত্য। আমার উত্তরের স্টাইলে সে একটু আশ্চর্য হওয়াতে আরেকটু ভেঙে বলি যে, ‘দেশের ভিতর থেকে জন্ম নেওয়া কিছু জঙ্গি সংগঠনের তত্পরতা আছে। তবে সম্প্রতি আমাদের পুলিশ বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী সফল অভিযানের ফলে তারা এখন আর কোনো ঘটনা ঘটাতে পারছে না। দক্ষিণ এশিয়ায় জঙ্গি দমন ও নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। সে এবার আমার পরিচয় ও এখন কী করি জানতে পেরে সরাসরি প্রশ্ন করে, ‘আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল সম্পর্কে তোমার প্রতিক্রিয়া কী’? এবার সত্যিকারেই মনের ভিতরে কিছুটা সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ভাবি, সে আবার এফবিআই অথবা হোমল্যান্ড সিকিউরিটির কোনো এজেন্ট-টেজেন্ট কিনা। কী বলতে কী বলে আবার কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে না পড়ি। মনে মনে ভেবে নিই, অত্যন্ত সংযতভাবে, কূটনৈতিক কৌশলে মেপে মেপে উত্তর দিতে হবে। আমি বলি, আমেরিকার গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটের রায়কে আমরা শ্রদ্ধা করি এবং তোমাদের শুভ কামনায় প্রত্যাশা করি আগামীতে সব কিছু যেন ভালো হয়।’ ‘আমি বরাবরই রিপাবলিকান প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকি, তবে এবার কাউকেই ভোট দিইনি’, আমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে জানাল মাইক অ্যান্ডারসন। মাইক অ্যান্ডারসন একজন ভূ-তত্ত্ববিদ। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে অনেক আগে। তারপর থেকে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বিভিন্ন তেল কোম্পানি এবং ভূ-জরিপ সংস্থার সঙ্গে কনসালটেন্সি করে। ১৫-১৬ বছর হয় নিউ অরলিনস শহরে আছে। পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত এবং ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস চুক্তির একান্ত সমর্থক। বলল, ‘প্যারিস চুক্তির বিরোধিতা করায় ট্রাম্পকে ভোট দিইনি। আর হিলারি ক্লিনটনকে বিশ্বাস করা যায় না। কারণ, তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মিথ্যাচার করেছেন এবং ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের জন্য অনৈতিকভাবে দেশি-বিদেশি সংস্থা ও ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, যা আমেরিকান মূল্যবোধের বিসর্জন।’ মনের অজানা সন্দেহের কারণে কম কথা বলার চিন্তা থেকে আমি তার কথাই বেশি শোনার আগ্রহ দেখাই। অ্যান্ডারসন বলে যাচ্ছে, ‘২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি যদি বাস্তবায়ন না হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি ট্রাম্পের কথা মতো নিজেদের চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে সেটা সারা বিশ্বের জন্য মহাবিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যা থেকে আমেরিকাও রক্ষা পাবে না।’

২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট হারিক্যান ক্যাটরিনার ভয়ার্ত আঘাতে নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে অ্যান্ডারসন বলে, ‘সে এক ভয়ঙ্কর দিন ছিল নিউ অরলিনসের জন্য। এমন জীবন-মৃত্যুর সম্মুখীন আর কখনো হইনি। আমার নিজের ঘরের মধ্যে তিন ফুট পানি ওঠে যায়। বিদ্যুৎ নেই, টেলিফোনের লাইন নেই, মোবাইলে চার্জ নেই, গাছপালা ভেঙে চারদিকের রাস্তা বন্ধ। ঘর থেকে বের হতে পারছি না, উদ্ধারকারী আসতে পারছে না। প্রায় ২৪ ঘণ্টা না খেয়ে নিজের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ ছিলাম। ভেবেছিলাম আর বোধ হয় বাঁচব না।’ এ পর্যায়ে আমি বলি, ‘ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিনসের ক্যাম্পাসে নির্মিত ক্যাটরিনা স্মৃতিস্তম্ভ আমি দেখেছি।’ এতে অ্যান্ডারসন উৎসাহিত হয় বুঝতে পারি। ‘প্রকৃতির অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা আমি দেখেছি। তাই জলবায়ু-সংক্রান্ত গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের বাইরে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছু করতে পারবে না’, একটু জোরালো সুরে বলে অ্যান্ডারসন। তার কথার সূত্র ধরে আমি বলি, ট্রাম্পের মনোনীত সেক্রেটারি অব স্টেট রেক্স টিলারসন্স সিনেটের বৈদেশিক নীতিবিষয়ক কমিটির শুনানিতে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে একমত নন, বরং প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে থাকবেন টিলারসন্স। আমার কথা শেষ না হতেই অ্যান্ডারসন বলে ওঠে, ‘ইয়েস, আমি সে কথাই তোমাকে বলছি, ওভাল অফিসে বসার পর ট্রাম্প বাস্তবতার সম্মুখীন হবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান তো আছেই, তার ওপর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী এবং পারস্পরিক ক্ষমতার মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স রক্ষায় খুবই পারদর্শী। রিপাবলিকান দল, যার প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তাদেরও দীর্ঘদিনের একটা দর্শন আছে, তার বাইরে যাওয়া ট্রাম্পের পক্ষে কঠিন হবে।’ আমি জানতে চাই বারাক ওবামার আট বছর কেমন ছিল? প্রত্যুত্তরে বারাক ওবামাকে সে কখনো ভোট দেয়নি জানিয়ে বলে, ‘ওবামার জলবায়ু নীতিকে আমি সমর্থন করি এবং মন্দা কাটিয়ে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তার সাফল্য প্রশংসনীয়। ওবামা কেয়ার নামে পরিচিত স্বাস্থ্য নীতিকেও আমি সমর্থন করি। ট্রাম্প ও রিপাবলিকান দলের পক্ষ থেকে ওবামা কেয়ার বাতিল করার উদ্যোগ দুঃখজনক।’ এত সময়ে বুঝতে পারি রিপাবলিকান দলের সমর্থক হলেও অ্যান্ডারসন কট্টর ডানপন্থার মানুষ নয়। তবে ওসামা বিন লাদেনকে ফিনিশ করতে পারা ওবামা প্রশাসনের বড় কীর্তি। আর ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তিতে তার সমর্থন নেই বলে মত প্রকাশ করে এত সময়ে পাশে বসা আমার ক্ষণিকের অতিথি। ২০১২ সালে লিবিয়ার বেনগাজীতে জঙ্গিদের হাতে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নিহত হওয়ার ঘটনার জন্য তখনকার সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারিকেই সবাই দায়ী করেছেন, যার নেতিবাচক প্রভাবে হিলারির ভোট কমেছে বলে মনে করে অ্যান্ডারসন। আরেকটি বিষয়ে জানার ইচ্ছা থেকে আমি জিজ্ঞাসা করি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কেমন যাবে? অ্যান্ডারসন, ‘এ বিষয়ে ট্রাম্প অনেক কথাই বলেছেন। তবে তার কথার মধ্যে স্ববিরোধিতা রয়েছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ওঠা-নামা করলেও ব্যবসায়ীদের চাপে একটা ভারসাম্য বজায় থাকবে বলে মনে হয়। তাইওয়ান ইস্যুতে চীন কোনোরকম ছাড় দেবে না। আর রাশিয়ার পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চাইলেও তা বেশিদূর এগোবে বলে মনে হয় না। কারণ, ইউরোপের ঐক্য নষ্ট হলে এবং ন্যাটো বাহিনীর শক্তি খর্ব হলে তা আখেরে আমেরিকার স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। দল হিসেবে রিপাবলিকানরা তাতে বাধা দেবে। আরও কথা বলতে চাইলেও আমি ওঠে দাঁড়ানোতে অ্যান্ডারসন বলে, ‘প্রার্থনা করি যাতে আমাদের আরেকটি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির মতো ঘটনার সম্মুখীন না হতে হয়, রাশিয়ার গোয়েন্দা সূত্রে ভালো খবর আসছে না।’ অ্যান্ডারসনের সঙ্গে আমার কথা হয় ১৮ জানুয়ারি। ২০ তারিখ সকালে লেখাটি যখন শেষ করছি ততক্ষণে আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। অ্যান্ডারসনের মতো বিশ্বের অনেক মানুষই তাকিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা কেমন যাবে তা দেখার জন্য।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

নিউ অরলিনস, ইউএসএ

সর্বশেষ খবর