মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সবাই চলে যায়, যেতে দিতে হয়

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

সবাই চলে যায়, যেতে দিতে হয়

আলোর গতি শব্দের চেয়ে বেশি। কিন্তু তবু মানুষের মনের গতির সঙ্গে তার কোনো তুলনা চলে না। এ সংখ্যায় নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বিচার এবং তার পেছনের দিনগুলো নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি ভিন্নতর হওয়ায় ওসব নিয়ে লেখা হলো না। সেই কবে ১৯ অক্টোবর ২০১৫ কালিহাতী উপনির্বাচন নিয়ে হাইকোর্টে গিয়েছিলাম। নানা হাটঘাট ঘুরে গত ১৮ জানুয়ারি ২০১৭ সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি খারিজ হয়েছে। কত বছর কোর্ট-কাচারিতে যাতায়াত, যদি বুঝতাম কেন খারিজ হলো সান্ত্বনা পেতাম। কিন্তু কেন যেন ব্যাপারটার কিছুই বুঝলাম না। কোর্ট-কাচারির ওপর ভরসা না করে উপায় কী? নিজের ওপর আঘাত এলেই ভরসা করব না বা আস্থা রাখব না—এটা কেমন কথা? তাই বিচার মেনে নেব। যদিও ওই দিনই কেউ কেউ মিছিল করতে চেয়েছিল। তাদের বারণ করেছি। তাদের বলেছি, ওটা আমার বা আমার দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কাজ নয়। ওসব আওয়ামী বা বিএনপির কাজ। যেহেতু রিভিউয়ের সুযোগ আছে তাই করব। জানি এর মধ্যে তড়িঘড়ি নির্বাচন করে ফেলার চেষ্টা করবে। তা করে করুক। আমার কাছে নির্বাচন মুখ্য নয়, আমার কাছে বিশুদ্ধ বিচার বা আইনের শাসন এবং সরকারি প্রভাবমুক্ত নির্বাচন মুখ্য। ছেলেবেলায় শুনেছিলাম ১০ কোপে লাঙ্গল, এক কোপে চলা—দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়।

বহু দিন পর এই প্রথম ভীষণ মনোকষ্ট নিয়ে লিখছি। জীবনে যেমন সৌভাগ্যের দেখা পেয়েছি, তেমনি দুর্ভাগ্যেরও কম মোকাবিলা করিনি। জন্মের আগেই দাদা চলে গেছেন। আমার জন্ম পাকিস্তান জন্মের কিছুদিন আগে। তারও কয়েক বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু বা তার আগে দাদা আলাউদ্দিন সিদ্দিকী মারা যান। আমার বাপ-চাচারা পাঁচ ভাই দুই বোন। বাবার চার ভাই দুই বোন অন্যপক্ষের। বাবাকে দুই-আড়াই বছরের রেখে তার মা মারা যান। ফুফু, চাচারা যে আমার বাবার সতাল ভাইবোন তা বুঝতেও আমাদের অনেক সময় লেগেছে। বুঝেও কোনো লাভ-ক্ষতি হয়নি। তাদের আপন চাচা ফুফুর মতোই পেয়েছি। দাদা-দাদি দেখিনি, মায়ের দিকে নানা দেখলেও নানী দেখিনি। শ্বশুর-শাশুড়িকে আত্মীয় হিসেবে দেখিনি। নাসরিনের সঙ্গে বিয়ের আগেই তারা দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে যান। তাই বিয়ে করেছিলাম এক এতিম মেয়েকে। বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়স্বজন বলতে তেমন কেউ ছিল না, এখনো তেমন নেই। বড় ছেলে ফারুক কোরায়েশী টাঙ্গাইলে বিয়ে করেছেন। শ্বশুরবাড়ির পরিচয় দেওয়ার মতো তেমন কিছু নেই। মেজ ছেলে ফিরোজ কোরায়েশী কুমিল্লাতে—উল্লেখ করার মতো নয়। ছোট ছেলে ফেরদৌস কোরায়েশী কটু ৫০-৫৫ বছর পেরিয়ে গেলেও বিয়ে করেনি। মেয়েদের দিক থেকে বড়জনের বিয়ে হয়েছে শেরপুরে বাছুর আগলার এ কে এম শহিদুল হকের সঙ্গে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ১-২ বছর আগে। তারা মোটামুটি ভালোই ছিলেন, এখনো আছেন। নানা উজান-ভাটির পর দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ে হয় আমার সঙ্গে। এমন সাদামাটা মানুষ খুব একটা হয় না। তার না আছে সাজগুজের শখ, না সোনা-দানা, গাড়ি-বাড়ি, ভবিষ্যৎ চিন্তা, কিছুই নেই। মেয়েরা বাবার বাড়িতে যেমন থাকে, আমার ঘরে এসেও বাড়িটাকে স্বামীর বাড়ি না ভেবে মনে হয় বাপের বাড়ি ভাবেন। গ্রামগঞ্জে অনেক স্ত্রী দেখেছি, তারা কীভাবে তাদের সংসার আগলে থাকে। আমার স্ত্রী এক সময় স্ত্রী ছিলেন না। দুই সন্তান হওয়ার পরও পরিপূর্ণ মা ছিলেন না। কুশিমণি আসার আগে মায়ের অনুভূতি তার মধ্যে পাওয়া যেত না। এখন পরিপূর্ণ স্ত্রী না হলেও একজন পূর্ণাঙ্গ মা হয়েছেন। চাই চাই চাই এসব কিছু তার নেই। সেদিক থেকে বেশ ভালো আছি। লোকজনের প্রতি মায়া-মমতা অসাধারণ। সেটা ধনীর চেয়ে গরিবের প্রতিই বেশি। পেটের ছেলে একটা হলেও সাপওয়ালা, বাঁশিওয়ালা, মাছওয়ালা, আম পাড়া, জাম পাড়া, ডাব পাড়া কত ছেলে তার। আমারও রাস্তাঘাটের অনেক ছেলেমেয়ে, তারও তেমনি ছেলেমেয়ের অভাব নেই।

 

 

কয়েক বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে আমরা টাঙ্গাইল আসি। আমার শাশুড়ি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়াতেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে সব কিছু ফেলে কলকাতা চলে এলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাধ্যমে রণদা প্রসাদ সাহা তাকে কুমুদিনী কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়ে আসেন। পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র কুমুদিনী মহিলা কলেজ। শতেক-দেড়শ মেয়ের লেখাপড়ার ব্যবস্থা। পঞ্চাশের দিকে এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তারা টাঙ্গাইল আসেন। আমার স্ত্রীর জন্ম টাঙ্গাইলে। কুমুদিনী কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে সারা শহরে তখন তাদের মর্যাদাই আলাদা। আমরা যখন একটু একটু বড় হই, তখন দেখতাম কোনো বড় কেউ টাঙ্গাইল গেলেই হয় আমার শাশুড়ি তাদের সঙ্গে দেখা করতেন অথবা তারা কুমুদিনী কলেজে গিয়ে দেখে আসতেন। এক সময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন জাকির হোসেন। তাকে যেমন দেখেছি, কুখ্যাত গভর্নর মোনয়েম খানকেও দেখেছি, কত মন্ত্রী দেখেছি কুমুদিনী কলেজে। এখন মাননীয় মন্ত্রীদের রাস্তাঘাটে অগণিত পাওয়া যায়, তেমন সম্মানও নেই। কিন্তু তখন দারুণ সম্মান ছিল। শুধু মন্ত্রী নয়, পূর্ব পরিচয়ের কারণে প্রধানমন্ত্রী হয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কুমুদিনী কলেজে এসেছিলেন। বড় বড় অনেকে আসতেন কলেজে, নানা ধরনের অনুষ্ঠান হতো। ছোট হিসেবে আমরাও যেতাম, দেখতাম। আনন্দে আনন্দে দিন কেটে যেত। কলেজ থেকে ১০০ গজের মধ্যে আমাদের বাড়ি। প্রত্যেক দিন সকালে পলানদা বাজার করতে যেত। ৮০-৯০ জনের বাজার করা হতো। নিকারিরা যেমন ঝাঁকা মাথায় মাছ নিয়ে যেত বাজারে বিক্রি করতে, ঠিক তেমনি ঝাঁকাভর্তি কলেজের বাজার হতো। রুই মাছ হলে ৭-৮ কেজি ওজনের ৫-৬টি, ইলিশ মাছ হলে বড় বড় ২০-২৫টি, অন্যান্য মাছ হলেও একই রকম। মাছ-মাংস সব দিনই থাকত। আমি অবাক হতাম। আমাদের বাড়ির পশ্চিমে আবদুল মান্নান মিয়া কলেজে নিয়মিত দুধ দিত। মনে হয় ৩৫-৪০ সের দিত প্রতিদিন। হোস্টেলে থাকা প্রত্যেক মেয়ের জন্য গরুর দুধ খাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। সুরুজ, আইসড়া, ঘারিন্দা বাজার থেকে ৪ আনা সের দুধ কিনে ৮-১০ আনা সের বেচে তার প্রচুর লাভ হতো। মান্নান মিয়া ছিলেন বাসাইলের জশিহাটির মানুষ। কপর্দকহীন টাঙ্গাইলে এসে প্রথম মনোহারি দোকান খুলেছিলেন। তারপর বাবা বলে দেওয়ায় কুমুদিনী কলেজের দুধের কাজ পান। দোকানের চেয়ে তার দুধেই লাভ ছিল বেশি। আর সময়ও খুব একটা লাগত না। সকালে ৮-৯টার মধ্যে দুধ দিয়ে সারা দিন দোকানপাট অন্য কাজ করতেন। ২-৪ বছর পর দেখা গেল আমাদের বাড়ির কয়েক বাড়ি পশ্চিমে তিনি একটা বেশ সুন্দর বাড়ি করেছেন। ডোয়া পাকা টিনের ঘর। দুধে লাভ হওয়ার পেছনে কারণ ছিল একে তো যে দামে কিনতেন তা চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি দামে বেচতেন। এ ছাড়া মাপের ছিল আলাদা সুবিধা। ঘারিন্দা, সুরুজ, আইসড়া, বরুল্যা, ভুক্তা এসব এলাকার বাজারে মাপ ছিল ১০৫ মানে ১০৫ তোলায় সের। আর শহরে ৮০ তোলায় সের। ওখানেই প্রতি সেরে ২৫ তোলা লাভ হতো। এতে তার ভালো পুষিয়ে যেত। সে কারণে স্বাধীনতার আগেই তার অবস্থা বেশ সচ্ছল হয়েছিল। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি উত্তরপ্রদেশের মানুষ হওয়ায় পোলাও-কোরমা ছাড়া তেমন কিছু খেতেন না। তাদের বাড়িতে রুটি-পরোটা সব সময় থাকত। আবদুল হামিদ কোরায়েশীর বাড়ির রাবনের চুলা কখনো বন্ধ হয়েছে বা আগুন নিভেছে আমি খুব একটা দেখিনি। ৩-৪ জন রান্নার লোক, ৪-৫ জন কাজের মেয়ে, গরু রাখা, ঘাস কাটা, বাগান দেখার জন্যও আরও ৩-৪ জন। সময় পেরিয়ে গেলে সত্য বললে অনেকেই তা সহ্য করতে পারে না। সাবালিয়ার লাকী বিড়ির মালিক জয়নাল মিয়া আমার শ্বশুরবাড়িতে বহু বছর আনন্দের সঙ্গে গরু লালন-পালন করেছেন। গরুর রাখাল ছিলেন। আমি ছিলাম আমাদের নিজেদের গরুর রাখাল আর লাকী বিড়ির মালিক ছিলেন আমার শ্বশুরবাড়ির গরুর রাখাল। জয়নাল মিয়া যতদিন বেঁচেছিলেন আমার স্ত্রী এবং তার ভাই-বোনদের কি যে সম্মান করতেন তা লিখে বোঝাতে পারব না।

এই রাজকীয় পরিবার স্বাধীনতার পর আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়ে ডুবতে থাকে। কারণ স্বাধীনতার আগে আমার শাশুড়ি কুমুদিনী কলেজ থেকে এবং খাতাপত্র দেখে যে টাকা পেতেন, আমার শ্বশুর শায়েরি করতেন মানে (হিন্দি কবি) আর রেশন সপ চালিয়ে যা উপার্জন করতেন তার ৪ ভাগের এক ভাগও খরচ হতো না। মাসে হাজার টাকা জমা থাকত। এই এক পরিবার যারা এক পয়সাও উপরি খায়নি বা পায়নি। যখন তাদের হাতে মাসে হাজার টাকা থাকত তখন জার্মান ভক্সওয়াগন গাড়ির দাম ছিল ৬-সাড়ে ৬ হাজার, ৫৫-৬০ মডেলের টয়োটা কারের দাম ছিল ১৭-১৮ হাজার টাকা। সেই মানুষরা স্বাধীনতার পর জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়েন। আমার শাশুড়ি ’৮৩ সালে অবসরে যান। তার আগেই প্রিন্সিপাল হিসেবে তার রোজগারে ভালোভাবে সংসার চলছিল না। পরে তো আরও নয়। এরকম অবস্থায় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে ’৮৪ সালের ২৫ জুন নাসরিনের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বঙ্গবন্ধু মারা না গেলে, আমি নির্বাসিত না হলে নাসরিনের সঙ্গে আমার বিয়ে হতো না। নাসরিন আমার স্ত্রী হতে পারে এটা ঘুমের ঘোরে স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু হয়ে গেছে। নাসরিনের মাধ্যমেই এই পরিবারের সঙ্গে আমার বৈবাহিক সম্পর্ক। আমরা এক পাড়ার বাসিন্দা। আমাদের বয়সের পার্থক্য ৯-১০ বছর। শুরুতে যে কারণে বলেছিলাম শব্দের চেয়ে আলোর গতি, আলোর চেয়ে মনের গতি দ্রুত। মনের দুর্বার গতির চেয়ে আরও কোনো দ্রুতগতির কিছু আছে কিনা আমার জানা নেই। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে শব্দ বা আলো যেতে হয়তো সময় লাগে। কিন্তু কোথা থেকে কোথায় মন চলে যায় তার জন্য কোনো সময় লাগে না।

মনটা বড় অশান্ত উদ্বেল। ৮-১০ বছরে এই প্রথম বারবার বসেও লিখতে পারছি না। সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। যত চেষ্টাই করি, কেন যেন কোনো তাল মিলছে না। ১৯ জানুয়ারি সকালে কুশিমণিকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে নিয়ে যাব এমনটা ২-৩ দিন আগে থেকে স্থির ছিল। কুশির মা শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। তাই সকালে যাবে না। আমি তৈরি হচ্ছিলাম। কুশিমণির স্কুল না থাকলে সকাল সকাল উঠতে চায় না। বড় মেয়ে কুঁড়ি সপ্তাহখানেক হয় লন্ডন থেকে এসেছে। কুঁড়ি তৈরি হয়ে বসেছিল। আমার কাপড় পরা প্রায় শেষ হঠাৎ ফরিদ এসে কালো মুখে বলল, চাচা মারা গেছেন। আমি একেবারেই বুঝতে পারিনি কোন চাচা। আমার পাশের ঘরের যে চাচাশ্বশুর অসুস্থ পড়ে আছে ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলাম। কতক্ষণ হবে রাত ১২টার দিকে তাকে শেষ দেখা দেখেছি। তিন মাসের ওপরে আমার পাশের ঘরে প্রতিদিন কতবার দেখি তার শেষ নেই। তাই তার দেখাশোনা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। বিশেষ করে সুরুজের আহম্মদ এবং আমার খালাত ভাই নাসির রাতদিন পাশে থাকত। আমার চাচাশ্বশুর আবদুল আজিজ কোরায়েশীকে ওরা আগলে রাখায় মাঝে মধ্যে প্রবাদের কথা মনে হতো, ‘আপন থেকে পর ভালো, পরের চেয়ে জঙ্গল।’

তখন সকাল ৮টা ১০-১৫ মিনিট। আমরা প্রায় সবাই ঢাকা মেডিকেলের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে যাওয়ার জন্য তৈরি বেগম তখনো বিছানায়। মাথায় হাত বুলিয়ে বারকয়েক ডাকতেই বলেছিল, একটু পরে উঠি। তারপরও মাথায় হাত দেওয়ায় বলল, কী হয়েছে? না, একটু উঠ। দরকার আছে। আস্তে আস্তে উঠে বসল। তাকে ধরে যখন ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুম পর্যন্ত গিয়েছিলাম তখনই হয়তো সে বুঝেছিল। আমাদের ছোট্ট বাড়ি। শোবার ঘরের পাশে খাবার ঘর, তার পাশে বৈঠকখানা ৮-১০ কদম দূর। বৈঠকখানার পাশেই কয়েক মাস ধরে চাচাশ্বশুর আবদুল আজিজ কোরায়েশী অচেতন ছিলেন। তাকে নলের সাহায্যে নাক দিয়ে খাওয়ানো হতো। চাচার ঘরের দরজা খুলতেই সে আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে। চাচা নেই শুনে তার বুকে লুটিয়ে পড়ে। আমি তার কান্না সহ্য করতে পারছিলাম না। নাসিরকে বারবার বলছিল, আমাকে ডাকিসনি কেন? অন্যদিনের মতো সেই কাছে ছিল। ৮টা কয়েক মিনিটে চাচা প্রাণ ত্যাগ করেন। আমাদের ৮-১০ মিনিট পরে জানানো হয়। কোনোমতেই নাসরিনের কান্না থামাতে পারছিলাম না। শ্বশুর-শাশুড়ি মারা গেছেন দেখিনি। মেয়েটি মা-বাবার জন্য কতটা কেঁদেছিল জানি না। কিন্তু চাচার জন্য কেউ এতটা কাঁদতে পারে কখনো দেখিনি। তবে এটা সত্য এই চাচাই তাদের সব ভাইবোনকে কোলে-পিঠে মানুষ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিয়েও করেননি। অকৃতদার নির্বিবাদী একজন মানুষ দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। ’৫০-৪৯-এ আমরা যখন গ্রাম থেকে টাঙ্গাইল আসি, আমরা তখন সম্পূর্ণ অপরিচিত। দাদু হঠাৎ মারা যাওয়ায় বাবা দিশাহারা। বিরাট শহরে আমাদের তেমন প্রাধান্য ছিল না। কুমুদিনী কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে নার্গিস হামিদ কোরায়েশী টাঙ্গাইল মহকুমা তো বটেই, ময়মনসিংহ জেলাসহ পূর্ব পাকিস্তানের একজন আলোচিত মানুষ। মনে হয় আমার বয়স তখন ৬-৭ বছর। সেই সময় আবদুল আজিজ কোরায়েশী চাচাকে ২০-২২ বছরের দেখেছি। প্রথম অবস্থায় তিনি খুব একটা পারিবারিক মর্যাদা পেয়েছেন বলে মনে হয়নি। কিন্তু ভাইস্তা ভাস্তিরা তাকে সত্যিকার বাবার মতোই দেখত। আমার স্ত্রী তো আরেকটু বেশি। খুব একটা শারীরিক অসুস্থ ছিলেন না। ফেরদৌস কোরায়েশী কটু এবং তিনি একসঙ্গে থাকতেন। গত কয়েক বছরেই আমার বারবার মনে হতো কখন তিনি চলে যাবেন। সেটাই শেষ পর্যন্ত সত্য হলো। ১৯ অক্টোবর হঠাৎই খবর পাই চাচার স্ট্রোক করেছে। ঢাকা থেকে তখনই টাঙ্গাইল ছুটে যাই। কুশিমণির জন্য বেগম যখন তখন যেখানে সেখানে যেতে পারে না। তাই বলেছিলাম দরকার হলে পরের দিন আসবে। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে প্রথম তাকে দেখে অতটা খারাপ মনে হয়নি। তারপরও টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন পুতুল রায়। তিনি খুবই যত্ন নিয়েছেন। হাসপাতালে গিয়ে সেই যে তার কথা বন্ধ, জ্ঞানহারা আর তা ফিরে আসেনি। সেখান থেকে আনা হয় আগারগাঁও নিউরোসায়েন্স ইনস্টিটিউটে। পরম সুহৃদ অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ অসম্ভব যত্ন নেন। সেখানেও ছিলেন প্রায় মাসখানেক। তারপর কোথায় নেওয়া হবে তেমন কারও উৎসাহ ছিল না। আমার স্ত্রী সব কিছুতেই পাগলপারা। অসুস্থ চাচাকে সে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়তে চাচ্ছিল না। আমারও ইচ্ছে ছিল অমন রোগীকে টাঙ্গাইল না পাঠানোর। তাই এনে তোলা হয় বাবর রোডের বাড়িতে। শেষ জীবনে মা এসেছিলেন। একেবারে শেষের দিকে ১০-১২ দিন প্রথম হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে, পরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায় ৪ এপ্রিল ২০০৪ রাত ১টা ৪০ মিনিটে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলে তাকে নিয়ে যেমনিভাবে টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম, ঠিক চাচাশ্বশুর আবদুল আজিজ কোরায়েশী দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে যান। তাকে নিয়ে যখন টাঙ্গাইলের পথে ছিলাম বারবার মার কথা মনে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে চোখে পানি রাখতে পারছিলাম না। যে স্কুলে আমি লেখাপড়া শুরু করেছি সেই পিটিআই স্কুলমাঠে তার জানাজা হয়। জানাজা শেষে টাঙ্গাইল বড় গোরস্থানে দাফন করা হয়। আমার মাকে দাফন করা হয়েছে কালিহাতী গ্রামের বাড়ি ছাতিহাটি পারিবারিক গোরস্থানে।

সবাইকে একদিন যেতে হবে। কিন্তু সেই যাওয়া কেমন হয় সেটাই দেখার। আমার মা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে যেদিন মারা যান সেদিন ৩টার দিকে জিঞ্জিরায় গণহত্যা দিবস স্মরণে বুড়িগঙ্গার ওপারে গিয়েছিলাম। মা তখনো সজ্ঞানে ছিলেন। নাসরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, তুমি বাড়ি যাও। মিটিং শেষে বজ্র এসে খাবে। ওই রাতেই ১টা ৪০ মিনিটে তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন। আমার চাচাশ্বশুর প্রায় তিন মাস অচেতন ছিলেন। তাই নাসরিনকে বারবার বলার চেষ্টা করেছিলাম, ওরকম কষ্ট করে বেঁচে থাকার চেয়ে চলে যাওয়াই কী ভালো নয়? কিন্তু কোনো সন্তানকে পিতা-মাতার মৃত্যুর কষ্ট সান্ত্বনা দিয়ে ভোলানো যায় না। নাসরিনকেও পারিনি। বিশেষ করে আমার বড় মেয়ে কুঁড়ি কাঁদতে কাঁদতে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছিল। রাতে জ্বরও এসেছিল। আজ ৫ দিন তবু তার চোখ-মুখ ফোলা। মনে হয় সবাই কাউকে হারানোর কষ্ট একভাবে নিতে পারে না। তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়— এটাই বিধির বিধান। আল্লাহ তার সব অপরাধ ক্ষমা করে বেহেশতবাসী করুন—আমিন।

     লেখক : রাজনীতিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর