মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাজারমুখী শিক্ষা জ্ঞানচর্চাকে দেশান্তরিত করছে

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

বাজারমুখী শিক্ষা জ্ঞানচর্চাকে দেশান্তরিত করছে

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। বর্তমান শিক্ষা কি জাতির মেরুদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা যায়? শিক্ষাবিদ শিক্ষক সুশীল সমাজ অভিভাবক সচেতন নাগরিক এই অটো পাস শিক্ষার অশুভ পরিণতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। কিছুতেই শতভাগ পাসের আর স্বর্ণ জিপিএ-এর পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে থামানো যাচ্ছে না। পরীক্ষা দিলেই জিপিএ নিশ্চিত, শতভাগ পাস। এমনই যদি জ্ঞানে-গুণে শিক্ষকরা সোনার ছাত্রদের বিকশিত করেন তাহলে পরীক্ষার কী দরকার।

ডিজিটাল যুগের অভিভাবকরা সন্তানদের অসামান্য ফলাফলে বগল বাজিয়ে আত্মখুশি প্রকাশ করছেন। আনন্দের সঙ্গে শিক্ষকরাও বাহবা কুড়াচ্ছেন আর পাসের প্লাবনের তামাশা উপভোগ করছেন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে যখন সরকারও খুশিতে গদ গদ হয়ে ত্রিশঙ্কু আমোদ-ফুর্তির তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। চাউর আছে গনিমাতের মালের মতো খাতায় নম্বর দিতে ইশারায়-ইঙ্গিতে শিক্ষকদের ছবক দেওয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুর্বল স্কুল সবল করার কর্মসূচি না নিয়ে উল্টা স্কুল বন্ধ করার হুমকি, এমপিও বন্ধ করার ভীতি এলহান করছে। বিপদের হাত থেকে রেহাই পেতে শিক্ষকরা অটো পাস করাচ্ছেন। বেসরকারি চ্যানেল আরটিভি একটা রিপোর্ট করেছিল জিপিএ-৫, স্বর্ণ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের ওপর। স্বাধীনতা দিবস কবে জানি না, বিজয় দিবস কবে জানি না, স্মৃতিসৌধ কী কোথায় জানি না, শহীদ মিনার কী জানি না। এই হলো স্বর্ণ জিপিএ প্রাপ্তির ফজিলত। স্বর্ণধারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ১১ ভাগ পাস করে, বুয়েট-মেডিকেলে তো আরও করুণ দশা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আক্ষেপ করে বললেন ভর্তির উপযুক্ত ছাত্র খুঁজে পাওয়া কঠিন। চাকরি ক্ষেত্রেও চাকরি দেওয়ার মতো শিক্ষিত যুবকের প্রকট অভাব। মনে হচ্ছে পরীক্ষার পাসের অনুপাতের সঙ্গে সরকারের উন্নয়নের ব্যারোমিটার উঠানামা করে, তাই পাসের অনুপাত বেশি।

কিছু ছাত্র জানে বইয়ে যা লেখা আছে তা ভারবাল ডাইরিয়ার মতো বমি করতে পারলে যে নম্বর আসে তাতেই স্বর্ণ ফল। বিষয় নিয়ে গভীরে যাওয়ার, ভাবার সময় কোনো ছাত্রের হাতে নেই। বেশির ভাগ নকলবাজি, কেন্দ্রে শিক্ষকদের করুণার আর পরীক্ষকের উদার খাতা দেখার নীতির ওপর ভর করে চলছে পাসের বিজয়ের লম্বা মিছিল। কেন্দ্র নকলের অভয় অরণ্য। পরীক্ষা কেন্দ্রের এই অপকর্ম দেখে রাজউক কলেজের এক আদর্শিক শিক্ষক কেন্দ্রে যেতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। অনাচারের প্রতিবাদ করে চাকরি খোয়ানোর ভয়ে, সম্ভ্রমের ভয়ে কেউ বিপদ ডেকে আনতে চায় না। এত পরীক্ষার চাপে ছাত্ররা মুক্ত চিন্তা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলাফলভিত্তিক পড়ালেখা চিন্তার জগৎ স্থবির করে ফেলছে। ছাত্রদের চেয়ে অভিভাবকরা বিদ্যা বুদ্ধি জ্ঞান মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু চান ভালো ফলাফল। তারা সন্তানকে আদর্শিক নাগরিক করা, জ্ঞান অর্জন করা এসব অচল প্রাচীন মতবাদ মনে করে। অভিভাবকরা সন্তানকে অর্থ উপার্জনের যন্ত্রে পরিণত করতে ব্যাকুল। এই ভ্রান্ত খোয়াব বিলাসের খেসারত জাতিকে দিতে হবে একদিন কড়ায়-গণ্ডায়। আমার বাবা আমাকে স্কুলে নিয়ে শিক্ষকদের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, মানুষ করে দেবেন শুধু চোখ দুটি অক্ষত রাখবেন। কত যে বেতের পিটানি খেয়েছি সে কথায় যাচ্ছি না। এখন বাবারা শিক্ষককে বলেন বিদ্যা সুনাগরিক বড় কথা নয় চড়া মূল্যে আপনার এখানে ভর্তি করেছি ভালো ফল চাই। শিক্ষক ছাত্রকে পড়ালেখায় ফাঁকি বা দুষ্টামি বা উচ্ছৃঙ্খলার জন্য ভর্ত্সনা করলে অভিভাবক দলবল নিয়ে স্কুল কলেজে হাজির হন শিক্ষককে লাঞ্ছনা করতে। কিছু কৃতীমান ছাত্র ছুরি চাকু নিয়ে রাস্তায় অপেক্ষা করে শিক্ষকের বুকে চাকু বসাতে।

কলেজে ইউনিভার্সিটিতে যারা ভর্তি হবে তারা একটা আবেদন লিখতে পারে না। ইংরেজি ভাষায় কোনো দক্ষতা নেই অথচ উচ্চশিক্ষার সব বই ইংরেজিতে। বছরের প্রথমে নতুন বইয়ের মৌ মৌ ঘ্রাণে ছাত্রদের মন প্রফুল্ল হয় কিনা জানি না, তবে তাদের বই বিতরণের দৃশ্য আমার নাকে নতুন বইয়ের ঘ্রাণের বাঁধ ভাঙা আনন্দ দিচ্ছে। বছরের প্রথম দিবসে নতুন বই বিতরণের সফলতার প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসাপত্র পকেটস্থ করার জন্য মন্ত্রীসহ বড় কর্তারা সবাই যত উদগ্রীব শিক্ষিত জাতি নির্মাণে ততই উদাসীন। নতুন বই দিলেই কি দায়িত্ব শেষ? বইয়ের মধ্যে কি লেখা আছে তা পড়ে জেনে বুঝে জ্ঞান অর্জন করার মধ্যেই বই বিতরণের সার্থকতা। বিনা মূল্যে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বই বিতরণ একটা মহৎ উদযোগ তাকে সাধুবাদ জানাই। ছাত্ররা জ্ঞান অর্জন করে যদি শতভাগ সোনার জিপিএ পায় আমরা গর্বিত আনন্দিত। ফল প্রকাশের সময় শতভাগ পাসের কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পাশে অনাবশ্যক কারণে স্তুতি, বন্দনা, মোসাহেবিপনার অঙ্গভঙ্গি চোখে পড়ে। অতীব মার্জিত কায়দায় হাতের তালু মৃদু ঘর্ষণ, অতি কর্ম ঘণ্টায় ঘর্মাক্ত মুখচ্ছবি প্রদর্শনের বোবা আকুতি টিভিতে দেখে আমার শরম লাগে। এসব টিভি পর্দায় প্রদর্শিত না করে নরম হাতটি মজবুত করে শিক্ষক, কোচিং সেন্টার, প্রশ্ন প্রণয়ন, প্রিন্টিং প্রেস প্রশ্ন ফাঁসবাজদের আইনের আওতায় আনলে শিক্ষার সেবা হতো বেশি। রাজকোষ থেকে ৩৬ কোটিরও বেশি ভুলে ভরা বইয়ের মাশুল জাতিকে দিতে হচ্ছে কিন্তু জাতি তার বিনিময়ে পাচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ফেল মার্কা ছাত্রছাত্রী। দুই-একজন যে ভালো নেই তা নয়, তাদের সংখ্যা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে পাসের সংখ্যার তুলনায় কিছুই নয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং, পরীক্ষার হলে শিক্ষকদের চোখের ইশারায়, আঙ্গুলের ইশারায় উত্তর দেওয়া ছাত্রই বেশি। অভিযোগ আছে স্কুল বাণিজ্যের সিন্ডিকেট উপযুক্ত দক্ষিণার বিনিময়ে বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে অদল বদল করে তাদের কেন্দ্র নির্ধারণ করে। যাতে ছাত্ররা পরীক্ষায় ভালো ফল পায়। তাতে ভর্তি বাণিজ্যের পালে হাওয়া পায়। উভয়পক্ষ জিপিএ পাওয়ার পাকা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এসব অনৈতিক পদক্ষেপ ছাত্রদের লেখাপড়া থেকে বিমুখ করছে। ছাত্র অভিভাবকরাও ভালো ফল দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়েন স্কুল কলেজ মালিক সিন্ডিকেটের দ্বারে। কী চমৎকার ভর্তি পরীক্ষায় ৮ নম্বর পাওয়া ছাত্র জিপিএ পাচ্ছে সিন্ডিকেটের ব্যবসা প্রসারের তাগিদে।  কারিগরি বোর্ডের রিপ্লেস জালিয়াতির বাণিজ্য রমরমা। নবম শ্রেণির বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষার ফরম পূরণ করেনি পরীক্ষায় অংশ নেয়নি কেন্দ্রে হাজিরা সিটে নামগন্ধ নেই, পরীক্ষা দেওয়ার চিহ্ন নেই। তারপর চলতি বছর এসএসসি (ভোক) ফাইনাল পরীক্ষা দেয়। তাদের এসএসসি ফলাফল এফ-৯ দেখান হয়েছে। একটি চক্র ভুয়া নামে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করে রাখে। পরে সনদ প্রয়োজন এমন লোকের সঙ্গে চুক্তি করে। তাদের রেজিস্ট্রি করা ভুয়া নাম সরিয়ে চুক্তিবদ্ধদের নাম রিপ্লেস করে। কী সাংঘাতিক সব তুঘলকি কারবার শিক্ষা নিয়ে চলছে। এমন অভিযোগ পত্রিকায় এসেছে। গুরুতর এ অভিযোগের সত্যতা তদন্ত করে খতিয়ে দেখা উচিত। শতভাগ পাস আর সোনার জিপিএ এর মধ্যে কী অজানা মধুর খনির সন্ধান কর্তৃপক্ষ পেয়েছে। সজ্জন মন্ত্রী দেশের সব জনগণকে শিক্ষার সনদ দেওয়ার মহা ব্রতে আছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বাহবা পাওয়ার জন্য দিনরাত খেটে টন টন পাসের সনদ দিচ্ছেন। জিপিএ পাওয়া একজন সাধারণ ছাত্রকে টোকা দিলে বোঝা যাবে শিক্ষা নিয়ে কী সীমাহীন ইয়ারকি করা হচ্ছে।

কে না জানে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে মোটা অঙ্কের উেকাচের বিনিময়ে, কখনোবা দলীয় বিবেচনায়। মেধা যাচাইয়ের কোনো বালাই এখানে নেই। অনেক শিক্ষক আবার দলীয় পদে বহাল থাকায় প্রধান শিক্ষকও তার ভয়ে তটস্থ থাকেন। এরা মর্জিমাফিক স্কুলে আসেন, ক্লাস নিতে অনীহা দেখান। সৃজনশীল শিক্ষা আসবে কোত্থেকে, শিক্ষক নিজেই কিছু জানেন না। রাজনৈতিক বিবেচনায় আদর্শহীন সনদধারী শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে জাতির সর্বনাশ করা হয়েছে। বেহুঁশ হয়ে উট পাখির মতো বালুতে মাথা গুজলে কি ঝড় থেমে যাবে? এই ব্যবস্থায় পাস করলেই কি একজন ছাত্র কর্মঠ হবে, জাতির সম্পদ হবে? শিক্ষার বেহাল অবস্থার ওপর ফেসবুকে কার্টুন দেখলাম, অপারেশন থিয়েটারে বই খুলে রেখে ক্ষণে ক্ষণে দেখে শিক্ষামন্ত্রীকে অপারেশন করছেন ডাক্তার। শিক্ষা আর নির্বাচন কে কার চেয়ে বেশি জাতিকে ভোগাতে পারে তার অশুভ প্রতিযোগিতা চলছে। ১৯৭২ সালের প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীরা যেমন জাতিকে হতাশাগ্রস্ত করেছিল তেমন লক্ষণ দৃশ্যমান। দুঃখ লাগে অনেক সম্ভাবনাময় মেধাবী ছাত্রের জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে এ স্বয়ংক্রিয় পাস প্রথা। মেধাবীরা লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে পারছে না। চারদিকে নকলের দৌরাত্ম্য আর বিনাশ্রমে জিপিএ প্রাপ্তির হৈচৈ। যারা হতে পারত জাতির সম্পদ, তারা সামনের দিনে মাজা খাড়া করে আর দাঁড়াতে পারবে না। শতভাগ পাসের ভানুমতির খেল, জাতির এ সর্বনাশ ঠেকাতে শিক্ষাবিদদের সরকারকে পরামর্শ দেওয়া উচিত। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় কি বুঝতে পারছেন না শিক্ষার মান কোথায় নেমেছে। বুঝতে না পারলে পণ্ডিতদের ডাকুন। গবেষণার দরকার পড়ে না এটা বুঝতে, যারা জিপিএ পাচ্ছে তারা পঞ্চম শ্রেণির বিদ্যা অর্জন পর্যন্ত করেনি। ঢাকঢোল পিটিয়ে পরীক্ষার এমন মহা আয়োজন শিক্ষার দুর্গতির দুর্বলতা ঢাকার নজির জগতে আর কোথাও নেই। অভিভাবককুলে মেধা মননের চেয়েও লেভেল এ লেভেল একটা মর্যাদার জিকির বেশ চলছে। বাবা-মা সন্তান প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলেই ও লেভেল এ লেভেল বলতে পারলে খুশিতে তাদের হৃদয় লুটোপুটি খায়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নকল, অন্তঃসারশূন্য সনদ আশির দশকে চরম অবনতি ঘটে। তখন থেকে ইংরেজি মিডিয়ামের দিকে সচ্ছল অভিভাবকরা ঝুঁকে পড়েন। সেই থেকে দানবীয়ভাবে তাদের প্রভাব বিস্তার করে চলছে। আমরা শিক্ষার কবরে পা দিয়ে জাতিকে শিক্ষার কবর রচনা করে যাচ্ছি না তো।

লেখক : সম্পাদক জি নিউজ ২৪ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর