শনিবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

রামপাল থেকে সরতে বাধা কোথায়

তুষার কণা খোন্দকার

রামপাল থেকে সরতে বাধা কোথায়

বাংলাদেশ এখন তরতর করে উন্নতি করছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি পৃথিবীর অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে প্রাকৃতিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় বাধাবিঘ্ন এক পাশে ঠেলে সরিয়ে রেখে কী করে সামনের দিকে পথ চলতে হয় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ গত দুই দশকে দুনিয়াকে সেটি দেখিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে বাইরে অসহনীয় রেষারেষি প্রতিদিন আমাদের জন্য উটকো ঝামেলা বয়ে আনে। সেই সঙ্গে সরকারি বেসরকারি সব পর্যায়ে দুর্নীতির প্রবণতা উন্নয়নের পথে বড় বাধা। তবে সাধারণ মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে সব বাধা ডিঙিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দেশে সুশাসনের অভাব আছে বলে কেউ হাত পা কোলে নিয়ে বসে নেই। সাধারণ মানুষ হাতের কাছে যা পাচ্ছে সেটাকেই উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নিজের ভাগ্য নিজে বদলানোর কাজে ব্যস্ত।

সাধারণ মানুষের অবিরাম চেষ্টায় দেশে কৃষি এবং শিল্প উভয় খাতে নীরবে বিপ্লব ঘটে গেছে। এ দুই খাতে যেসব পণ্য তৈরি হচ্ছে সেগুলোর উৎপাদন কৌশল এখন আর মানুষের কায়িক পরিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষ যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন দক্ষতা অর্জন করেছে। যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। দেশের সব এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে আমাদের শিল্প খাত আরও অনেকখানি সামনে এগিয়ে যেতে পারত। সেই সঙ্গে আমাদের দেশে যেসব পণ্য তৈরি হচ্ছে দামের দিক থেকে সেগুলো অন্যান্য দেশের পণ্যের সঙ্গে সফলভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারত। যারা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তারা নিজেদের প্রয়োজনে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ চায়। সরকার দেশের মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের উদ্যোগ নেবে এটাই স্বাভাবিক। মানুষের উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দেশের মানুষের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা সরকারের সক্ষমতার মাপকাঠি। বর্তমান সরকার আমাদের বিদ্যুতের চাহিদা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছে দেখে আমরা খুশি। সে জন্য বিদ্যুতের ঘাটতির মধ্যে কলকারখানা চালাতে গিয়ে অনেক দুর্ভোগ পোহালেও শিল্পের মালিক কিংবা শ্রমিক কেউ রাস্তায় নেমে ঝামেলা পাকাচ্ছে না।

এ পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল বলেই মনে হয়। কিন্তু ইদানীং তাতে বড় একটি ছন্দ পতন ঘটে গেছে। আমি রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা বলছি। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার দেশের মানুষের চাহিদা পূরণের ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে এমন একটা বেহুদা ঝামেলা ডেকে আনতে পারে এটি বিশ্বাস করাও কঠিন। কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন নিঃসন্দেহে বিদ্যুতের নোংরা উৎস। এটি আমার কথা নয় সারা দুনিয়ায় এটি স্বীকৃত সত্য। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে ‘না’ বলতে পারলে ভালো হতো কিন্তু আমাদের সামর্থ্য এবং চাহিদার চাপ মাথায় রেখে এটাকে এক বাক্যে না বলার সুযোগ নেই। কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয় জেনেও দুনিয়ার উন্নত দেশগুলো এখনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করতে পারেনি। ‘কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ বানাব না’ আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য এটা বলা আত্মঘাতী বিলাসিতার শামিল। আমরা অমন নেতিবাচক কথা বলব না, কিংবা সরকারকে অমন নেতিবাচক চিন্তায় যেতেও বলব না। কিন্তু আমার একটি প্রশ্ন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র সুন্দরবনের কোলঘেঁষে রামপালে বসাতে হবে কেন? ঘন বসতির বাংলাদেশে জায়গার খুব অভাব তাই বলে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র বসানোর জায়গা সুন্দরবনের কোল ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না?  দেশের অনেক মানুষ অনেকদিন থেকে রামপালে বিদ্যুেকন্দ্র বসানোর প্রতিবাদ করছে। এ মানুষগুলো সুন্দরবনকে বাঁচানোর তাগিদ থেকে রামপালে বিদ্যুেকন্দ্র বসানোর প্রতিবাদ করছে এটা আমরা সবাই বুঝতে পারলেও সরকার তাদের প্রতিবাদকে গ্রাহ্য করছে না কেন? বরং সরকার দেখি তার চাটুকারদের কথার দিকে কান পেতে আছে। সরকারের ফায়দাভোগী চাটুকারদের পেশা সরকারের তোষামোদ করে তাদের আখের গোছান। এমন চাটুকারেরা কবে দেশের স্বার্থ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিল? সরকার ভালো-মন্দ যাই করবে চাটুকারেরা সঙ্গে সঙ্গে জোড়সে তালিয়া বাজাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকার কি দেশের স্বার্থ বোঝে না! দেশের স্বার্থের প্রশ্নে সরকার তার নিজের বুঝ বিসর্জন দিলে বুঝতে হবে সরকার দেশের স্বার্থের প্রশ্নে কারও সঙ্গে আপস করছে। স্বার্থান্বেষী গুটিকতক মানুষ ছাড়া দেশের সব মানুষ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র রামপাল থেকে সরিয়ে অন্য কোনো সুবিধাজনক জায়গায় বসানোর পক্ষে। রামপালে বিদ্যুেকন্দ্র বসানো হলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে সরকার এ কথা মানলে সরকারের ক্ষতি কী? সুন্দরবন প্রকৃতির সৃষ্টি। প্রাকৃতিক নিয়মে সুন্দরবন যেখানে যেভাবে সৃষ্টি হয়েছে সেখানে সেভাবেই থাকবে। আমরা বরং বিদ্যুেকন্দ্রটি রামপাল থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু সরকার রামপাল থেকে বিদ্যুেকন্দ্র সরানোর কথা কেন কানে নিচ্ছে না এটি আমার মাথায় ঢুকছে না। রামপাল থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র সরানোর কথা শুনলেই সরকার কেন যেন মারমুখী গোঁয়ার্তুমি দেখাচ্ছে। এখন প্রশ্ন কার স্বার্থে সরকার এমন গোঁয়ার্তুমি করছে? রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র বসানোর কাজটি করছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি। ভারতীয় পাওয়ার কোম্পানি এতদিন ধরে বলে আসছে তারা আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতিতে রামপাল বিদ্যুেকন্দ্র চালাবে যাতে পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনা একেবারে শূন্যের কোঠায় (!) নেমে আসবে। এ পদ্ধতিতে পাওয়ার প্লান্ট চালালে পরিবেশের কোত্থাও কোনো ক্ষতি হবে না। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি এতদিন একনাগাড়ে আমাদের এমন কানপড়া দিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তাদের এদেশীয় দোসররা মূল গায়েনের সঙ্গে তালেগোলে সারেঙ্গি বাজিয়েছে। এখন ইউনেস্কো বলছে, তোমরা যা বলছ সেটা ঠিক না।

ইউনেস্কোর বক্তব্য পড়ে আমরা জানলাম, রামপালে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ বানাতে যাওয়া মানে সুন্দরবনের বুকে রাবণের চিতা জ্বালিয়ে দেওয়া। সরকার তাদের কথায় কান দিতে নারাজ। কেন নারাজ সে কথার জবাব খুঁজে না পেয়ে মানুষ ভাবছে, রামপাল থেকে বিদ্যুেকন্দ্র সরানোর সিদ্ধান্ত হয়তো সরকারের হাতে নেই। সরকার হয়তো বাংলাদেশ ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির ইচ্ছা বাস্তবায়নের হাতিয়ার। মানুষের এ সন্দেহ কতখানি সত্য তার প্রমাণ সম্প্রতি বাংলাদেশ ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানির এমডির কথায় প্রমাণ হয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি এক অনুষ্ঠানে সরকারের অনেক রথী মহারথীর সামনে দাঁতমুখ খিঁচে বলেছেন, আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি বলে কোনো প্রযুক্তির অস্তিত্ব নেই। আমরা সুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতিতেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করব। উপস্থিত অনেকে যখন তাকে বললেন, ‘আপনারা এতদিন ধরে আল্ট্রা সুপার পদ্ধতির কথা বলে আমাদের ধোঁকা দিলেন কেন?’ জবাবে ভারতীয় বিদ্যুৎ কোম্পানির প্রতিনিধি বললেন, ‘আপনাদের এখানে অনেক নাটকবাজি হয় বলে প্রথমে বলেছিলাম আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে রামপাল বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করা হবে।’ ভদ্রলোকের কথা শুনে মনে হলো না তিনি কোনো বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশের একটি কোম্পানির এমডি। তার কথার ধাঁচ শুনে মনে হলো, তার কণ্ঠে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধির প্রেতাত্মা ভর করেছে। সেই ভদ্রলোক আরও বলেছেন, ‘আপনাদের এখানে যে এত পণ্ডিত সেটা আমার জানা ছিল না।’ আহারে বেচারা! তিনি আমাদের জ্ঞান গম্যিকে গনায় না ধরে যা মনে চায় তাই আমাদের বুঝাতে চেয়েছিলেন। আমরা তার কল্পনার সঙ্গে মিল রেখে আহাম্মুকির পরিচয় না দেওয়ায় তিনি বেজার হয়েছেন। ভারত বংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ কোম্পানির এমডির কল্পনাকে দোষ দিয়ে লাভ কী? তার দেশ ভারতের বাংলা সাহিত্যের লেখকরা এখনো লেখেন, আমরা বাংলাদেশের লোকেরা নাকি বউকে বলি বিবি আর বইকে বলি কেতাব। এমডি সাহেবও ধরে নিয়েছিলেন, এমন যারা অজ্ঞ মূর্খ তারা ক্রিটিক্যাল এবং সুপার ক্রিটিক্যালের গুমর বুঝবে না। জটিল বৈজ্ঞানিক বিষয় না বুঝলে সেটা নিয়ে বাংলাদেশের কেউ তাঁকে প্রশ্ন করবে না। এখন আমরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছি বলে ভারতীয় ভদ্রলোক মেজাজ খারাপ করে তার ঝুলিতে লুকিয়ে রাখা কালো বিড়াল বের করে দিয়েছেন। রাগের মাথায় অনেক সময় মানুষ সত্য কথা বলে ফেলে। তিনি না বললেও আমরা আগেই জেনে গিয়েছিলাম সুপার ক্রিটিক্যাল এবং আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতির মধ্যে আদতে কোনো ফারাক নেই। ভারতীয় বিদ্যুৎ কোম্পানির এমডি যতই রাগারাগি করুন তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। আসলে আমরা মুশকিলে পড়েছি আমাদের সরকারকে নিয়ে। আমাদের সরকার কি খুব সাধারণ একটি ভারতীয় কোম্পানির হাতে জিম্মি হয়ে গেছে? সরকার আন্তরিক হলে বিদ্যুেকন্দ্র রামপাল থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও বসানো কোনো জটিল বিষয় নয়। সুন্দরবন থেকে দূরে নদীপথে চলাচলের সুবিধাজনক অনেক জায়গা আছে। ভারতীয় কোম্পানির কয়লা পরিবহনের সুবিধা হবে এমন কোনো বিকল্প জায়গা সরকার তাদের অফার করতে পারে। ব্যবসার ব্যাপারে ভারতীয় কোম্পানি আন্তরিক হলে সুন্দরবন থেকে দূরে গিয়েও তারা কাজ করতে রাজি হবে। আমি বিশ্বাস করি, ভারতীয় কোম্পানির উদ্দেশ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করা এবং লাভজনক মূল্যে সেটি আমাদের কাছে বিক্রয় করা। এমন একটা নিরীহ বাণিজ্য পরিকল্পনায় বাগড়া দেওয়ার কুমতলব আমাদের নেই। সুন্দরবন বাঁচানোর স্বার্থে আমরা চাই বিদ্যুেকন্দ্র রামপাল থেকে সরিয়ে অন্য কোনো সুবিধাজনক জায়গায় বসানো হোক।

রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র সুন্দরবনের কাছ থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও বসানোর দাবি প্রসঙ্গে সরকারের অনেক রথী মহারথী ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করেন ‘আন্দোলনকারীরা কী চায়? তারা কি দেশের উন্নতি চায় না?’ তাদের প্রশ্নের জবাবে বলছি, আমরা দেশবাসী দেশের উন্নতি চাই। সেই উন্নতি টেকসই করার স্বার্থে চাই আমাদের সুন্দরবন বেঁচে থাক। সরকারের কাছে কী চাই তার জবাবে ছোট্ট একটি ঘটনা আপনাদের শোনাব। গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিস বড় বেশি সরল জীবনযাপন করতেন। বসবাসের জায়গা হিসেবে তিনি একটা কাঠের গামলা বেছে নিয়েছিলেন। একদিন শীতের সকালে সেই গামলায় শুয়ে তিনি মনের আনন্দে গায়ে রোদ লাগাচ্ছিলেন। এমন সময় মহাবীর আলেকজান্ডার রাজকীয় জাঁকজমকওয়ালা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে ডায়োজিনিসের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘হে মহাপণ্ডিত, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?’ ডায়োজিনিস মুচকি হেসে বললেন, ‘তুমি আমার জন্য সূর্যের রোদটা ছেড়ে দাঁড়াতে পার। আমি এখন রোদ পোয়াব।’ আমরা সরকারের কাছে কিছু চাচ্ছি না। আমরা চাচ্ছি, আপনারা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নিয়ে সুন্দরবনের পাশ থেকে সরে দাঁড়ান। বাংলাদেশ নামের বদ্বীপটির বেঁচে থাকার জন্য সুন্দরবনের আচ্ছাদন খুব দরকার।

            লেখক : কথাসাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর