শনিবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ক্ষমা প্রদর্শন ও অপরাধ মার্জনা

মুফতি আমজাদ হোসাইন

ক্ষমা প্রদর্শন ও অপরাধ মার্জনা

ক্ষমা প্রদর্শন ও মাফ করে দেওয়া মুসলমানদের  বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।

কোনো ব্যক্তি যদি অপর কোনো ব্যক্তির ওপর অন্যায় করে তখন শরিয়ত সম্মতভাবে তার থেকে প্রতিশোধ নিতে পারে। তবে যদি প্রতিশোধ গ্রহণ না করে তাকে ক্ষমা করে দেয়, তাহলে আল্লাহও তাকে ক্ষমা করে দেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদের যারা পদমর্যাদাবান ও আর্থিক প্রাচুর্যের মালিক তারা যেন শপথ না করে যে, আত্মীয়স্বজন, অভাবী ও হিজরতকারীদের কিছু দিবে না। বরং তাদের ক্ষমা করা উচিত, দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করা উচিত। তোমরা কি কামনা কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুক? আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। (সূরা নূর : ২২) আলোচ্য আয়াতে দুটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এক. আত্মীয়স্বজন, অভাবী ও হিজরতকারীদের কিছু না দেওয়ার শপথ না করা সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামিন নিষেধসূচক শব্দ (ওয়ালা ইয়াতালি) ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল, তারা যেন রাগ বা অভিমান করে আত্মীয়স্বজন, অভাবী ও হিজরতকারীদের কিছু না দেওয়ার শপথ না করে। কারণ ভুল-ভ্রান্তি মানুষ করে, ফেরেশতারা ভুল করে না। তাদের ভিতরে ভুল করার উপাদান আল্লাহ পাক সৃষ্টি করেননি, যে উপাদান তিনি মানুষের ভিতরে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ ভুল করলে তার ক্ষমার রাস্তাও তিনি বাতলে দিয়েছেন। কোনো অপরাধকারী অপরাধ করার পর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ পাক তাতে মহাখুশি হন। তাই তো পরিত্র কোরআনের অসংখ্য-অগণিত জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে— আল্লাহ পাক গুনাহ ক্ষমাকরী, তওবা কবুলকারী, মহাপরাক্রমশালী, শাস্তিদাতা, সর্বময় ক্ষমতার মালিক। মহান রাব্বুল আলামিন উক্ত আয়াতে বান্দাকে ক্ষমা করার নির্দেশ করছেন। বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, ‘ক্ষমা করা মহত্ত্বের গুণ। যিনি ক্ষমা করতে জানেন, তিনি বড় মনের অধিকারী হয়ে থাকেন’। হজরত রসুলে আরাবি (সা.) সাহাবায়ে কেরামদের ক্ষমা ও মার্জনা করার তরিকা শিখিয়ে দিয়েছেন ও কেয়ামত পর্যন্ত আগত উম্মতের জন্য এ ব্যাপারে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ রেখে গেছেন। হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি দশ বছর রাহমাতুল্লিল আলামিনের খেদমত করেছি। তিনি কখনো আমাকে বলেননি যে, এই কাজটি কেন এমন করেছ বা কেন এমন করনি।’ হজরত আনাস (রা.) আরও বলেন. পরিবারের কেউ যদি আমাকে কখনো কিছু বলতে চাইত নবীজি বলতেন ওকে বলে কি হবে? তাকদিরে যা আছে তাই তো হবে। এভাবে নবীজি সবাইকে ক্ষমা করার তালিম দিতেন। দুই. দুনিয়া ও পরকালে আল্লাহর রহমত আর ক্ষমা পেতে হলে দুনিয়াতে অপরকে ক্ষমা করা, অপরের প্রতি দয়া ও ইহসানের মানসিকতা থাকতে হবে। তখন মানুষ ইহসানভিত্তিক একটি সুষ্ঠু-সুন্দর সমাজ উপহার পাবে। আজকাল মানুষের চারিত্রিক অধঃপতনের কারণে অনেক প্রভাশালী কর্তৃক দুর্বলরা নির্যাতিত হচ্ছে, ধনী কর্তৃক গরিবরা ও পুরুষ কর্তৃৃক নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিখ্যাত তাফসিরবিদ আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন : আয়াতটি হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) সম্পর্কে নাজিল হয়েছিল। যার প্রেক্ষাপট নিম্নরূপ। হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর খালাতো ভাই মিসতাহ ইবনে আছাছাহ ছিলেন খুবই দরিদ্র।

তিনি ছিলেন বদরি সাহাবীদের অন্যতম। কোনো কারণে হজরত আবু বকর (রা.) তার ওপর রাগ হয়ে সাহায্য-সহযোগিতা না করার শপথ করেন। তখন আয়াতটি নাজিল হয়। হজরত আবু বকর (রা.) ছিলেন দান দক্ষিণায় উদার মনের মানুষ। এ ব্যাপারে তার যথেষ্ট সুনামও ছিল লোকসমাজে। আয়াতে একটি শব্দ আছে (আলা-তুহিব্বুনা) তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিক। অর্থাৎ অপরকে যেভাবে তুমি ক্ষমা ও মার্জনার দৃষ্টিতে দেখবে আমিও তোমাকে সেভাবে দেখব। হজরত আবু বকর তখন বলে উঠলেন—শপথ ওহে পরওয়ারদেগার। আমি চাই আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। এরপর তিনি হজরত মিছতাহর প্রতিদানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখলেন। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টির দ্বারা পারিবারিক, সামাজিক তথা সব ক্ষেত্রেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, অন্যায়-অনাচার দূর হয়। বিশেষ করে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন অটুট থাকে।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর