মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

সবাই মিলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা কি অসম্ভব?

ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

ইংরেজিতে What is lotted cannot be blotted নামক একটি প্রবাদ আছে। যার অর্থ, ‘কপালের লিখন না যায় খণ্ডন’। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে নিয়মিতভাবে ঘটে চলা দুর্ঘটনাগুলো কি এ দেশের জনগণের কপালের লিখন? যদি কপালের লিখন হয়, তাহলে তা খণ্ডনীয় নয়। কারণ, ‘কপালের লিখন না যায় খণ্ডন’। আবার সড়ক দুর্ঘটনাগুলোকে যদি এ দেশের পরিপ্রেক্ষিতে না দেখে উন্নত দেশের প্রেক্ষিতে দেখা যায়; তাহলে দেখা যাবে, উন্নত দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার এ দেশের তুলনায় অনেক কম। তাহলে কি কপালের লিখন দেশভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে? নিশ্চয় না। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো এ পার্থক্যের সৃষ্টি করছে তা হচ্ছে; সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ধরন, চালকদের দক্ষতা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চালকদের ওভারটেকিং করার মানসিকতা থাকা, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনগণের সচেতনতার অভাব, ট্রাফিক আইন না মানা প্রভৃতি। এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনা আজ নতুন কোনো বিষয় নয়। বরং পত্রিকার পাতা খুললে প্রতিদিনই চোখে পড়ে এ সংক্রান্ত খবরাখবর। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় সাড়ে সাত হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দেশে ৭২ হাজার ৭৪৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৫২ হাজার ৬৮৪ জন আহত হয়েছেন। এ হিসাব অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন গড়ে ১০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩ হাজার ২৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩ হাজার ৭৭০ জন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত হয়েছেন অর্থাৎ, দিনে অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন ১৫ হাজার ৯১৪ জন। এক হিসাবে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। দেশে প্রতিনিয়ত যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে; তাতে মনে হয় দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো নিরাপদে চলার পথ না হয়ে দিনে দিনে তা মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে আর সড়ক-মহাসড়কে এখন যাত্রা করা মানেই যেন নিজের জীবন বাজি রাখা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার ব্যাপারে যদি অতি দ্রুত সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়, তাহলে আগামীতেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কি এভাবেই ঘটতে থাকবে? এ অবস্থা কোনোভাবেই চলতে পারে না এবং চলতে দেওয়া যায় না। সুতরাং, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারসহ সবার পক্ষ থেকে অতি দ্রুত সমাধানের পথ খুঁজে বের করাসহ তার বাস্তবায়ন অতীব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনা অপ্রতিরোধ্য কোনো কঠিন বিষয় নয়। এ জন্য দরকার ইতিবাচক চিন্তা, সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার উপযুক্ত বাস্তবায়ন। সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম যে বিষয়গুলো দায়ী হিসেবে পরিলক্ষিত হয় তা হচ্ছে; সঠিক পরিকল্পনাহীন অনুপযুক্ত সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, নির্দিষ্ট লেন ধরে গাড়ি না চালিয়ে সড়কের মাঝ দিয়ে চালকদের গাড়ি চালানো, রাস্তায় বিপজ্জনক বাঁক থাকা, রাস্তার ত্রুটিপূর্ণ নকশা থাকা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চালানো, চালকদের বেপরোয়া গতিসহ ভুলপথে বেপরোয়া যান চালানো, বেশি গতির গাড়িগুলোর অপেক্ষাকৃত কম গতির ছোট গাড়িগুলোকে ওভারটেকিং করার মনোভাব থাকা, রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী পথচারীদের ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, রাস্তার ফুটপাথ ব্যবহার না করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলাচল করা, রাস্তা পারাপারের জন্য ওভার ব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহার না করে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার মানসিকতা থাকা, রাস্তা এবং ফুটপাথে দোকানপাট সাজিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা, দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাফিক ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি রাস্তায় চলাচলের জন্য যে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-রীতি রয়েছে তা না মানার প্রবণতা বিদ্যমান থাকা ইত্যাদি। এসব অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানোর পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালকদের হতে হবে বেশি দক্ষ, হতে হবে সতর্ক। পাশাপাশি গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলাসহ চালকদের ‘ওভারটেকিং’ করার মানসিকতাও পরিহার করা প্রয়োজন। পাশাপাশি জনগণকেও ট্রাফিক আইন ও রাস্তা চলাচলের আইন-কানুন যথারীতি মেনে চলতে হবে। এক্ষেত্রে যথেষ্ট কঠোরতার সঙ্গে ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ অপরিহার্য। তা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দেশের সার্বিক সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানোসহ চালকদের দক্ষতা বিচার করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে যেন কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি না হয়, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা দরকার। আর সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পরিচয় বাদ দিয়ে কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনা বা শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা থাকাও আবশ্যক। এসবের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, সরকারসহ আপামর জনগণের একযোগে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসা উচিত। আর এ পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলেই দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো মৃত্যুফাঁদের পরিবর্তে হয়ে উঠবে নিরাপদে চলার পথ হিসেবে; যা আমার, আপনার, সবারই একান্ত কাম্য।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক

আইন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি 

     ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর