বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভোটযুদ্ধে খালেদার পথ রুদ্ধ নাকি ভাঙন?

পীর হাবিবুর রহমান

ভোটযুদ্ধে খালেদার পথ রুদ্ধ নাকি ভাঙন?

নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে নিস্তরঙ্গ রাজনীতিতে কিছুটা ছলাৎ ছলাৎ করে ছোটখাটো ঢেউ উঠলেও সরকার যেমন চাইবে নির্বাচন কমিশন তেমনই হবে। যারা মনে করছেন, এমনটি করলে আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির অংশগ্রহণের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে তারা হয়তো ভুল করছেন। রাজনীতির পর্দার অন্তরালে প্রতিটি নির্বাচনের আগেই নানামুখী খেলা জমে ওঠে।  এবারের খেলা এখনো পূর্ণাঙ্গ দৃশ্যায়ন হয়নি। জল্পনা-কল্পনা চলছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন একটি অংশকে বাইরে রেখে আরেক অংশকে নির্বাচনে নিয়ে আসা হবে। অর্থাৎ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নয়, বিএনপি ভেঙে একাংশকে নির্বাচনে নিয়ে আসা হবে। কিন্তু এই অংক ভুল করে দিয়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বিএনপি নির্বাচনে চলে আসতে পারে। কারণ বিএনপির সামনে নিঃশর্তভাবে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই।

নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী পরপর দুবার নির্বাচনে অংশ না নিলে দলের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার বিষয়টির চেয়েও রাজনৈতিক অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জেই তাদের আগামী নির্বাচনে আসতে হবে। পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতি সরকারের যতই অনুকূলে থাকুক, জাতীয় রাজনীতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বধীন জোট যতই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকুক না কেন, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্নায়ুচাপ বাইরে থেকে থাকবেই। ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী ও কয়েকটি দেশের কূটনীতিকগণ নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জবাবে বলেছেন, রাষ্ট্রপতিই ঠিক করবেন তিনি কার সঙ্গে বসবেন, কার সঙ্গে বসবেন না। এসব ব্যাপারে বিদেশিদের নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের কারও হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। আমরা কি মেরুদণ্ডহীন জাতি? প্রশ্ন করে তিনি বলেছেন, সেই দিন বাসি হয়ে গেছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের পছন্দের লোকদের নিয়ে। কারণ কর্মকমিশন চেয়ারম্যান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য এগুলো সরকারের নিয়োগ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় বসেছে, এখন নিরপেক্ষ সদস্যদের নিয়ে সার্চ কমিটি হয়েছে। এখন তারা বলছে, কেউ নিরপেক্ষ নন। তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন, সার্চ কমিটির কেউ আওয়ামী লীগ করে না। মির্জা ফখরুল বলেছেন, কি নিরপেক্ষ সার্চ কমিটি হয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে। আমরা শুধু হতাশ হইনি, ক্ষুব্ধও হয়েছি।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রস্তাব করেছিলেন সরকারের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন না এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য লোকদের নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করতে। বিএনপির আশা পূরণ হয়নি। এখন মির্জা ফখরুল বলছেন, বিএনপি রাষ্ট্রপতির কাছে নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত আশা করেছিল। সংকট নিরসনে একটি সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। এখন বোঝাই যাচ্ছে, বাছাই কমিটি কী ধরনের ইসি গঠন করবে? এই কমিটির মাধ্যমে আবারও অন্ধকার গহ্বরের দিকে দেশকে ঠেলে দেওয়া হলো। আওয়ামী লীগ আবারও ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করতে চায়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বিএনপির অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, সার্চ কমিটি নিয়ে যারা অভিযোগ তুলছেন তারা ‘ভ্রান্ত ও রাবিশ’। এর কোনো ভিত্তি নেই। সার্চ কমিটির সদস্যরা অত্যন্ত জ্ঞানী, গুণী ও ভালো লোক।

বিএনপি জোট ছাড়া মহাজোটের শরিকরা সার্চ কমিটিকে স্বাগত জানিয়েছে। বিভাজনের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক শক্তিগুলো এ নিয়ে কী বললেন না বললেন, সেটি বড় কথা নয়। সার্চ কমিটিতে যারা আছেন, তাদের কারও কারও ব্যাপারে বলাই যায়, তারা যেসব দায়িত্বে রয়েছেন সেসব দায়িত্ব পালনের সুযোগ কবে কখন কীভাবে পেয়েছেন। তাদের কারও কারও অতীত রাজনীতিবিদগণ নয়; মানুষের চোখের সামনেও দৃশ্যমান।

বিএনপি যখন বঙ্গভবনের দিকে আলোচনার যাত্রা শুরু করেছিল তখন অনেক টকশো ও কলামে বারবার বলেছি, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেশের সব মানুষই চায়। কিন্তু নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন যেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি তেমন ওইসব নির্বাচনে শাসকদলকে পরাজিত করার কোনো উদাহরণ ঘটেনি। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধান রয়েছে। ২০১২ সালে এভাবেই রাষ্ট্রপতি মরহুম মো. জিল্লুর রহমান সংলাপের মধ্য দিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করে রকীবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিলেন। রকীব কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচনসহ অনেকগুলো স্থানীয় নির্বাচন বিএনপিই নয়; দেশবাসীও দেখেছে। এই কমিশনের মেরুদণ্ড সবল না দুর্বল এই প্রশ্নের উত্তর মানুষের কাছেই রয়েছে। এই কমিশন সরকারের কাছে না সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ ছিল সেটিও মানুষ দেখেছে। তাই বরাবর বলে আসছিলাম, বঙ্গভবন নয়; বিএনপিকে যেতে হবে গণভবনে। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপ্রধান থাকেন, রাষ্ট্রের অভিভাবক তিনি। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেওয়া ছাড়া তার কোনো কাজ নেই। তার কোনো ক্ষমতাও নেই। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সব ক্ষমতার উৎস গণভবন। অর্থাৎ ক্ষমতা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। বিএনপিকে রাষ্ট্রপতির দেওয়ার কিছু ছিল না। দেওয়ার কিছু থাকলে সেটি প্রধানমন্ত্রীর হাতে রয়েছে। আওয়ামী লীগ বরাবর বলে আসছিল, ২০১২ সালের মতোই সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। বিএনপি সেই ফাঁদেই পা দিয়েছে। গণভবনে না গিয়ে বঙ্গভবনে গেছে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ব্যালট বিপ্লবে দুবার সাংবিধানিকভাবে ১৫ দিনের সরকার মিলিয়ে তিনবার ক্ষমতায় এসেছেন। ব্রুট মেজরিটি নিয়ে ক্ষমতায় এলেও প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হ্রাস করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়াননি। বরং জানাজা পড়া আর ফাইলে সই করার বাইরেও মানুষের জন্য যে নতুন সংস্কৃতির দুয়ার খোলা যায় সেটি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী দেখিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তার ভাগ্যে কী ঘটেছিল তিনি ও মানুষ ভুলে গেলেও খালেদা জিয়ার বিএনপির ভোলা উচিত নয়। এখন সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে চিঠি দিয়ে নাম চেয়েছে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য। বঙ্গভবনে যখন সংলাপ শুরু হয়, তা গণমাধ্যম বা মানুষের মধ্যে কোনো চাঞ্চল্য তৈরি করতে পারেনি। যেন অর্থহীন সংলাপের ফলাফল সবার জানা ছিল। এখন মনে হচ্ছে বিএনপির জানা ছিল না। ন্যাড়া বেলতলায় যায় একবার, বিএনপি যায় বারবার। একবার ভুলের পথে পা বাড়ালে বাকি পথ বিভ্রান্তিতে হোঁচট খেতে খেতে হাঁটতে হয়।

 

 

 

ভাবি একটি বিষয় নিয়ে লিখব, দেশের চালচিত্র সপ্তাহ যেতে না যেতেই পাল্টে যায়। এক ইস্যু থেকে আরেক ইস্যু চলে আসে। রামপাল রামপাল করে সরকার ও নিরীহ আন্দোলনকারীরা। মাঝখানে পুলিশের বুটের লাথিতে সংবাদকর্মীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। সামিয়া রহমানের উপস্থাপনায় চ্যানেল নিউজ২৪-এর রাত ৮টার টকশোতে সেদিন অংশগ্রহণ করেছিলাম দুজন গুণী মানুষের সঙ্গে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আমার মতপার্থক্য থাকলেও জাতীয় জীবনে অবদান, মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ভূমিকায় তাদের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। তারা হলেন— অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ও খুশি কবীর। সামিয়া রহমান আমার পছন্দের একজন মেধাবী, সৃজনশীল গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। তার টকশো ইতিমধ্যে তিনি জনপ্রিয় করেছেন। সুলতানা কামাল ও খুশি কবীরের সঙ্গে আলোচনার বিষয় ছিল, মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ ও ক্ষেত্রবিশেষে ১৬ রাখার ব্যাপারটি নিয়ে। তারা ক্ষেত্রবিশেষে ১৬ রাখার বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ। তারা মনে করেন ধর্মান্ধ শক্তির চাপে সরকার এই ছাড় দিয়েছে। কিন্তু আমার বক্তব্য ছিল, একটি রাজনৈতিক সরকার গোটা দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ১৬ বছরের বিধানটিও রেখেছে। আমি বলেছি, ব্যক্তিগতভাবে আমার মেয়ে ন্যূনতম গ্র্যাজুয়েশন না করা পর্যন্ত বিয়ের কথা ভাববই না। বাল্যবিবাহের পরিসংখ্যানে আগে যেখানে ছিল ৬৫ শতাংশ, এখন সেখানে এ হার ৫২-তে চলে এসেছে। দিন দিন জনসচেতনতা, লেখাপড়া ও মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বাড়ছে বলেই এমনটি হয়ে আসছে। ভারতে এখনো মেয়ে শিশুর ভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। এক সময় আমাদের এখানেও কন্যাশিশু জন্ম নিলে পরিবারের অনেকের মুখ কালো হয়ে যেত। আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসছি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, সরকার অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ দিলেও নিরাপত্তার জায়গাটি আমরা এখনো নিশ্চিত করতে পারিনি। এখনো গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় অসম বিয়ে, বাল্যবিবাহ চলছে। যেমন শিক্ষিত ও বিত্তশালী সমাজেও চলছে নিন্দিত যৌতুক ব্যবস্থা। এখনো মেয়ে ও নারী পারিবারিক পরিমণ্ডল থেকে সামাজিক বেষ্টনী হয়ে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। ছেলেবেলা থেকেই আমাদের অন্যায় না করার শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করার শিক্ষা দেওয়া হয় না। বলা হয়, এটা কর না, ওটা কর না। এখানে যেও না, ওখানে যেও না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রাজনীতির অন্দর, প্রশাসনের চার দেয়াল, বেসরকারি খাত এমনকি মাদ্রাসা থেকে ডাক্তারের চেম্বার পর্যন্ত নারী নিরাপদ নয়। ভিকারুননেসার ঘটনাটি পরিবার ও মেয়েটি সাহস করেছিল বলে ওই শিক্ষক পরিমলকে জেল খাটতে হচ্ছে। এমনকি সংসদে চোখ দেখতে গিয়ে রোগিণীকে চুমু খাওয়ার কারণে চুমু মতিন বিতর্ক একদিন উঠেছিল। রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রবেশকারী উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিটির লজ্জা না হলেও মানুষের জন্য লজ্জার।

আমার জানা মতে রিজভী নামের এক ডাক্তারের চেম্বারে শারীরিক সমস্যা নিয়ে গেলে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুপত্নী স্বয়ং বিকৃত আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। থাপ্পড় দিয়ে বেরিয়ে এলেও তিনি সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে কাউকে কিছু বলেননি। কিছু দিন আগে আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবাহিত এক শিক্ষক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেফতার হন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তো অহরহ ঘটছে। পশ্চিমা দুনিয়াতে এ ধরনের ঘটনায় আইনের আশ্রয় নেওয়া হয়। আমাদের দেশে গোপন রাখা হয়। পরিবার থেকে শেখানো হয়, সমাজ থেকে আড়চোখে বলা হয় বিকৃত পুরুষের যৌন লালসার শিকার মেয়েটির মান যাবে। তাই এটি গোপন রাখাই ভালো। কিন্তু এই লজ্জা যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারী বা মেয়েদের নয়; যে পুরুষ কারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার বিকৃত লালসা চরিতার্থ করতে উদ্যত হয়, লজ্জা ও গ্লানি তার। পরিবার থেকে, সমাজ থেকেও জাগরণ ঘটাতে হবে নারীর নিরাপত্তার। নারীর প্রতি বিকৃত পুরুষের অশ্লীল ইঙ্গিত, প্রস্তাব বা আক্রমণের প্রতিবাদ করা উচিত। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ কখনই নিজের ভুল ভেবে কারও অসভ্যতা, যৌন বিকৃতিকে সইতে পারে না, প্রশ্রয় দিতে পারে না। নারীকে বুঝতে হবে, এ লজ্জা তোমার নয়; যারা তোমাকে নিরীহ ও সস্তা মনে করে লজ্জা ও গ্লানি সেই কাপুরুষের। পরিবারকে বল, আইনের আশ্রয় নাও। ঘেন্নায় ওদের মুখে থুতু দাও।

কেউ কেউ নারীর পোশাকের ও পর্দাপ্রথার ইস্যু সামনে নিয়ে আসেন। যেন সৌদিতে যৌনবিকৃত পুরুষ নেই! এখন মায়েরা অনেক সজাগ হচ্ছেন। বাবারা সতর্ক হচ্ছেন। যে কোনো নর-নারী বা যে কোনো তরুণ-তরুণীর কাউকে ভালো লাগলে ভালোবাসা ও বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো দুর্বল বা একান্ত মুহূর্তের সুযোগ গ্রহণ, ইচ্ছার বিরুদ্ধে গায়ে হাত দেওয়া, আগ্রাসী হয়ে ওঠা অপরাধ। নারীকেই আজ জাগতে হবে। পরিবারকেই আজ সমাজকে নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ব্যাপক গণসচেতনতাই সমাজকে সুন্দর-পরিশীলিত করতে পারে। নারীকে রক্ষা করতে পারে বাল্যবিবাহ থেকে, যৌন হয়রানির হাত থেকে। না হয়, শুধু আইন করে সমাধান সম্ভব নয়।

যাক, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সার্চ কমিটি যে নির্বাচন কমিশন গঠন করবে তারা তা মেনে নেবেন। বিএনপি জোট নাম পাঠাতে পারে, কিন্তু এই সার্চ কমিটি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আলোচনার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সেখানে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ড. আকবর আলি খানের মতো গ্রহণযোগ্য সাহসী বিশিষ্ট নাগরিকদের নাম নেই। সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম ইয়াজউদ্দিন নিজেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে হাওয়া ভবনের ফরমায়েশ অনুসরণ করে আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন গঠন করছিলেন। তখন অন্যায় কবুল না করে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করে মানুষের শ্রদ্ধাই অর্জন করেননি, ইতিহাসে অমরত্ব পেয়েছেন। সেই চারজন হলেন, ড. আকবর আলি খান, সিএম শফি সামি, লে. জেনারেল (অব.) হাসান মশহুদ চৌধুরী এবং অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। সেদিন তাদের পদত্যাগে বিএনপি জোট ছাড়া দেশের সবাই উল্লসিত হয়েছিলেন। কিন্তু আজকের সার্চ কমিটি ড. আকবর আলি খানের মতো একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক ক্যাবিনেট সচিব ও উপদেষ্টাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগদানের প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে দিতে পারবে?

বিএনপির ভুলের রাজনীতির খেসারত শুধু বিএনপির নেতা-কর্মীরাই দেননি। এর চাপ পড়েছে গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। ক্ষমতায় থাকতে যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে শহীদের রক্তে অর্জিত পতাকা দিয়েছিল। ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দিয়েছিল। একুশের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় রাজনৈতিক সমঝোতার বিশ্বাস ও আস্থার কবর রচনা করেছিল। ১০ ট্রাক অস্ত্র, বোমাবাজি, জঙ্গিবাদ, একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে, দুর্নীতির মহোৎসবে টাইটানিকের মতো নিজের ডুবিয়েছে। ভেঙে দিয়েছে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর নৈশভোজ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান ও নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অংশগ্রহণের লোভনীয় প্রস্তাব গ্রহণ না করে ভোট বর্জন ও সহিংস হরতাল-অবরোধের জামায়াতী তাণ্ডবে শরিক হয়ে আত্মঘাতী খেলা খেলেছে। শুধু জনমতের দিকে তাকালেই হয় না। ক্ষমতানির্ভর রাজনৈতিক দলকে বিশ্বরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করতে হয়। আওয়ামী লীগ সফল হয়েছে বিএনপিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিতে। বিএনপিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও দলটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে সমর্থন দূরে থাক, নিজেদের অবস্থানই পরিষ্কার করতে পারেনি। ছাড়তে পারেনি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতকেও। গোটা দেশের নেতা-কর্মীরা দলের হঠকারী আন্দোলনের শিকার হয়ে মামলার জালে বন্দী। বৈরী পরিস্থিতিতেও যে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হওয়া, সংগঠনকে মাঠ পর্যায়ে তৃণমূল পর্যন্ত ঢেলে সাজানো তার কোনোটাই করতে পারেনি।

রাজনৈতিক সমঝোতার জায়গা থাকে দুটি। সরকার ও বিরোধী দল। সংসদে সাংবিধানিকভাবে যেই থাকুক, সরকার, মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বিরোধী দল বলতে বিএনপি। আগামী নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে— এমনটি কেউ মনে করেন না। কিন্তু খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ফিরে আসুন, অন্তত মানুষ সেটি চায়। সেখানেও খেলা আছে। কেউ কেউ মনে করেন, খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করে দেওয়ার সুবর্ণ সময় সামনের নির্বাচন। বিরোধী দলের জায়গাটি তাদের না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে বসিয়ে দেওয়া যায়। সেখানে প্রশ্ন হচ্ছে— কেন খালেদা? কেন নয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জোট শক্তির অংশীদার এরশাদ, মেনন বা ইনুরা।

এ অবস্থায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল মনে করে, কিছুটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিলেও বিএনপিই বিরোধী দলে বসবে। কারণ খেলা সরকারের কোর্টে। শেখ হাসিনাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন। বিএনপি তার সঙ্গে আলোচনার মধ্যদিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনের দাবি কিছুটা হলেও আদায় করতে পারে। নির্দলীয় সরকার চেয়ে ২০১৪ সালের ট্রেন মিস করেছে। শক্তিশালী, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলে ২০১৯ সালের নির্বাচনী ট্রেন মিস করবে না তো? প্রশ্ন হচ্ছে, অনেক নাটক বাকি। নানা নাটকীয়তার ভিতর দিয়ে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এই নির্বাচন কমিশন গঠন ঘিরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জোটের অংশগ্রহণ কি রুদ্ধ হয়ে যাবে?  নাকি বাতাসে ছড়ানো ফর্মুলায় খালেদা জিয়াকে বাইরে রেখে বিএনপি ভেঙে একাংশকে নির্বাচনে আনা হবে?

বিএনপির নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে, তার জোটের শরিকরা সরকারে যাওয়ার জন্য জোট করেছেন। বিরোধী দলে যাওয়ার জন্য নয়।  কাঁচা খেলা খেললে দল ও জোট ভাঙার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর