শিরোনাম
বুধবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

আল্লাহকে নয় নিজেকেই ধোঁকা দেয় বান্দা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আল্লাহকে নয় নিজেকেই ধোঁকা দেয় বান্দা

বিশ্বব্যাপী আজ সাচ্চা মুমিনের বড় অভাব। ধর্মের প্রতিটি বিষয়ের মতো ইমান বা মুমিনের সংজ্ঞাও আমরা নিজেদের মতো বানিয়ে নিয়েছি।  তারপর ইসলাম ও ইবাদতকে কেটে-ছেঁটে মসজিদ-মাদ্রাসায় ঢুকিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে আলাদা করে ফেলেছি। ফলে আমাদের সমাজ এবং ধর্মীয় জীবনের সঙ্গে মিল তো দূরের কথা যোগাযোগও নেই। ঘুষ, সুদ, দুর্নীতির সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। একজন বকধার্মিক শবেবরাত এলে পাক্কা মুসল্লি হয়ে যায়। শুক্রবার, রমজানের পহেলা দিন কিংবা ইজতেমার মাঠে আমাদের কপাল ঠেকানো দেখলে শয়তানও বিশ্বাস করবে না এ মানুষটাই গতকাল কিংবা একটু আগেও আকণ্ঠ আল্লাহর নাফরমানীতে ডুবেছিল। দুই দিনের দুনিয়ায় একটু ভালো থাকার জন্য, আল্লাহর নির্দেশের বাইরে গিয়ে বেপরোয়া জীবনযাপনের পর মুমিন মুসলমানের সুরত ধরে আমরা শুধু আল্লাহকে ধোঁকা দিচ্ছি না, ধোঁকা দিচ্ছি নিজেকেই। আল্লাহ বলছেন, ‘যে আমার শোকরিয়া আদায় করে সে নিজের জন্যই করে। আর যে বেপরোয়া জীবনযাপন করে সে নিজেকেই ধোঁকা দেয়। এতে আল্লাহর কোনো ক্ষতি নেই। কারণ তিনি তো অভাবমুক্ত ধনী।’ (সূরা লোকমান : ১২)। হে আমার পাঠক ভাই, মুমিন কোনো সুরতের নাম নয়, পোশাকের নামও নয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কিংবা উদ্দেশ্যহীন কোনো অনুষ্ঠানের নাম নয়। অথচ আমরা এসব কাজকেই মুমিন মুসলমানের প্রথম ও প্রধান কাজ মনে করে থাকি। একজন মানুষ লম্বা দাড়ি, টুপি, পাগড়ি, পাঞ্জাবি পরলে কিংবা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করলে সে কোরআনে আঁকা মুসলমান হয়ে যায় না। কোরআনে আঁকা মুসলামান হতে হলে তাকে তার পাগড়ি এবং নামাজ-রোজার বাস্তব অনুশীলন করতে হবে। যেমন নামাজে আমরা ধনী-গরিব সবাই সমান এই শিক্ষা পাই। বাস্তবে এসে যদি আমরা এর চর্চা না করি তবে আমাদের নামাজই আমাদের জন্য জাহান্নামের কারণ হবে। এ কথাই কোরআন বলছে, ‘ধ্বংস ওইসব নামাজীর জন্য, যারা তাদের নামাজের চর্চা সম্পর্কে বেখবর।’ (সূরা মাউন : ৪)। এমনিভাবে রোজার শিক্ষা হলো আল্লাহতায়ালা সব কিছু দেখছেন। অতি গোপনে কিছু খেয়ে নিলেও তিনি দেখবেন। তাই আমরা রোজা যাতে না ভাঙে তাই শত কষ্ট হলেও কিছু খাই না। কিন্তু এ আমরাই আবার সুদ, ঘুষ কিংবা ধর্মের নামে ব্যবসা করার সময় এমন ভাব করি যেন আল্লাহ ওই মুহূর্তে অন্ধ হয়ে আছেন কিছুই দেখছেন। (নাউজুবিল্লাহ)। এক অফিসারকে দেখেছি তিনি রোজার মাসে দিনের বেলায় ঘুষ নেন না। যারা ঘুষ দেয় তাদের বলে, আমি রোজা আছি আপনারা আমার ড্রয়ারে টাকাটা রেখে যান। এ অফিসার ইফতারের পর ঘুষের টাকা স্পর্শ করেন। এ বেকুব অফিসারের কথা শুনে আপনারা হাসছেন? আমি তো মনে করি আমাদের অবস্থা তারচেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমরাও তো রোজা এবং রোজার বাইরের জীবনে আকাশ-পাতাল পার্থক্য করে জীবনযাপন করেছি। জাকাত এবং হজের অবস্থাও তাই। স্বাধীনতার এত বছর পর্যন্ত আমরা জাকাত দিচ্ছি, কিন্তু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে পারছি না দেশে। এ কথাই প্রমাণ করে আমাদের জাকাত কোরআনের জাকাত হচ্ছে না। হচ্ছে না সাহাবিদের জাকাত। সুতরাং এ জাকাত দিয়ে না মুমিন হওয়া যাবে, না মুসলমান হওয়া যাবে। হজ সম্পর্কে একটু বলি। একজন হাজী দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে মৃত মানুষের মতো আল্লাহর কাছে হাজিরা দেয়। কিন্তু এই হাজী যখন হজ থেকে ফিরে আসে, তখন তার আর মৃত অবস্থা থাকে না। থাকে না আল্লাহর ডাকে ‘লাব্বাইক’ বলার তাগিদও। হজ থেকে ফিরে তিনি ভাবতে থাকেন আমি তো গুনাহমুক্ত হয়ে গেছি। সুতরাং পাপের রাজত্বে আরও কিছু দিন বিচরণ করে নিই। তারপর আবার গিয়ে কাবা তওয়াফ করে গুনাহ মাফ করিয়ে নেব। পাঠক ভাই আপনারাই বলুন, এই ব্যক্তির হজ কি কোরআনের হজ হয়েছে? এই ব্যক্তি কি হজের হাকিকত বুঝতে পেরেছেন। যদি পারতেন তবে হজ ফেরত তিনি জান্নাতি জীবনযাপন করতেন। তার আত্মা থেকে জান্নাতি খুশবু ছড়িয়ে পড়ত সমাজ ও দেশে।

শুরু করেছিলাম ইমান নিয়ে। কিন্তু অন্যান্য বিষয়ও চলে এসেছে। মূলত পাঁচ খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে আপনার আমার ধর্ম ইসলাম। আজকের মুসলমানদের কাছে কত দুর্বল খুঁটিগুলো। অথচ বাহ্যিক কিছু অনুষ্ঠান পালন করে ভাবছি আমাদের ধর্ম তো অনেক মজবুত। আসুন দেখি রসুল (সা.) কী বলেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, কেউ মুমিন হওয়ার ইচ্ছা করলে কিংবা মুমিনের বেশ ধারণ করলেই সে মুমিন হবে না। মুমিন হওয়ার জন্য ধর্মের প্রতিটি বিষয় তাকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।’ রসুল (সা.) মূলত, ‘ইয়া আইয়ু হাল্লাজিনা আমানু ওয়া আমিলুস সালিহাত’-এর প্রতিধ্বনি করেছেন। বিশ্বাসের সঙ্গে কর্মে পরিণত করার নামই ইমান এবং ইসলাম। রোজা অবস্থায় কিছু খেলে আল্লাহ দেখে ফেলবেন— এ বিশ্বাস করে বসে থাকলেই কেউ কোরআনের মুমিন মুসলমান হতে পারবে না। তাকে রোজা রাখতে হবে। সারা দিন না খেয়ে কষ্ট করতে হবে। এরপর বাস্তব জীবনে আল্লাহ দেখছেন— এর চর্চা করতে হবে। এ চর্চা শুধু রমজান মাসে নয় বছরব্যাপী, জীবনব্যাপী করতে হবে। তারপর মৃত্যুর সময় তাকে ডাকা হবে ‘ইয়া আইয়াতু হান্নাফসুল মুতমাইন্না’ বলে।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসটি অর্থাৎ বিশ্বাসের সঙ্গে কর্মের সম্পর্ক— এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করেই শেষ করছি। আল্লাহ বলছেন, ‘সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হলো এই যে, ইমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সব নবী-রসুলের ওপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে অত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দান করে এবং যারা প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী,  তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেজগার।’ (সূরা বাকারা : ১৭৭)।    

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

সর্বশেষ খবর