শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

হে আল্লাহ! ঋণমুক্ত জীবন দিন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

হে আল্লাহ! ঋণমুক্ত জীবন দিন

‘ঋণ করা ভালো নয়।’ ছোটবেলায় পড়া নীতিবাক্যটির মর্মার্থ বুঝতে পেরেছি একটু বড় হয়ে। ঋণের ভয়াবহ ক্ষতি বোঝাতে বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি উক্তিই যথেষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘ঋণ আত্মার স্বাধীনতা নষ্ট করে দেয়।’ জীবনের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষটি বেঁচে থেকেও যে প্রতিনিয়ত মরছে, ঋণে জর্জরিত কোনো হতভাগাকে দেখলেই তা বোঝা যায়। ঋণের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। আমল ও ইমান নষ্ট হয়। এ কারণেই রসুল (সা.) ঋণ করা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। এক সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসুল (সা.)! আপনি ঋণ থেকে এত বেশি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেন কেন? রসুল (সা.) বললেন, প্রিয় সাহাবি আমার শোনো। মানুষ যখন ঋণ করে তখন বেশি বেশি মিথ্যা বলে এবং ওয়াদা ভঙ্গ করে। এজন্য আমি এ কাজ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি। (বুখারি : ৮৩২)। বাস্তবতাও তাই। অধিকাংশ মানুষই ঋণের কারণে অপ্রয়োজনীয় অনেক মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং কারণে অকারণে ওয়াদা ভঙ্গ করে। এতে সম্পর্কের অবনতির পাশাপাশি ইমান ও আমল দুটিই নষ্ট হয়ে যায়। তাই ঋণ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে। কারণ ঋণ এমন এক বোঝা, যা অধিকাংশ মানুষকেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেয় না। ঋণ এমন যা নেওয়ার সময় হাসিমুখ আর দেওয়ার সময় মনকষাকষি। এ কারণে হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, ‘তোমরা ঋণ করা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ ঋণের শুরু দুশ্চিন্তা দিয়ে আর শেষ হয় ঝগড়াবিবাদ দিয়ে।’ (বায়হাকি : ৬/৪৯)। ঋণকে ‘সম্পর্কের কাঁচি’ বলা হয়েছে। কাঁচি দিয়ে যেমন সহজেই কোনো কিছু কেটে ফেলা যায়, তেমনি ঋণের মাধ্যমে অনায়াসে সম্পর্কে চিড় ধরানো যায়।

ঋণ করার ব্যাপারে শরিয়ত অনুৎসাহিত করলেও ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে ইসলাম অনেক উৎসাহ দিয়েছে। কারণ অনেক সময় অনেকের ঋণ খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ধর্মে বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে ঋণের মাধ্যমে সাহায্য করার প্রতিদান অনেক বেশি। এটি যেমন সত্য তেমনি ঋণের অকল্যাণও দুঃখজনক। তাই প্রয়োজন ছাড়া ঋণ না করাই ভালো। অনেকেই অপ্রয়োজনে কিংবা একটু বিলাসিতার জন্য ঋণ করেন; যা কখনই উচিত নয় এবং নৈতিকভাবেও সমর্থনযোগ্য নয়। অনেকেই আছেন নিজের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ থাকা সত্ত্বেও তা সিন্দুকে কিংবা ব্যাংকে জমা রাখেন, আর অন্যের কাছে ঋণ করে চলেন। এটা খুবই নিন্দনীয়। মূলত ব্যক্তির কৃপণতার কারণেই সে নিজের অর্থ খরচ করতে চায় না। এ ধরনের ধনকুবেরদের আল্লাহ পছন্দ করেন না। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা খাও এবং পান কর। কিন্তু অপব্যয় করো না। নিশ্চয় আল্লাহ অপব্যয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত ৩১)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘তুমি একেবারে ব্যয়কুণ্ঠ-বদ্ধমুষ্টি হয়ো না এবং একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৯)।

প্রয়োজনে এমন অনেক কাজের অনুমতি ইসলাম দিয়েছে যা স্বাভাবিকভাবে অনুমোদিত নয়। যেমন গাছ কাটা। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে আপনি গাছ কাটতে পারবেন, কিন্তু বিনা দরকারে গাছের একটি পাতাও ছিঁড়তে পারবেন না, ছিঁড়লে গুনা হবে। আবার গাছ কাটার পাশাপাশি গাছ লাগানোর ব্যাপারেও ইসলামের নির্দেশ রয়েছে। তেমনি ঋণও প্রয়োজনের সময় বৈধ। প্রয়োজন ছাড়া ঋণ করা এবং ঋণকে ইমান-আমল ও সম্পর্ক বিনষ্টের মাধ্যম বানানো কোনোভাবেই অনুমোদনযোগ্য নয়। তাই যথাসম্ভব চেষ্টা করুন ঋণ থেকে বেঁচে থাকার। ‘ঋণ করব না, আত্মার স্বাধীনতাও হারাব না’— এই হোক আমাদের স্লোগান।

জীবনভর যদি এ প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে পারি, তবেই আমরা কাল কিয়ামতের মাঠে লজ্জিত হব না। হে আল্লাহ! আমাদের দয়ালু রিজিকদাতা! ঋণ করা থেকে আমাদের রক্ষা করে সহজ-সরল পথ দেখান। যে পথে আপনার প্রিয় বান্দারা জীবনযাপন করে গেছেন, আমাদের সেই ঋণমুক্ত জীবনের ব্যবস্থা করে অভাবমুক্ত জীবন দান করুন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর