মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভাবতেও কেমন লাগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নেই

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

ভাবতেও কেমন লাগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নেই

৩১ জানুয়ারি ১৩৩, টাঙ্গাইল-৪ কালিহাতী এই নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ উপনির্বাচন হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কলঙ্কিত নির্বাচন আর কখনো হয়নি। ভোটারবিহীন নির্বাচন, সেও হয়তো কিছুটা সম্মানের। কিন্তু প্রার্থী ছাড়া, ভোটার ছাড়া এমন কলঙ্কজনক নির্বাচন বাপ-দাদার জন্মে কখনো দেখিনি। ছেলেবেলায় শুনেছিলাম, অমাবস্যার রাতে জাত চোর চুরি করার সুযোগ না পেলে নিজের ঘরেই চুরি করে বা চুরির মহড়া দেয়। কিছুই না পেলে শেষ পর্যন্ত ঘরের থালা-বাসন এদিকেরটা ওদিকে করে অভ্যাস ঠিক রাখে। শেষ পর্যন্ত এমনই করেছেন জনাব রকিবউদ্দীনের নির্বাচন কমিশন। কালিহাতী নির্বাচনী আসনে সর্বমোট ভোট ৩,০৭,৭০০। তার মধ্যে শোনা যাচ্ছে নৌকার প্রার্থী পেয়েছেন ১,৯৩,৫৪৭। নিকটতম দুজন মিলে তিন-সাড়ে তিন হাজার। সারা দিন ভোট কেন্দ্রে ভোটার ছিল না। কিন্তু ভোট গণনায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোটারের উপস্থিতি বিস্ময়কর। তেমন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকার পরও বহু কেন্দ্র আগেই সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছিল। তার মধ্যে বল্লভবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সিলমারা বাক্স উদ্ধার করে প্রিসাইডিং অফিসার মাধব চন্দ্র দাসকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এমন জঘন্য নির্বাচন, তাও কেন যেন কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। এমন ভোট কেউ পায়? তিন লাখে দুই লাখ- এও কি সম্ভব? সেই ’৭০ সাল থেকে কেউ পায়নি। পাকিস্তানের শেষে এবং বাংলাদেশে আমাদের নেতা ছিলেন জননেতা আবদুল মান্নান। তিনি টাঙ্গাইল সদর থেকে নির্বাচন করতেন। দেলদুয়ার নিয়ে সদরের ভোট ছিল সবসময় বেশি, সাড়ে তিন লাখের ওপরে। যতবার হেরেছেন, জিতেছেন লাখ ভোট পাননি, পেয়েছেন ৭০-৮০-৯০ হাজার। ’৯৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ আমরা ১০ জন লাখের ওপর ভোট পেয়েছিলাম। সে তো কোনো উপনির্বাচন নয়, সেটা ছিল জাতীয় নির্বাচন। সাধারণত যে কোনো উপনির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে কম ভোট কাস্ট হয়। কালিহাতীতে গত পঞ্চাশ বছর লতিফ সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন। তারা কখনো লাখ ভোট পাননি। একমাত্র ২০০৮ সালে লতিফ সিদ্দিকী যথার্থই এক লাখ তেতাল্লিশ হাজার ভোট পেয়েছিলেন, জালিয়াতি করে এক লাখ তিরানব্বই হাজার নয়। এ যেন বিশ্ব রেকর্ড। হতে পারে, চুরি যখন করবই কম করব কেন? তেমন হলে বলার নেই। তবে অমন হলে দেশের বদনাম হয়, দলের নেতা হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনারও হয়, জাতি হিসেবে আমরা ছোট হই।

আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মীর অমানবিক লাগামহীন কর্মকাণ্ড নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। সিরাজগঞ্জের মেয়র হালিমুল হক মিরুর গুলিতে সাংবাদিকসহ কয়েকজন হতাহত হয়েছে। হালিমুল হক মিরু পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে গুলি চালিয়েছে। এইভাবে জনপ্রতিনিধি যদি হাতিয়ারা হয়, মানুষ যাবে কোথায়? সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যদি গুলি খেতে হয় সাংবাদিকরা যাবে কোথায়? চাঁদপুর হাইমচরের নীলকমল ওছমানিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুদের দাঁড় করে তাদের মাথার ওপর দিয়ে হাইমচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নূর হোসেন পাটোয়ারী হেঁটেছেন। জামালপুর মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের জমিদাতা প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা দিলদার হোসেন প্রিন্স একই কাজ করেছেন। ছবিতে মনে হলো পিঠে নয়, বুকের ওপর হাঁটছেন। ইন্টারনেটের জামানায় সারা পৃথিবীতে ঘটনাটি ছড়িয়ে গেছে। এতে দেশের এবং জননেত্রীর মুখ থাকে কোথায়? আমার স্ত্রী নাসরীন লেখালেখি নিয়ে খুব একটা তেমন কিছু বলে না। চার দিন পর টাঙ্গাইল থেকে এসে টেবিলে বসতেই জামালপুর আর চাঁদপুরে শিশুদের বুকের ওপর হাঁটার ছবি দেখিয়ে বলল, ‘তুমি এর ওপর লেখ’। নিজেও বিষয়টি নিয়ে মনে মনে মোসাবিধা করছিলাম।

কিন্তু রবিবার সকালে পত্রিকা খুলেই দেখি, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত লাইফ সাপোর্টে। লেখাটি পড়া শেষের আগেই সহকারী আলমগীর বলল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা গেছেন। মনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। ৩টায় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় গিয়েছিলাম তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। আওয়ামী লীগ ঘরানার বাইরে তেমন বেশি কেউ ছিলেন না। সাধারণ মানুষ তো নয়ই। তবে সমাজের উচ্চপর্যায়ের প্রচুর লোক ছিলেন। প্রায় সবাই বয়সী মানুষ। আমলা-ফইলা যাদের থাকার কথা, তারা ছিলেন। যে অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যোগ দেন, সে অনুষ্ঠানে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত যাদের থাকার কথা তারা সবাই ছিলেন, কেউ বাদ পড়েননি। আমি দাঁড়িয়েছিলাম লাশের সামনে পশ্চিমমুখী হয়ে। আমাদের একটু বামে পুলিশরা ছিল গার্ড অব অর্নার দেওয়ার জন্য। কঠিন রোদ। মৃদুমন্দ বাতাস না থাকলে থাকা যেত না। রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী আসার জন্য জায়গা রেখে এক দল পুবদিকে আর এক দল পশ্চিমমুখী দাঁড়িয়েছিলেন। আমি পশ্চিমমুখীদের দলে ছিলাম। আমার সামনে ১৪ দলের আহ্বায়ক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, তার গা ঘেঁষে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ছিলেন। আমি তাদের দুজনের মাঝে একটু পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম। দুজনের  পেছনে দাঁড়ালেও আমার খুব একটা অসুবিধা ছিল না। কারণ তারা দুজনই উচ্চতায় আমার থেকে ৪-৫ ইঞ্চি কম ছিলেন। মোজাম্মেল হকের ডাইনে হাসানুল হক ইনু, তারপর সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, বাঁ-দিকে পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, তারপর ’৫৪-’৫৫ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ওয়াদুদ ভাইর মেয়ে প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, পেছনের দিকে অজস্র মহিলা। বয়সী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মনে হয় রোদের মধ্যে অত সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। তাই সংসদ ভবনের দিকে গিয়ে প্রাচীরের ওপরে বসে ক্লান্তি দূর করছিলেন। তার নিদারুণ কষ্ট দেখে আমার খুব খারাপ লাগছিল। কত বড় অর্থমন্ত্রী, প্রবীণ মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না, তারও একটু বসার জায়গা নেই। সমাজে এখন উচ্চপর্যায়ে বড়-ছোটর পার্থক্য নেই, কোনো কষ্টের মূল্য নেই, শ্রদ্ধা-ভালোবাসার লেশ নেই। কনুই মেরে কে কার আগে যেতে পারে তার দুর্বার প্রতিযোগিতা। আগে বুঝতাম না, এখন বুঝি। পারিষদরা জনসম্মুখে যতই ক্ষমতাবান, রাজদরবারে চুনোপুঁটি। কারও কোনো গুরুত্ব নেই বা থাকার কথা না, গুঁতা-নাতা খেয়েও মুখ বুজে থাকতে হয়, তাই থাকে। আমরা মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধুর সময় বড় হয়েছি। তাদের সামনেও একে ওকে দারুণ সম্মান করতে দেখে আমাদের মধ্যে প্রবীণের প্রতি, বিশেষ করে বয়সের লেহাজ করার বাতিক হয়েছে। ১০-১৫ বছর আগে হোটেল সোনারগাঁওয়ে বিশাল এক ইফতার অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। তখনো সংসদ সদস্য ছিলাম। হলের বাইরে করিডরে নামাজে বসেছিলাম। পাশে স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার বসেছিলেন। আমি আমার গায়ের চাদর তার জন্য জায়নামাজের মতো বিছিয়ে দেওয়ায় নামাজ শেষে আমার হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘আপনি ওভাবে আপনার গায়ের চাদর বিছিয়ে দিতে পারলেন?’ বলেছিলাম, এটা আমার মা-বাবার শিক্ষা। তার কেমন লেগেছিল জানি না, আমার মনে হয়েছিল আমি ঠিক কাজ করেছি।’

শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের শেষ বিদায়ে দক্ষিণ প্লাজায় রোদের তাপে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছিল না। এক সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সামনে দিয়ে ঘোরাফেরা করছিলেন। মোহাম্মদ নাসিম বলছিলেন, ‘দেরি করছ কেন? শুরু করে দাও। থাকা যাচ্ছে না।’ অনেকেই এখন সব জায়গায়ই হালকা কথা বলে। তেমনই হচ্ছিল, ‘কাদের ভাইর গামছা আছে, মাথায় পেছিয়ে নিন। অথবা টুপি আছে মাথায় দিন।’ একটু পরে দেখলাম লতিফ ভাই এলেন। আমার সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন, অনেকক্ষণ। একসময় পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ ’৭০-এর সদস্য মনে হয় আমরা এখন ছয়জন রইলাম।’ আবার বললেন, ‘না, আবদুল হামিদ তো প্রেসিডেন্ট। তাহলে পাঁচজন।’ আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। ’৭০-এর নির্বাচনে ৪৬৯ জন সদস্য। তার ১৬৯ জন ন্যাশনাল, ৩০০ জন প্রোভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলির। ১৬৯ জন এমএনএ, ৩০০ জন এমপিএ। স্বাধীনতার পর এ দুটোকে সংবিধান রচনার জন্য এক করা হয়েছিল। ৪৬৯ জনের দুজন পাকিস্তানপন্থি, বাকিরা সবাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। তার মধ্যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তই ছিলেন একমাত্র ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মানে মোজাফফর ন্যাপ। সবমিলে যদি হয় তাহলে ছয়জন থাকবেন কেন? আরও বেশি থাকার কথা। কারণ বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী যদি শুধু সংসদের সদস্য ধরেন তাহলে তিনি কি কয়দিন আগে ময়মনসিংহ ফুলবাড়িয়ার মোসলেম উদ্দিনের কথা চিন্তা করেছেন? তেমন মনে হয় না। আর যদি সংসদের বাইরে চিন্তা করেন যারা ’৭০-এ নির্বাচিত হয়েছিলেন এখন সংসদে নেই তার মধ্যে এখনো তো টাঙ্গাইলের ফজলুর রহমান খান ফারুক আছেন। আরও অনেকেই আছেন। তিনি নিজেও এখন সংসদ সদস্য নন। তাই ভাবছি, লেখাটা শেষ করে একদিন তার সঙ্গে আলাপ করে নেব। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং স্পিকার শ্রদ্ধা নিবেদনে ফুল দেওয়ার পরেই বিরোধী দলের নেত্রী ফুল দেন। আমার কাছে মনে হয় সরকারি দল বাদ পড়ে গেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফুল দিয়েছেন সরকারের প্রধান হিসেবে, সরকারি দলের প্রধান হিসেবে নয়, সংসদের নেতা হিসেবেও নয়। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে যদি রওশন এরশাদ ফুল দিয়ে থাকেন তাহলে সরকারি দল বাদ পড়েছে। আওয়ামী লীগ ফুল দিয়েছে। একত্রে ১৪ দল দিয়েছে কিনা জানি না। সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ প্রয়াত সংসদ সদস্যের জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরতে গিয়ে তার বয়স বললেন ৭১ বছর। তাহলে আমাদেরও তো যাওয়ার সময়। ইন্টারনেটে দেখলাম ৭৭। সারা জীবন জানতাম তিনি লতিফ ভাইর বড়, রাজ্জাক ভাইর বড়, তোফায়েল আহমেদের চেয়ে বয়সে বড়। যাক, বিজ্ঞানের জামানায় বয়সের কিছু হেরফের হতেই পারে। তবে তার জীবন যেভাবে ছিল, সেভাবে তুলে ধরা হয়নি। আর প্রচণ্ড রোদে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছিল না, চলে এসেছিলাম। যেহেতু নিজে থেকে অথবা দল থেকে ফুল নিয়ে যাইনি, নিখাদ শ্রদ্ধা নিয়ে গিয়েছিলাম, তাই রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ফুলমালা দেওয়ার পর চলে এসেছিলাম।

এটা সত্য, শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পা থেকে মাথা পর্যন্ত ছিলেন একজন নিখাদ রাজনীতিবিদ। তার মতো নির্ভেজাল রাজনীতিবিদ পাওয়া মুশকিল। একবারই রেলমন্ত্রী হয়ে সারা জীবনের রাজনীতির সুনামের চেয়ে দুর্নামের রাজতিলক মাথায় পরেছিলেন বেশি। একসময় যারা তার জুতা টানত তারা হাজার হাজার লাখ কোটির মালিক। তারা ভদ্রলোক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দুর্নীতিবাজ। রাজনীতিকদের কপালে এ রকমই জোটে, এ রকমই হয়। রাজনীতিবিদরা কখনো শান্তিতে থাকতে পারে না। হয় সুনামে, না হয় বদনামে- মাঝামাঝি কিছু নেই। কয়েক বছর আগে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আমেরিকায় কী বলেছিলেন, তার জন্য সে কী লাঞ্ছনা! যদিও তিনি সেদিন বাংলাদেশের অবস্থা দেখেননি, তাই সেটা গায়ে মাখেননি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলোও স্বচক্ষে দেখেননি। যুদ্ধের শুরুতে পিছাতে পিছাতে ভারতে গিয়েছিলেন। যখন বিস্তীর্ণ এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে, হাজার হাজার যোদ্ধা জীবন দিতে হিমাদ্রীর মতো দাঁড়িয়ে, তখন নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে দেশে ফিরেছিলেন। এরপরও অনেক সময় বিরক্ত হয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও কখনো কখনো স্বীকার করতে চান না। সারা জীবন বড় ভাই হওয়ার একটা সুবিধা পেয়ে গেছেন। এখন আর এ বয়সে পাবেন না কেন? সেদিন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিদায় অনুষ্ঠানে বলতে গেলে একেবারে একা এসেছিলেন। আমেরিকায় তার হজ সম্পর্কে মন্তব্যের পর দেশে কী অবস্থা হয়েছিল তা হয়তো তিনি এখনকার মতোই ভাবেন। এটা চিরাচরিত ব্যাপার, ‘কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরালে পাঁজি।’ তিনি যাওয়ার পথে শক্ত করে আমার হাত ধরেছিলেন। মনে হলো আশীর্বাদ করে গেলেন।

বলা হচ্ছে শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সাতবার সংসদ সদস্য হয়েছেন। আমার মনে হয় বাংলাদেশ সংসদে সাতবার আর পাকিস্তানের কাঠামোতে একবার, মোট আটবার। ’৭৩ সালের কথা। তেজগাঁও ড্রাম ফ্যাক্টরির পাশে পার্লামেন্টে গেছি। দর্শক গ্যালারিতে বসেছিলাম। মনে হয় ঘণ্টা-দেড় ঘণ্টায় ২০-২৫ বার শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। পার্লামেন্টের অবস্থা তখন আওয়ামী লীগ ২৯১, অন্যান্য ৯। এরকম অবস্থায় যা হয় তাই হচ্ছিল। কীভাবে যেন বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি পড়ে। তিনি উঠে মাননীয় স্পিকারকে অনুরোধ করেন, ‘একজন বিরোধী সদস্য বারবার আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন। আপনি মেহেরবানি করে তাকে ফ্লোর দিন।’ মাননীয় স্পিকার তাকে ফ্লোর দিলে প্রায় ৩০ মিনিট এক পিনপতন বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, আমি আজ যতবার আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি, ব্যর্থ হয়ে আমি যে বেদনা অনুভব করেছি, বেদনাকাতর আমার মলিন মুখ যেমন দেখা গেছে, আজ সংসদের নেতার আসনে যিনি বসে আছেন তিনি যদি আমার এই আসনে বসে বারবার আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যর্থ হতেন এবং আমি ওই নেতার আসনে বসে তার মলিন মুখ দেখতে পেতাম তাহলে আমার মনে কী ভাবের উদয় হতো, তাই ভাবছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একজন মহান নেতা। তাই তিনি আমার অসহায়ত্ব বুঝে আমাকে সময় দিতে সুপারিশ করেছেন। আমি সেজন্য কৃতজ্ঞ। কিন্তু সংসদে আমি একা বলে আমাকে সময় দেবেন না, আমাকে শুনবেন না- এ তো অভিভাবকত্ব হতে পারে না।’ সেদিন শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বঙ্গবন্ধু সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।

কিন্তু সংসদ মুগ্ধ হয়েছিল। সুরঞ্জিত সেনের বক্তব্য শেষে সংসদ নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্পিকারকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘এই সদস্য যখন চাইবে তখনই যেন তাকে সময় দেওয়া হয়।’ ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত শুনেছি তাকে সব সময় সময় দেওয়া হতো। দয়াময় স্রষ্টা তাকে স্বর্গবাসী করুন।

লেখক : রাজনীতিক

সর্বশেষ খবর