মঙ্গলবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

বই মানুষকে জ্ঞানসাধক বানায়

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

বই মানুষকে জ্ঞানসাধক বানায়

একটি দেশ একটি জাতি এগিয়ে যায় জ্ঞান সাধনা করে। জ্ঞান সাধনার মাধ্যমেই বিশ্বনেতৃত্ব অর্জন করে মানুষ। আজকের ইউরোপ-আমেরিকা কীসের শক্তিতে পৃথিবী শাসন করছে? জ্ঞান সাধনার মাধ্যমে। জ্ঞান সাধনার মাধ্যমেই তারা গোটা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। একদিন এ ইউরোপের মানুষই খোলা আকাশের নিচে প্রাকৃতিক কাজ সারত। তারা জানত না সভ্যতা কী। আরও জানত না বর্ণমালা কাকে বলে। জ্ঞানসাধক মুসলমানরা এসে ইউরোপের মানুষদের অক্ষরজ্ঞান শিখিয়েছে। সভ্য করেছে। আফসোস! আজ সেই মুসলমানের উত্তরসূরিরা জ্ঞান সাধনা ছেড়ে দুনিয়ার সাধনা করছে। দুনিয়া সাধনা দোষের নয়, যদি তা জ্ঞানের সঙ্গে হয়। কিন্তু জ্ঞান ছাড়া দুনিয়া সাধন করায় মুসলমান এখন হয়ে পড়েছে হিংস্র মানুষ। কোরআনের ভাষা অনুযায়ী ‘বালহুম আদল্ল’ বরং ‘তারা কুকুর-চারপায়া জন্তুর চেয়েও অধম।’ দুনিয়ার রং ধরতে দুনিয়ার রং পড়তে বেহুশ— এসব মানুষের দিকে তাকালে মনের আয়নায় একটি আয়াতই ভেসে ওঠে যেখানে বলা হয়েছে ‘ফামাসালাহু কামাসালিল কালব— তাদের উদাহরণ হলো কুকুরের মতো।’ কুকুর যেমন পেট ভরা থাকলেও জিহ্বা বের করে লালায়িত থাকে, আবার পেটে ক্ষুধা থাকলেও জিহ্বা বের করে লালায়িত থাকে, আজকের বিশ্ব মুসলমান তেমনই লালায়িত নফসের গোলামে পরিণত হয়েছে। প্রয়োজন-অপ্রয়োজন সব অবস্থায় তারা দুনিয়ার প্রতি লোভাতুর থাকে। এ লালায়িত নফসের মুখে লাগাম পরিয়ে দেয় জ্ঞান। তাই আল্লাহতায়ালা চরম লালায়িত জাতি আরবের ওপর যখন কোরআন নাজিল করলেন তখন প্রথমেই নামাজের নির্দেশ দেননি। দেননি রোজার নির্দেশও। প্রথম যে নির্দেশ দিয়েছেন তা হলো ‘ইকরা-পড়’। জ্ঞান সাধনা কর। জ্ঞান সাধনার মাধ্যমে আগে পশু থেকে মানুষ হও। তারপর নামাজ-রোজা, হজ-জাকাতের মাধ্যমে মুমিন হবে। আর এসব আমলের শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে মুসলমান হয়ে কবরে যাবে। এ কথাগুলো বলেছেন বিশিষ্ট ধর্ম গবেষক হাফেজ আহমাদ উল্লাহ। শায়েখ মূলত কোরআনের ঘোষণারই প্রতিধ্বনি করেছেন। কোরআন বলছে- ‘ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু- ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছ! আমানু-আবার ইমান আনো, দৃঢ় ইমান।’ অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানুত্তা কুল্লাহা- হে বিশ্বাসীরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। হাক্কা তুকাতিহি-যেমন ভয় করা উচিত। ওয়ালা তামুতুন্না ইল্লা ওয়া আনতুম মুসলিমুন- আর শুনে রাখ মুমিনরা! মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না।’ আফসোস! আমরা মানুষ হওয়ার আগে মুসলমান হওয়ার চেষ্টা করছি। তাই তো শুধু মুসলমানের বেশ ধরাকেই মুসলমানিত্ব মনে করে নিয়েছি আমরা। ফলে বিশ্বব্যাপী নৈতিক ও ধর্মীয় বিপর্যয় নেমে এসেছে মুসলমান নামধারী-বেশধারীদের মাধ্যমে। বিশ্বের দিকে তাকালে মুসলমানদের দুর্বিষহ জীবন স্পষ্ট দেখা যায়। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে জ্ঞান সাধনার বিকল্প নেই। কিন্তু মুসলমান তরুণরা জ্ঞান সাধনা ভুলে সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে আজ। ফেসবুক, টুইটারসহ আরও কত কী যে মূল্যবান সময় গিলে খাচ্ছে- এ বিষয়ে চেতনাই নেই মুসলমানের। ‘ক্লাস অব ক্লায়েন্স’ নামে একটি গেমের কথা না বললেই নয়। ইন্টারনেটভিত্তিক এ গেমটি আমাদের জন্য মহামারী আকার ধারণ করেছে। সেদিন অজপাড়াগাঁ থেকে আমার এক আত্মীয় এলো। ক্লাস সিক্স পড়ুয়া ওই ছেলেটি বলছে- ‘ভাইয়া! স্যার আমাদের অঙ্ক করায় আর আমরা বেঞ্চের নিচে মোবাইল রেখে গেমস খেলি।’ একটি অজপাড়াগাঁয়ের দৃশ্য যদি এই হয় তবে লাল-নীল আলো ঝলমলো শহরের চিত্র কত ভয়াবহ হয়ে গেছে ভাবতেই গা শিউরে ওঠছে। আমাদের অজ্ঞতার চিত্র তুলে ধরার পর বলতে চাই, হে মুসলমান! অজ্ঞতার দেয়াল ভেঙে আপনাকে আলোর রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুরু হয়েছে প্রাণের মিলন বইমেলা। এখনো কী ঘুমিয়ে থাকবেন? জেগে ওঠার সময় কী হয়নি এখনো? বইয়ের সুবাস কী আপনার হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে না? ‘ইকরা’র নির্দেশ কি আপনার কলবে ঝংকার তুলে না? আসুন! সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে ঘুরে আসি ‘ইকরা’র মেলা বইমেলায়। হাজার হাজার বই থেকে যদি একটি বইও আপনার অন্তরকে নাড়া দেয়, আপনি যদি কিনে ফেলেন মনের মতো একটি গ্রন্থ সার্থক হবে এই মেলা। পালন হবে ‘ইকরা’ নামক আল্লাহর দাওয়াতের কিছুটা অংশ। বইমেলা হোক আমাদের জন্য হজরত আলীর জ্ঞানের শহরে প্রবেশদ্বার- এ প্রত্যাশা আমাদের। হে আল্লাহ জ্ঞানসাধক বানান মুসলমানকে।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর