শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

তরুণ কৃষি উদ্যোক্তার সাফল্যে এগিয়ে যাচ্ছে কৃষি

শাইখ সিরাজ

তরুণ কৃষি উদ্যোক্তার সাফল্যে এগিয়ে যাচ্ছে কৃষি

বহুদিন আগে স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমাদের দেশের প্রকৃত নায়ক বেরিয়ে আসবেন গ্রাম থেকেই। আজ যেন সে স্বপ্নগুলো পূরণ হচ্ছে। নায়ক বেরিয়ে আসছেন গ্রাম থেকেই। প্রান্তিক ও হতদরিদ্র কৃষকের সন্তানদের ভিতর থেকে কেউ কেউ হয়ে উঠছেন অনন্য সাফল্যের উদাহরণ। তেমনই একজন ভালুকার বাবুল। পাল্টে গেছে ভালুকার পাহাড়ি এলাকার চেহারা। পাল্টে গেছে ভালুকার হাতিবেড় গ্রাম। সদ্য লাগানো বোরো ধানের জমিনের পাশে সুদীর্ঘ সবুজ খেত। যত দূর চোখ যায়, বাবুলের লাউ খেত। লাউয়ের মাচার দৈর্ঘ্যই ৩০ বিঘা। এটি কোনো হাতযশওয়ালা কৃষকের খেত নয়, এটি এলাকার হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষিত তরুণ বাবুলের লাউ খেত। ৩০ বিঘা পাহাড়ি জমিতে লাউ চাষ করে যে সাফল্যের নজির গড়েছেন বাবুল তা ভালুকা উপজেলার জন্য গৌরবের। হাতিবেড় গ্রামের শিক্ষিত তরুণ বাবুল পতিত জমি লিজ নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তার লাউবাগান, যা এখন এলাকার অন্যদের কাছে অনুকরণীয়। বাবুলের খেতে গিয়ে দেখি চোখ জুড়ানো দৃশ্য। চারদিকে ঘন সবুজ। মাচায় মাচায় ঝুলছে হাজার হাজার লাউ। এক দিন পরপর বাজারে যাচ্ছে লাউ। প্রতিদিন কাটলে লাউ আসত ১ হাজার করে। এক দিন পরপর কাটায় বাবুল পাচ্ছেন ২ হাজার লাউ। আসছে নগদ টাকা। আমার সুদীর্ঘ ৪০ বছরের উন্নয়ন সাংবাদিকতার পথচলায় শুধু এ এলাকায় নয়, সারা দেশেই একদাগে এত বড় লাউ খেত আর আছে বলে মনে পড়ে না। লাউয়ের রাজ্যে আর তরুণ কৃষি উদ্যোক্তার উন্নয়নের

জোয়ারে যেন ভাসছে হাতিবেড় গ্রামের সবুজ লাউ খেত। তরুণ মনের সবটুকু স্বপ্ন-সাহস বাবুল প্রয়োগ করেছেন এখানে। নিজে কৃষিশ্রমিকদের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে তবেই নিশ্চিত করেছেন এমন সাফল্য। বাবুলের সঙ্গে কথা বলে জানলাম ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তিনি। বাবুল আরও জানালেন, চ্যানেল আইয়ের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ তাকে অনুপ্রাণিত করেছে একজন সফল কৃষক হয়ে উঠতে। এ ৩০ বিঘা জমি কিনতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে বাবুলকে। নিজের কিছু জায়গা-জমি বিক্রি করে জোগাড় করেছিলেন ৪ লাখ টাকা। আর এনজিও থেকে ধার নিয়েছেন ৪ লাখ। এ ৮ লাখ টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন বিশাল লাউবাগান। পাঠক! বাবুল হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। যে পরিবার থেকে লেখাপড়া শেখা-ই অনিশ্চিত ছিল, সেখানে তিনি শত প্রতিবন্ধকতা স্বীকার করেই ম্যানেজমেন্ট বিভাগে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে এসেছেন নিজ উদ্যোগে। এই দরিদ্র পরিবার থেকে লেখাপড়া শিখে সাধারণত সবাই চাইবে চাকরি-বাকরি করে দ্রুত অর্থ উপার্জন করতে। কিন্তু বাবুল এখানেই ব্যতিক্রম। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন গোটা এলাকাকে জাগিয়ে তোলার। তিনি যে কাজটি ভালোমতো করতে পারবেন সে কাজেই যুক্ত হয়েছেন। কৃষি ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে বাবুল এখন অনেক বড় স্বপ্ন দেখতে শিখেছেন। একসময় এ জায়গাটি ছিল জঙ্গলে পূর্ণ। সে জঙ্গলে থাকত নানা জীবজন্তু। দুর্গম এ পাহাড়ে কেউ কখনো পা মাড়াত না। সেই দুর্গম জায়গাতেই সোনা ফলাচ্ছেন বাবুল। কিন্তু এখনো বেশকিছু অসুবিধা রয়ে গেছে। বাবুল সেচসুবিধার সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে বললেন, এটি একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় সেচব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা বেশ দুষ্কর। এ ছাড়া রোগবালাইও রয়েছে। কৃষি অফিসার এত দূর পর্যন্ত আসেন না। ফলে নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি দিয়েই চলে লাউয়ের পরিচর্যা। স্থানীয় কৃষি বিভাগের সহায়তা না পাওয়ার বিষয়টি বেশ হতাশার। তবে বাবুল আশা করেন, ঠিকমতো লাউ বাজারজাত করতে পারলে যে ঋণ তিনি নিয়েছেন তা খুব কম সময়ের ভিতর পরিশোধ করতে পারবেন। মাত্র এক বছর আগে শুরু করে এখন এক দিন পরপর এ খেত থেকে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার লাউ কাটা হচ্ছে। এ মৌসুমে ইতিমধ্যে ৪-৫ লাখ টাকার লাউ বিক্রি হয়েছেন; যে লাউ আছে তা বিক্রি হবে কমপক্ষে ৭-৮ লাখ টাকায়। বেশিও হতে পারে। বাবুলের স্বপ্ন খেতের পরিধি আরও বাড়ানো। আত্মবিশ্বাসী বাবুল এই সাহসী উদ্যোগে পাশে পেয়েছেন এলাকার কিছু মানুষকে। তার মধ্যে রয়েছেন তার কলেজশিক্ষক মাসুদ রানা। মাসুদ রানা বাবুল সম্পর্কে জানালেন বাবুল অত্যন্ত পরিশ্রমী একজন মানুষ। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাবুল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মাসুদ রানার মতে বাবুল এলাকায় যে নজির গড়েছেন তা পুরো দেশের তরুণদের জন্য উদাহরণ। একই সঙ্গে পড়াশোনার পাশাপাশি এমন সফল কৃষি উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার ঘটনাটি বাস্তব, কোনো কল্পনার দৃশ্য নয়। এলাকার কিশোর-তরুণের কাছে বাবুল এখন এক অনুপ্রেরণা। অবশ্য এখন গ্রামাঞ্চলে কিশোর-তরুণদের মধ্যে লেখাপড়ার পাশাপাশি কৃষি উদ্যোগ বেশ লক্ষণীয়। কেউ পোলট্রি করছেন, কেউ অন্যান্য কৃষি পেশার সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি সত্যিই আশার এক গল্প শোনায়। শুধু কিশোর-তরুণ নয়, এলাকার সব মানুষের কাছেই বাবুল এক মডেল কৃষক। তার এ কৃষি উদ্যোগের ভিতর দিয়ে এলাকাবাসীরও চোখ খুলে যাচ্ছে দিন দিন। বীজ ব্যবসায়ী আলাল বললেন ভিন্ন কথা। তার মতে কৃষকের প্রতি সরকারের যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকলেও মাঠপর্যায়ে সে আন্তরিকতা তেমন একটা দেখা যায় না। তার ইঙ্গিত ছিল মাঠপর্যায়ে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের দিকে। কৃষকের মনে এখন স্বস্তি এসেছে এজন্য যে, আগে ফসলের লাভের বড় অংশটি পাইকারের পকেটে যেত। এখন কৃষকও পাচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত লাভ। বাবুলের খেতে গল্প করতে করতেই একপর্যায়ে শুরু হলো লাউ কাটা। পাইকার মাঠেই হাজির। পাইকারের তত্ত্বাবধানেই খেত থেকে চলছে লাউ সংগ্রহ। একটি দুটি নয়, শত শত লাউ সকাল থেকে দুপুর অবধি কাটা চলতে থাকে। তা নিয়ে অতি যত্নে জমা করা হয় খেতের পাশে। লাউ এমনই এক সবজি যার গায়ে কোনো ক্ষত তৈরি হলেই আর দাম পাওয়া যায় না। বাবুল সে বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক। আপনারা সবাই জানেন, শীতের সবজি হিসেবে লাউয়ের কোনো তুলনা নেই। কচি লাউ দেখলেই সুস্বাদু নানা রেসিপির কথা মনে পড়ে যায়। কচি লাউয়ের সঙ্গে বাঙালির প্রাণ যেন মিশে আছে।

প্রিয় পাঠক! তরুণ উদ্যোক্তা বলতেই বিশ্বব্যাপী বোঝানো হয় শহর-নগরের হাজারো সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষিত তরুণকে। যারা পোশাক-বেশভূষায় আর মুখের কথায় আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখাতে পারেন। বাস্তবতা তাদের কাছ থেকে অনেক দূরেই থাকে। তারা নিজে হাতে উদ্ভাবন, নিজে হাতে সংকট মোকাবিলা, আর কঠিন কঠিন সংগ্রামের পথ পার করেন না। তাদের বেশির ভাগই বাস করেন কল্পনার রাজ্যে। কিন্তু ভালুকার হাতিবেড় গ্রামের বাবুল তা নন। বাবুলরা কঠিন সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে জাতির সামনে হাজির করেন অভাবনীয় সাফল্য। যে সাফল্যের কোনো তুলনা নেই। যে সাফল্য বলে দেয়, বাবুলরাই আমাদের আগামী দিনে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ রচনার সবচেয়ে সহায়ক শক্তি। বাবুলের লাউ খেত তার স্বপ্নের সমান বড় হোক। এক বাবুলের দেখাদেখি দেশে অসংখ্য বাবুল গড়ে উঠুক, এই আমার প্রত্যাশা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর