রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

যে আমারে কাঁদায় সে কেন কাঁদে না নিজে

মাকিদ হায়দার

যে আমারে কাঁদায় সে কেন কাঁদে না নিজে

কুঞ্জবন শব্দটি দীর্ঘদিন আমার মাথার ভিতরে আটকে ছিল। যে কুঞ্জবনে একদা কৃষ্ণ বাঁশি বাজাতেন। গরু চড়াতেন, সেই কুঞ্জবনে রাধিকা যেতেন। তার প্রেমাস্পদের কাছে সুখসঙ্গ দিতে এবং নিতে, যমুনাতে জল আনার ছল করে চলত তাদের অভিসার। অতি সম্প্রতি এমন একটি অভিসারের আয়োজন করেছিলেন। রাজশাহীর ‘কবি কুঞ্জ’ নামের একটি শিল্প সাহিত্যের সংগঠন। বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে শিল্প সাহিত্যের চর্চা, ১৯৭৫ সালের পর থেকে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ হয়েছিল এবং তার স্বরূপ উদঘাটিত হয়েছিল বেশ কয়েক বছর পর। মৌলবাদীদের আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে লুপ্ত হয়েছিল বাঙালির যাবতীয় সংস্কৃতি শিল্প এবং সাহিত্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শহিদ ইকবাল ‘চিহ্ন’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিন বের করলেও অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান তেমন কোনো লিটল ম্যাগাজিন কিংবা মাসিক, ত্রৈমাসিক, পত্রিকা বের করেছিল কিনা আমার জানা না থাকলেও এ বছরের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমবাগানের নিচে আয়োজন করেছিলেন চিহ্ন ছোট কাগজের জন্ম উৎসব। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে কবি, ছড়াকার, গল্পকার কথকসহ ভারতের কলকাতা থেকে কয়েকজন কবি এসেছিল সেই জন্ম উৎসবে। প্রফেসর আনিসুজ্জামান, সেলিনা হোসেন, বিশিষ্ট কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক ও ড. অসিত সাহা এবং উদ্বোধক ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোহাম্মদ মিজান উদ্দিন। চিহ্ন ছোট কাগজের সঙ্গে যুক্ত অধ্যাপক রহমান রাজু, তবিবুর রহমান, তৌফিক জহুরী এবং মর্মরিদ ঊষা ও সৈকত আরেফিনসহ অনেক কবি। অপরদিকে ২০১০-২০১৩ রাজশাহী বিভাগের দায়িত্ব পেয়েছিলেন বিভাগীয় কমিশনার হিসাবে জনাব আবদুল মান্নান। যিনি কবি আসাদ মান্নান নামে সমধিক পরিচিত। কবি আসাদ মান্নান রাজশাহীতে শিল্প সাহিত্যে এক নতুন জোয়ারের সৃষ্টি করেছিলেন। সমগ্র উত্তরবঙ্গের প্রতিটি জেলায় গিয়ে তিনি স্থানীয় কবিদের নিয়ে শিল্পসাহিত্যের আসরে তরুণ কবিদের উৎসাহিত করতেন। নবীন এবং প্রবীণ কবিদের। সেই প্রবীণদের ভিতরে কবি ওমর আলী, যিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার পেলেও তার আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। সে কথা জেনে কবি আসাদ মান্নান কবি ওমর আলীর চর কোমরপুরের বাড়িটি নির্মাণের জন্য প্রচুর আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন। তখন পাবনার জেলা প্রশাসক ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। জনাব রহমান তার কার্যকালীন সময়ের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কর্মের ভিতরে ঈশ্বরদী, নগরবাড়ী, রেলওয়ের জমি হুকুম দখল করতে গিয়ে কিছুটা অসুবিধা হয়েছিল। সেই অসুবিধার সৃষ্টি করেছিল কতিপয় ভূমিদস্যু। অপরদিকে পাবনা শহরের জামতলা রোডের পশ্চিম দিকের প্রায় বিঘা খানেক জমি দখল করে রেখেছিল ভূমিদস্যুরা। ওই জমিটির মূল মালিক ছিলেন পাবনার পানি উন্নয়ন বোর্ড। বোর্ড যখন কোনো কাজে লাগাতে পারেনি তখনই সেই জায়গাটিতে পাবনার ‘শিল্পকলা একাডেমির’ জন্য জায়গা দখল নিতে গিয়ে প্রশাসন বনাম ভূমিদস্যুদের ভিতরে গণ্ডগোল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। জেলা প্রশাসকের দৃঢ় মনোবলের কারণে একপর্যায়ে ভূমিদস্যুদের বাড়িঘর রাতারাতি সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। জনাব মোস্তাফিজুর রহমানকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছিলাম এই বলে যে, জায়গাটির পশ্চিমে জেলা জজের বাড়ি। ঠিক উত্তরেই সুচিত্রা সেনের বাড়ি। কবি আসাদ মান্নান বিভাগীয় কমিশনার থাকাকালীন সময়ে যে শিল্পসাহিত্যের আবহ সৃষ্টি করেছিল সেটি অবশ্যই স্মরণযোগ্য। এমনকি কবিদের নিয়ে বসন্তকালীন কবিতা উৎসবের ব্যবস্থা করেছিলেন রাজশাহী জেলা পরিষদ ভবনে এমনকি খোলা মঞ্চেও একাধিকবার কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করায় ঢাকার অনেক কবিকেই যেতে হয়েছিল আসাদ মান্নানের আমন্ত্রণে রাজশাহী কবিতা পাঠের আসরে। সৈয়দ শামসুল হক, আনোয়ারা সৈয়দ হক, রফিক আজাদ, দিলারা হাফিজ। নির্মলেন্দু গুণ, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, টোকন, ঠাকুর নাসির আহাম্মেদ, হাবিবুল্লাহ সিরাজি, আরিফ হায়দার, অসীম সাহা, সিহাব শাহারিয়ারসহ সমগ্র বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন নবীন প্রবীণ কবিরা। সুখের বিষয় প্রায় প্রতি কবিকেই তিনি সম্মানীসহ ট্রেনে প্রথম শ্রেণির টিকিটের ব্যবস্থা করেছিলেন। আগে কোনো বিভাগীয় কমিশনার করেছিলেন কিনা আমার জানা নেই। এখন যিনি বিভাগীয় কমিশনার জনাব আবদুল হান্নান, তিনি একদা আমার সহকর্মী ছিলেন বিসিকে (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা)। গত অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে জনাব আবদুল হান্নানের সঙ্গে দেখা হলো রাজশাহীর একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁয়। দুপুরের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রাজশাহীস্থ ভারতীয় উপ দূতাবাসের কর্ণধার, শিল্পসাহিত্য ও কবিতা প্রেমিক শ্রী অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। কবি কুঞ্জের প্রাণপুরুষ। কবি রুহুল আমির প্রামাণিক, কবি আরিফুল হক কুমার, বিশিষ্ট কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকসহ আরও অনেকের ভিতরেই ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার জনাব আবদুল হান্নান। সেই দিন দুপুরের ভোজনান্তের পর আবদুল হান্নানকে অনুরোধ করেছিলাম, জনাব আবদুল মান্নান (কবি আসাদ মান্নান) বিভাগীয় কমিশনার থাকতে যেভাবে শিল্পসাহিত্যের বিস্তার এই রাজশাহী বিভাগে হয়েছিল তোমার বেলাতেও হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমার কথায় তিনি খুশি হয়ে জানালেন, আমাদের সাতক্ষীরায় প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের কবিকুল এসে যদি সাহিত্য মেলা করতে পারে, তাহলে রাজশাহী বিভাগের শহরে অবশ্যই হতে পারে। তখনই তিনি কবি কুঞ্জের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল হক কুমারকে জানালেন আগামী মহান বিজয় দিবসের আগে পিছে শিল্পসাহিত্যের অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। শুনে সবাই খুশি হলাম। বিশেষত আমরা যারা কবিতার কর্মী ছিলাম সেই দিনের সেই ভারতীয় উপ-দূতাবাসের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে। রাজশাহীর কবি কুঞ্জের জন্ম খুব বেশিদিনের নয়। ইতিমধ্যে পাঁচ বছর কাল অতিক্রম করেছে। তবে পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ২১ অক্টোবর ২০১৬ শুক্রবার কবি কুঞ্জের উদ্বোধনীর দিনে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য জনাব ফজলে হোসেন বাদশা,

হাসান আজিজুল হক, অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি জুলফিকার মতিন, অনীক মাহমুদ, ঝর্ণা রহমান, রফিকুর রশিদ, মনি হায়দার, নাজমা মান্নান, আসাদ মান্নানসহ বিভিন্ন জেলার এবং বগুড়ার কবি ইসলাম রফিক, সিকতা কাজল, কামরুন্নাহার কোহেলী, শিবলি মোক্তাদী এবং কুষ্টিয়ার বাবুল জোয়ারদার, চট্টগ্রামের একদল তরুণ কবির সমাগমে সারা দিন যে কোথায় গিয়ে কেটে গেল জানতেই পারলাম না। বরিশালের কবি নাহিদা আশরাফী জানালেন দুই দিনের ‘কবি জীবনানন্দ দাশের’ প্রয়াণ দিবসে এই অনুষ্ঠান প্রতিবছরই কবি কুঞ্জের সভ্যরা করে থাকেন। ঠিক তখনই কবি কুঞ্জের আরেক সভা কবি কামরুল বাহার আরিফের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলাম সমগ্র বাংলাদেশ থেকে কতজন কবিতা প্রেমিক কবি কুঞ্জের এই অনুষ্ঠানে এসেছেন। তিনি জানালেন, দুই দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের যাবতীয় খচরা খরচ, থাকা খাওয়া, কবি কুঞ্জের এবং অনেকের জন্যই ট্রেনের ও বাসের ভাড়া আমরাই দিয়ে থাকি। গত রাত পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ থেকে দুইশ আটচল্লিশ জন এই সম্মেলনে এসেছেন। পরের দিন শনিবার। শনিবারে সাত সকালে কবি কুঞ্জ অনুষ্ঠানের মাঠ শাহ্মখদুম কলেজের চত্বরে গিয়ে সবাই উপস্থিত হলাম। রাজশাহী শহরে পশ্চিমে আছে দৃষ্টিনন্দন ১২৫ বিঘা জমির উপরে একটি আমবাগান। সেই বাগানের ভিতরে আছে পিকনিকের সুবিশাল ব্যবস্থা। প্রায় শ’দুয়েক লোকের সকালের নাশতা, দুপুরের উত্কৃষ্টমানের খাবার ব্যবস্থাসহ কবিতা পাঠের এবং অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন কবি কুঞ্জের কৃষ্ণরা। কবি আসাদ মান্নান, ইসলাম রফিক, কামরুল বাহার আরিফ, আমিসহ দেশের অনেকেই কবিতা পাঠ করেছিলেন এবং গান গেয়ে শুনালেন নাজমা মান্নান, সিকতা কাজল এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আরিফ হায়দার একক অভিনয় দেখিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করলেন। অনুরূপভাবে মুগ্ধ করলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী মামুন হায়দার। তিনি রাজশাহীতে একটি গানের দল বানিয়েছেন। সদস্যরা অধিকাংশই নিম্নবিত্তের। ওই নিম্নবিত্তের মানুষগুলো তাদের কাজকর্ম ফেলে প্রায়শই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় গানবাজনা করে বেড়ান, করে থাকেন। ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে দলটির নামও হৃদয়গ্রাহী। ‘মাতাল বাউল’ সেই দিন ছিল ২২ অক্টোবর শনিবার। শনিবারের সন্ধ্যায় শুরু হয়েছিল শাহ মখদুম কলেজের মাঠে প্রচুর লোকের সমাগম ও অনেক দর্শকের উপস্থিতিতে বইমেলা এবং কবি কুঞ্জের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের ছোট গল্প নিয়ে আলোচনা করলেন বিশিষ্ট উপন্যাসিক গল্পকার জাকির তালুকদার, রফিকুল রশিদ, পশ্চিমবঙ্গের অমর মিত্র এবং মনি হায়দার ও আরও অনেকেই। পরের সেশনে শুরু হয়েছিল কবিতা পাঠের আসর। কবি জুলফিকার মতিন, কবি সব্যসাচীদেব, সিরাজুদ্দৌলা বাহার, কবি অচিন্ত্য চয়ন, বাবুল জোয়ারদার এবং বান্দরবানের কবি বাবুল চৌধুরী, চট্টগ্রামের উজ্জ্বল একঝাঁক কবি, বগুড়ার তরুণ কবিদের কয়েকজন আমরা যারা ঢাকা থেকে গিয়েছিলাম তাদের ভিতরে কবিতা পাঠ করেছিলাম মিলন সব্যসাচী এবং  আমি, সুখের বিষয় কবি জীবনানন্দ দাশ পুরস্কার এবার আমাকে ক্রেস্টসহ দিলেন কবি কুঞ্জ কর্তৃপক্ষ। যার অর্থমূল্য অকল্পনীয়। শেষের অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিয়েছিলেন কথাশিল্পী— কথার নায়ক, হাসান আজিজুল হক। তিনি তার বক্তৃতায় জানালেন কবি কুঞ্জের যাত্রার কথা এবং আরও জানালেন উপস্থিত সুধীদের, বাংলাদেশের ‘হায়দার’ পরিবারের ভাইদের কথা, যারা শিল্প সাহিত্য নিয়ে ধ্রুবজ্যোতির মতো উজ্জ্বল করেছে বাংলাদেশের সাহিত্য, ক্রমান্বয়ে আমাদের কয় ভাইয়ের নাম বলার পরে জানালেন হায়দার পরিবারের অগ্রজ জিয়া হায়দার। তিনি ১৯৫৬ সালে আমার সহপাঠী ছিলেন এই শহরের রাজশাহী কলেজের, তিনি আনন্দের সঙ্গে জানালেন তরুণ কবিদের কথা এবং দুঃখ প্রকাশ করলেন তরুণ কবিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শেষমেশ আমার জীবনানন্দ দাশ পুরস্কার প্রাপ্তির ওপর আমাকে অনুমতি জানাতে বলা হলে, জানিয়েছিলাম ২০১২ সালে প্রথম আমাকেই পুরস্কারে ভূষিত করেছিলেন টাঙ্গাইলের ভাষা সৈনিক সোফিয়া খাতুন খান স্মৃতি পুরস্কার, যেটি অরণি সাহিত্য পুরস্কার। ১৭ ডিসেম্বর ২০১২-তে প্রদান করেছিলেন কবি বুলবুল খান মাহবুব সভাপতি ছিলেন, আরও ছিলেন আনিসুর রহমান মিয়া, ফজলুল রহমান খান ফারুক। অরণি সম্পাদক কবি মাহমুদ কামাল, অপরদিকে বগুড়ার লেখক চক্র ২০১৩ সালে ২৭ সেপ্টেম্বর আমাকে ওই টাঙ্গাইলের মতোই অর্থসহ ক্রেস্ট দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন লেখক চক্রের সভাপতি কবি ইসলাম রফিক ও সাধারণ সম্পাদক আমির খসরুও সেলিম সেখানে অনুভূতি জানাতে গিয়ে সত্য কথা বলতে হয়েছিল, গত শতকের শেষের দিকে ফরিদপুরের জনকয়েক তরুণ এলেন আমার অফিসে তারা এসে জানালেন, এ বছর আমরা ফরিদপুর সাহিত্য সংসদ থেকে আপনাকে পুরস্কার দেব। শুনে আনন্দিত হলাম পরে তারা জানালেন কিছু অর্থের সংস্থান করে দিতে হবে। আমি তাদের বিমুখ করে বিদায় দিয়েছিলাম। অনুরূপ আর একটি ঘটনা যশোরের জনকয়েক কবিতা প্রেমিক যশোর সার্কিট হাউসে এসে আমাকে জানালেন তারা আমাকে পুরস্কার দেবেন। একজন অখ্যাত ব্যক্তির নামে, কথা প্রসঙ্গে জেনে নিলাম সেই অখ্যাত ব্যক্তির নাম। বিসিক শিল্পনগরী, জুম জুমপুরে একটি শিল্প প্লটের প্রয়োজন তার। আমি যদি পুরস্কার গ্রহণে রাজি হই তাহলে ওই শিল্প মালিক অর্থ প্রদানে রাজি আছেন। আরও জানলাম ভদ্রলোক নিজে একজন চোরাকারবারি। তিনি এখন শিল্পপতি হওয়ার পথে যশোরের শিল্পনগরীতে যদি একটি কারখানা স্থাপন করতে পারেন। তবে তিনি সমাজে শিল্পপতি হিসেবে গণ্য হতে পারেন। যশোরের তরুণ কবিদের দোষ দেওয়াটা সমীচীন নয়, কিন্তু তারা জানতে পারেনি, আমি ওই পুরস্কার গ্রহণে অসম্মতি জানাব।

অথচ টাঙ্গাইল, বগুড়ার রাজশাহীতে তারা যেভাবে পুরস্কার দিয়ে একজন কবিকে সম্মানিত করলেন সেটি অবশ্যই স্মরণযোগ্য। উপস্থিত স্রোতাদের ভিতর থেকে গুঞ্জন শুনলাম এবং অনেকেই জানালেন আজকাল টাকা দিলেই ক্লাবের সভাপতি থেকে শুরু করে শিল্পসাহিত্যের সভাপতি হওয়া যায়। গত অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বগুড়া লেখক চক্রের ২৮মত জন্মবার্ষিকীতে গিয়েছিলাম প্রধান অতিথি হয়ে। সঙ্গে ছিলেন গল্পকার অনুবাদক, নুরুল করিম নাসিম এবং ছড়াকার আলম তালুকদার দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান হয়েছিল বগুড়ার উডবার্ন হলে স্রোতাদের অভাবনীয় সহযোগিতা লক্ষ্য করলাম সভাপতি ছিলেন কবি আমিনুল ইসলাম। দুই সন্ধ্যায় গল্প কবিতা উপন্যাস ও ছড়া নিয়ে আলোচনা হয়েছিল এবং দুই সন্ধ্যায় বগুড়ার আঞ্চলিক ভাষায় গান করেছিলেন দুজন শিল্পী সিকতা কাজল এবং একজন অন্ধগায়ক। ৯ অক্টোবর রবিবারে বগুড়ার লেখক চক্রের চক্রীদের নিয়ে গিয়েছিলাম রবি ঠাকুরের কুটিবাড়ি দেখতে পতিসরে, যাওয়ার পথে পড়েছিল সেই বিখ্যাত নন্দীগ্রাম যে গ্রামের লোকেরা চাঁদের ভিতরে দেখতে পেয়েছিল সাঈদীকে ২০১৪ সালে, তবে শহর থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতে কবি আবদুল খালেক গাড়ি থামিয়ে আমাদের নিয়ে গেলেন একটি বধ্যভূমিতে। ১৯৭১ সালে যাদের হত্যা করেছিল পাকিস্তান আর্মিরা, যারা বয়সে ছিলেন তরুণ গ্রামবাসী এবং সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, তাদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে যাদের হত্যা করেছিলেন সেই সব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম। (১) শহিদ সাইফুল ইসলাম (২) জালাল উদ্দিন জালাল, (৩) আবদুল কুদ্দুস নান্টু (৪) আবদুল কাদের বাদশা, (৫) বাচ্চু শেখ বাচ্চা মিয়া, (৬) আবদুল মান্নান, মান্না, (৭) আলতাফ আলী আলতা, (৮) আবদুস ছবুর ভোলা, (৯) মহিলা মুক্তিযোদ্ধা নূরজাহান লক্ষ্মী, (১০) মোফাজ্জল হোসেন আবুল, (১১) আবদুল হান্নান, (১২) ওয়াজেদুর রহমান টুকু, (১৩) ফজলুর রহমান খান ফজলুসহ। অজ্ঞাতদের কাছেই যে পুকুরটি আছে তারই পাড়ে হত্যা করে ফেলে দিয়েছিল পুকুরের পানিতে। আবদুল খালেক একাধারে শিশু সংগঠক এবং বগুড়ার লেখক চক্রের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি যখন ওই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন লক্ষ্য করলাম তার চোখ দুটি ভেজা। পতিসরে গিয়ে ঠাকুরবাড়ির স্থাপত্য দেখলাম এবং একই সঙ্গে দেখলাম ১৯৩৭ সালে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে প্রতিষ্ঠিত রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশন পতিসরের কুঠিবাড়ির পূর্ব দিকেই সেই বিখ্যাত নাগর নদী। পতিসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ ‘ইছামতি’ কবিতাটি লিখেছিলেন। ছিন্নপত্রের ১৪ সংখ্যক চিঠিও লেখা হয়েছিল ০৬ (ছয়) মাঘ ১৮৯১ সালে। তিনি ওই চিঠিতে লিখেছিলেন ‘আমার বোট কাচারি থেকে অনেক দূরে এনে একটি নিরিবিলি জায়গায় বেঁধেছি।’ সেই বোটটিকে দেখলাম সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির অজস্র ছবি এবং ওই বোটটির বিশাল নোঙর। নাগর নদীতে মুখ ধুতে গিয়ে নিজেকে খুব শুভ্র মনে হলো। কিন্তু নদীটির পশ্চিম পাড়েই নদীর ভিতরে স্থানীয় প্রভাবশালীদের এক তলা, দুতলা দোকান উঠেছে ৯টি। সেখান থেকে কাচারি বাড়ির দূরত্ব ৩-৪ মিনিটে। তখন দুর্গোৎসব চলছিল। মণ্ডপে দেখলাম প্রচুর লোকের সমাগম। ছোটকালে যেভাবে আমাদের পাবনার পূজার মণ্ডপে দেখেছি এবং সেইভাবে গিয়েছিলাম দুর্গা ঠাকুরকে দেখতে। এবারও গিয়েছিলাম ঠিক সেভাবে। কিন্তু আমার মাথায় সাদা চুল। তাই আমার অতীত নিয়ে কিছুদিন আগে একটি কবিতা লিখেছিলাম। ‘যে আমারে কাঁদায় সে কেন কাঁদে না নিজে’।

লেখক :  কবি

 

সর্বশেষ খবর