সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

হোন্ডা গুণ্ডা আর মণ্ডা এই তিন নির্বাচনের পাণ্ডা

মেজর মো. আখতারুজ্জামান (অব.)

হোন্ডা গুণ্ডা আর মণ্ডা এই তিন নির্বাচনের পাণ্ডা

নির্বাচন কমিশন হলো একটি সাংবিধানিক ও আদর্শিক কিন্তু দুর্বল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন কমিশন জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের একমাত্র নিয়ামক প্রতিষ্ঠান কিন্তু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক পক্ষ সব সময় নির্বাচন কমিশনকে তাদের অনুগত করে রাখতে চায়। যার ফলে নির্বাচনের মাঠে সবচেয়ে দুর্বল একজন রেফারিতে পরিণত হয় নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের সময় সবাই নির্বাচন কমিশনকে হাতে রাখতে চায়, কারণ সবার ধারণা নির্বাচনে জয়ী হতে হলে নির্বাচন কমিশনকে হাতে রাখতে হবে, তাই সবাই বেচারা নির্বাচন কমিশনের দয়া এবং দাক্ষিণ্য কামনা করে। শুধু কামনা নয় একেবারে নির্বাচন কমিশনকে তাদের পকেটে পুরে ফেলতে চায়।

জনগণের কাছে যেসব প্রার্থীর কদর কম তাদের কাছে নির্বাচন কমিশন দেবতার মতো এবং প্রধান নির্বাচন কমিশন জনধিকৃত দল বা প্রার্থীদের কাছে যেন ভগবান। তারা মনে করে নির্বাচন কমিশন চাইলেই যে কোনো প্রার্থীকে নির্বাচনে জয়ী ঘোষণা করে দিতে পারে। জনগণের ভোটের প্রয়োজন পড়ে না এবং মাঝে মাঝে রকিবমার্কা নির্বাচন কমিশন এ ধরনের তেলেসমাতি দেখায়ও বটে। তাই ওই সব কম জনপ্রিয় দল বা ব্যক্তির কাছে জনগণের চেয়ে নির্বাচন কমিশন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন যা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই।

নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধান জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন, ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও জাতীয় সংসদের এলাকা নির্ধারণ করার জন্য নির্বাচন কমিশন সৃষ্টি করেছে। নির্বাচন জাতীয় সংসদের এবং বর্তমানে স্থানীয় সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে কাজ করবে এবং সব রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বে তার স্থান কিন্তু সংবিধান এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান ও ক্ষমতা নিয়ে একটি শব্দও সংযোজন করেনি। জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দায়িত্ব এককভাবে সংবিধান নির্বাচন কমিশনের কাঁধে দিয়েছে কিন্তু এককভাবে সেই নির্বাচন করার কোনো ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়নি।

নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দায়িত্বও দিয়েছে কিন্তু সেই নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সরকারের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। সাম্প্রতিক সময় থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও রাজনৈতিক দলভিত্তিক করা হয়েছে, যার ফলে নির্বাচন কমিশনের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে যে চাপ সহ্য করা অনেক সময় নির্বাচন কমিশনের জন্য কঠিন হয়ে যায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দায়িত্বের কারণে সারা বছরই নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। নির্বাচন কমিশনে লোকবল খুবই কম যার ফলে নির্বাচন কমিশনকে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই নির্ভরশীলতার কারণে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সব সময় প্রত্যাশিত মানের নির্বাচন করা সম্ভব হয় না। স্থানীয় সরকার প্রশাসন দেশের একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন স্তর যেখানে অনৈতিক কাজই কোনো কোনো ক্ষেত্রে নৈতিক কাজ হিসেবে স্বীকৃত। অবৈধ আর্থিক লেনদেন একটি খোলা মেলা বিষয়। উপজেলা পর্যায়ে দুর্নীতি করে না এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার ওপরে আছে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব বিস্তার করার নগ্ন প্রতিযোগিতা। এমন অস্বস্তিকর পরিবেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের চিন্তা সোনার পাথর বাটির মতো কল্পবিলাস। নির্বাচন কমিশনের আরেকটি প্রধান কাজ হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এলাকা নির্ধারণ। সংবিধান জাতীয় সংসদের আসনের এলাকা নির্ধারণের একক ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছে কিন্তু জাতীয় সংসদের একটি আসনের এলাকা কী ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে তা স্পষ্ট করে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে নির্বাচন কমিশন তাদের খেয়াল খুশিমতো এলাকা নির্ধারণ করে, যার ফলে বিভিন্ন আসনের মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। কোথাও চার বর্গমাইল এলাকায় ২০ লাখ ভোটার আবার কোথাও ১০০ বর্গমাইল এলাকায় ৪ লাখেরও কম ভোট। যার ফলে সীমানা নির্ধারণের জটিলতা প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের সময় লেগেই থাকে এবং নির্বাচন কমিশন এলাকা নির্ধারণে এমন এক ধরনের অনমনীয় আচরণ করে যার ফলে তারা জাতীয় নির্বাচনে অযথা বিতর্কের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন কমিশনের আরেকটি বড় দায়িত্ব হলো জাতীয় নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা তৈরি করা কিন্তু কোন নীতিমালায় একজন ভোটার একটি সুনির্দিষ্ট এলাকায় তালিকাভুক্ত হবে তা সুনির্দিষ্টিকরণ হয়নি। এখানে অনেক বিষয় একসঙ্গে নিয়ে এসে ভোটার তালিকাকে জটিল করে ফেলা হয়েছে। তার একটি জাতীয় নিবন্ধন, একটি জাতীয় পরিচয়পত্র, একটি জাতীয় ভোটার তালিকা, একটি ভোটার আইডি, একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ভোটার তালিকা।

এখানে তিনটি মূল বিষয় হলো জাতীয় নিবন্ধন, জাতীয় নির্বাচনের ভোটার তালিকা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ভোটার তালিকা। কিন্তু এ তিনটি বিষয় পরস্পরবিরোধী। বাংলাদেশের একজন নাগরিক বাংলাদেশে বা দেশের বাইরে জন্মগ্রহণ করে নাগরিকত্ব লাভ করে নিবন্ধিত হতে পারে এবং নিবন্ধিত হওয়াতে তার জাতীয় পরিচয়পত্র তার থাকতে পারে। জাতীয় পরিচয়পত্রধারী ব্যক্তি বাংলাদেশের যে কোনো একটি স্থান থেকে জাতীয় নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকাভুক্ত হতে পারে। আবার একই ব্যক্তি কোনো নগর বা পৌরসভায় নিজস্ব বাড়িঘর থাকার সুবাদে সেখান থেকে স্থানীয় নির্বাচনে ভোটার তালিকাভুক্ত হতে পারে। কারণ ওই ব্যক্তি মহানগর, নগর বা পৌরসভায় তার স্থাবর সম্পত্তি থাকার কারণে তাকে পৌরকর দিতে হবে। যেহেতু একজন ব্যক্তি পৌরকর দেবে তাহলে সে কেন ওই এলাকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না তা জনমনে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন এক নয়। তাছাড়া দুটি নির্বাচনের লক্ষ্যও এক নয়। জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ সংসদের জন্য তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। বাংলাদেশের মালিক জনগণ এবং সংবিধান জনগণের অভিপ্রায় হিসেবে রচিত হয়েছে। সংসদ সদস্য কোনো চাকরি নয় এবং তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো দায়িত্ব নেই। সংসদ সদস্য জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সারা বাংলাদেশেই তারা রাষ্ট্রের যে কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু স্থানীয় সরকারের যে কোনো নির্দিষ্ট পদে যে কোনো সুনির্দিষ্ট এলাকায় কতগুলো সুনির্দিষ্ট কাজ করার জন্য এলাকার বাসিন্দারা নির্বাচিত করে দেয়। তারা জনপ্রতিনিধি নন, তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তি মাত্র এবং তারা তাদের সুনির্দিষ্ট কাজ ও এলাকা ছাড়া অন্য কোনো কাজ যেমন করতে পারে না তেমনি অন্য এলাকায় গিয়েও সেই কাজ করতে পারেন না। কাজেই জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন এক মানদণ্ডে বিচার করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। একইভাবে অনেকে মনে করেন একটি অভিন্ন ভোটার তালিকায় জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন সঠিক হতে পারে না। জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য আলাদা আলাদা ভোটার তালিকা জনগণের দাবি। অতীতে একজন নাগরিক একাধিক জায়গায় ভোটার হতে পারত কিন্তু ১/১১-এর সরকার সেই আইন রহিত করে অভিন্ন ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে যার ফলে জনগণের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হয় বলে অনেকে মনে করেন। একজন ভোটার যাতে জাতীয় নির্বাচনে একাধিক ভোটার হতে না পারে সে লক্ষ্যে জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটি ভোটার তালিকা এবং স্থানীয় নির্বাচনের জন্য আরেকটি আলাদা স্থানীয় সরকারভিত্তিক ভোটার তালিকা করা উচিত বলে অনেকে মনে করেন।

জনগণের প্রত্যশা নির্বাচন কমিশন একটি আদর্শিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হবে। নির্বাচন কমিশন তাদের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে। যেহেতু নির্বাচন কমিশন তাদের কাজের জন্য কারও কাছে দায়বদ্ধ নয় তাই জনগণ তাদের সব কাজে দৃশ্যমান সততা, ন্যায় ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে তা প্রত্যাশা করে। এ ব্যাপারে সংবিধান নির্বাচন কমিশনের কোনো সীমাবদ্ধতা তৈরি করে দেয়নি। নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞা, নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা প্রশ্নাতীত রেখেছে। তাই নির্বাচন কমিশনের অনেক সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ড বিতর্কিত হওয়ার পরেও নির্বাচন কমিশনকে জনগণ আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় না। নির্বাচন কমিশনের সীমাবদ্ধতা জনগণ মেনে নেয়।

জাতীয় নির্বাচনে দেশের মহা পরাক্রমশালী রাজনৈতিক দল এবং অসীম ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন অথচ তাদের প্রাপ্য সুবিধাদি প্রদান করার কোনো নিশ্চয়তা নির্বাচন কমিশন দিতে পারে না। যার ফলে ক্ষমতাধরদের দাপটে সংকুচিত হয়ে যায় সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের স্বার্থে সবার সমআচরণ নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের কাছে সব রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও নেতৃবৃন্দের কাম্য। কিন্তু সংবিধান এখানেও অপ্রত্যাশিতভাবে নীরব। অপ্রত্যাশিত এ জন্য যে সংবিধানে এ ব্যাপারে আইন করার সুনির্দিষ্ট নির্দেশ আছে নির্বাচন কমিশন নিয়োগে রাষ্ট্র আইন করবে কিন্তু রাষ্ট্র আইন না করতে পারলে বা ইচ্ছাকৃতভাবে না করলে তখন কী করতে হবে তার নির্দেশ বা নির্দেশাবলি সংবিধানে রাখা হয়নি। যদিও রাষ্ট্রপতিকে সাময়িক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রপতিও সেই দায়িত্ব জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী পালন করেন কি না স্পষ্ট নয়। তাই সংবিধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না রাখাটা সংবিধান রচয়িতাদের কাছে প্রত্যাশিত নয়। যখন যে রাজনৈতিক দল বা জোট ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের প্রত্যাশা থাকে নির্বাচন কমিশন তাদের আজ্ঞাবহ হবে। আবার যখন ওই দলই বা জোট বা ওই নেতৃবৃন্দ ক্ষমতার বাইরে থাকে তখন তাদের প্রত্যাশা তৈরি হয় নির্বাচন কমিশন সরকারের বিপক্ষে থাকবে এবং সরকারবিরোধীর প্রতি সব প্রকার আনুকূল্য দেখিয়ে সবার প্রতি সমআচরণ করবে যাকে আবার গালভরা বুলি দিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলা হয়!! তখন বিরোধী দলের আবদার থাকে যাতে নির্বাচন কমিশন তথাকথিত নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। সরকারে থাকলে তাদের প্রত্যাশা হয় নির্বাচন কমিশন যেন রাষ্ট্রের স্বার্থে এবং শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রয়োজনে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। সরকারের বাইরে সব মহলের আবদার থাকে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সমান রাখার জন্য!!! যেখানে এক দলের নির্বাচন বাজেট হাজার কোটি টাকা এবং আরেক দলের বাজেট এক কোটি টাকাও নয়, সেখানে নির্বাচন কমিশনের তথাকথিত লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কী অদ্ভুত প্রত্যাশা জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং দেশের তাবৎ সুশীল সমাজের!!! কাজেই সংবিধান এখানে অপ্রত্যাশিতভাবে নীরব। সব রাজনৈতিক দল, নেতৃবৃন্দ এবং সুশীল সমাজ জানে ক্ষমতাসীন দল সব সময় নির্বাচনে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে যদি না দেশে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সংবিধান রাষ্ট্রের ক্ষমতার পালাবদলের সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে কিন্তু পালাবদলের জন্য যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে সেই নির্বাচনের নিয়মনীতি সুস্পষ্ট করে রাখেনি এবং ওই নির্বাচন করার দায়িত্ব সংবিধান যে নির্বাচন কমিশনের হাতে দিয়েছে সেই নির্বাচন কমিশনকে তার দায়িত্ব পালনে পর্যাপ্ত ক্ষমতাশালীও সংবিধান এখনো পর্যন্ত করতে পারেনি। এমনকি সংশ্লিষ্ট সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ বা আলোচনা ছাড়াই এককভাবে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্য। অথচ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা না করে দুটি সিদ্ধান্ত ছাড়া অন্য কোনো সিদ্ধান্ত সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দেয়নি। যার ফলে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় রাখা বা ক্ষমতা চলমান রাখা নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব বলে মনে করে। যেমন বিদায়ী নির্বাচন কমিশন বিদায় নেওয়ার সময় বলে গেছে, তারা নাকি দেশের স্থিতিশীলতা ও সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সুষ্ঠু নির্বাচন করেছে। কিন্তু তারা ভুলে গেছেন কাউকে ক্ষমতায় বসাতে বা কাউকে ক্ষমতা থেকে সরাতে নির্বাচন হয় না। জাতীয় নির্বাচন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। এখানে নির্বাচনই মুখ্য এবং নির্বাচন হতেই হবে ক্ষমতার পালাবদলের জন্য। তাই নির্বাচন কমিশনের কাছে নির্বাচনের তিনটি শর্ত অবশ্যই বাধ্যতামূলক। তার একটি হলো সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা। দ্বিতীয়টি হলো নির্বাচনে একাধিক পরস্পরবিরোধী প্রার্থী। তৃতীয়টি হলো জনগণের ভোট প্রদান করতে পারার নিশ্চয়তা। নির্বাচনে পাস করে কে কী করবে সেটার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের না কিন্তু কাউকে নির্বাচিত ঘোষণা করতে হলে নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা, প্রার্থীর নাম এবং জয়ী হওয়ার ভোট সংখ্যার পার্থক্য অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। এখন যদি কোনো নির্বাচন কমিশন মনে করে ক্ষমতার পালাবদল নিশ্চিত করার জন্য চার লাখ ভোটারের নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন প্রার্থী কোনো ভোট না পেয়েও একক প্রার্থী হওয়ার সুবাদে নির্বাচন কমিশন তাকে জয়ী ঘোষণা করে তা প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয় তা বিশ্বব্যাপী সবাই বলবে। এ ধরনের নির্বাচন কমিশনের আদর্শিক কোনো ভিত্তি আছে তা পৃথিবীর কেউ মেনে নেবে না। কিন্তু নির্বাচন কমিশন একটি আদর্শিক প্রতিষ্ঠান যে নিরপেক্ষ থাকতে বাধ্য যা সংবিধানে লেখা নেই কিন্তু তা জনগণের ঐকান্তিক প্রত্যাশা।

আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করে হোন্ডা, গুণ্ডা এবং মণ্ডা (মণ্ডা মানে অর্থ)। হোন্ডা, গুণ্ডা আর মণ্ডার কাছে নির্বাচন কমিশন অসহায়। এ তিন অপশক্তিকে রোখার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। সব রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বড় দলগুলোর কাছে এ তিন পাণ্ডার ভীষণ কদর। বড় কয়েকটি দল কখনোই পাণ্ডাদের বিরুদ্ধে কিছু বলবে না, কারণ তাদের সরাসরি মদদ ছাড়া তারা অসহায়। সরকারি দল আবার সরকারি হোন্ডা, গুণ্ডা এবং সরকারি মণ্ডা ব্যবহার করে। অর্থাৎ সরকারি গাড়ি, পুলিশ ও প্রশাসন এবং সরকারি অর্থ। পাশাপাশি বড় বিরোধী দলগুলো     দলের বা পাড়ার হোন্ডা, গুণ্ডা এবং বড় ব্যবসায়ীদের মণ্ডা ব্যবহার করে। যে দল তাদের জন্য এই তিন পাণ্ডাদের পায় না তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের কোরাশ গায় এবং শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের             ধুয়া তুলে!!

দুর্বল নির্বাচন কমিশনের পক্ষে হোন্ডা, গুণ্ডা আর মণ্ডা নিয়ন্ত্রণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এরা পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের আদর ও হেফাজতে বেড়ে ওঠে। ওরা পরস্পরের অতি আপন এবং একজন আরেকজনের রক্ষাকবচ। তবে এ দুষ্টচক্রের জম হলো র‌্যাব ও সেনাবাহিনী। তাই যে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনে সেনাবাহিনীর উপস্থিত একান্ত প্রয়োজন। যদিও আমাদের আঁতেল সুশীল সমাজ সেনাবাহিনীর নাম শুনতে পারে না যার ফলে নির্বাচন কমিশন সুশীল সমাজের মন রক্ষা করতে গিয়ে সেনাবাহিনীকে নির্বাচনের কাজে লাগানোকে অগণতান্ত্রিক মনে করে।

ভোটারবিহীন নির্বাচন গণতান্ত্রিক হয় কিন্তু সেনাবাহিনী নিয়োগ করে হোন্ডা, গুণ্ডা আর মণ্ডা নিয়ন্ত্রণ করে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে এসে সুষ্ঠু ভোট ওনাদের কাছে ভালো লাগে না!! এখানে এক ধরনের হীনম্মন্যতা কাজ করে বলে অনেকের ধারণা। তবে যে যাই বলুক সেনা নিয়োগ ছাড়া কোনো নির্বাচন বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না এবং পারবেও না। হোন্ডা, গুণ্ডা আর মণ্ডা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শক্ত ডাণ্ডার দরকার যা একমাত্র সেনাবাহিনীরই আছে। দুর্বল নির্বাচন কমিশন যদি সময় থাকতে সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে না পারে বা না করে তাহলেই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আশা করা চরম দুরাশা এবং তা আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবেই থেকে যাবে।

     লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

সর্বশেষ খবর