সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাঙালির পুষ্পপ্রীতি ও পুষ্পবাণিজ্য

আমিনুল ইসলাম মিলন

বাঙালি কবি দিজেন্দ্র লাল রায় (ডিএল রায়) একদা তার এক কবিতায় বলেছিলেন, ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’— কথাটি তার সময়ে কতটুকু প্রযোজ্য ছিল জানি না, তবে আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষ প্রান্তে এসে কথাটি যে শুধু কবিতার চরণ নয়, বরং অনেকটাই বাস্তব তা ছোট এ ভূখণ্ডটা ঘুরে এলেই বোঝা যাবে। ধন ধান্যে পুষ্পে আমাদের এ ছোট্ট বসুন্ধরা আজ সত্যিই অপরূপা। ধন-সম্পদে বাংলাদেশ সবসময়ই ধনী ছিল, বারবার বিদেশিরা এসে এর সম্পদ লুট করেছে। ব্যতিক্রমী কিছু সময় বাদে, এ ভূখণ্ডের মানুষ সবসময়ই ডাল-ভাত খেয়ে এবং মোটা কাপড় পরে মোটামুটি সুখে-শান্তিতেই দিন কাটিয়েছে। আজ আবার বাংলার সুদিন ফিরেছে, কথায় নয় বাস্তবে।

নব্বইয়ের দশকে একজন সামরিক শাসক বাংলার রাজা হলেন। তিনি কবিতা লেখেন— প্রতি শুক্রবারে একেক মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন, কী সুন্দর করে বয়ান করেন। তিনি ছিলেন আবার পুষ্পপ্রেমিকও। জাগতিক প্রেমের কথা না-ই বা বললাম। তার হাত ধরেই রজনীগন্ধার স্টিক জনপ্রিয় হতে থাকে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে ‘পুষ্পিত শুভেচ্ছা’ দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়। চকবাজারের জরির ফুল, জরির মালা, কাগজের ফুল, কাগজের মালার ব্যবসা লাটে উঠতে থাকে। আস্তে আস্তে রাজধানী ডিঙিয়ে এটি জেলা-উপজেলা হয়ে আজ প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত বিস্মৃত। গত বছরের ঠিক এমন দিনে নোয়াখালী থেকে ঢাকা আসার পথে কুমিল্লার নাথের পেটুয়া বাজারে চা খেতে নামলাম। একটি ছোট রেস্টুরেন্টে ঢুকেই দেখি সাদা কাগজে কম্পিউটার কম্পোজে মুদ্রিত বিজ্ঞাপন, ‘১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেনটাইনস ডে ও ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ফুলের অগ্রিম অর্ডার নেওয়া হয়’ যোগাযোগের জন্য নাম ও মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে। উক্ত নম্বরে ফোন করে জানলাম তার ফুল পার্শ্ববর্তী এলাকার কয়েকটি গ্রামে বিক্রি হয়। ক্রেতা বেশিরভাগই ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণী। লাকসাম, কুমিল্লা এমনকি বড় অর্ডার পেলে ঢাকা থেকেও ফুল নিতে হয়। লাভ মোটামুটি, এ দিয়েই সংসার চলছে। এক সময়ে বাড়ির বারান্দায়, ছাদে, কার্নিশে, টবে লাগানো ফুলের গাছ বেশ চোখে পড়ত। ডেঙ্গু রোগ আবিষ্কার না হলে গৃহকেন্দ্রিক ফুল চাষ আরও জনপ্রিয় হতো। তবে ইদানীং কেউ কেউ বাড়ির ছাদে সবজি বাগান, ফুল বাগান করছে। কিন্তু চাহিদা বলে একটি কথা আছে। চাহিদা বাজার সৃষ্টি করে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে আজ উন্মুক্ত প্রান্তরে ধান-পাট-রবিশস্যের মতো ফুল চাষও হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যশোর জেলা অগ্রগামী। ছোটবেলায় শুনতাম গোলাপ গাছ সবার হাতে হয় না—সবাইকে সয় না। পরিচর্যা করতেও বেশ ঝামেলা, কাঁটা আছে। কবির ভাষায়—‘হয়তো হৃদয়ে তোমার ভালোবাসা ছিল, প্রেম ছিল, ফুল ছিল, পুষ্পিত হৃদয়ে গোলাপ, ছিল না শুধু গোলাপের কাঁটা। তাই তো যেদিন অন্য কেউ হাত বাড়াল-কাঁটার আঘাতে তুমি পারলে না ফেরাতে—কাঁটাহীন গোলাপ যে বড় দুর্বল।’ কিন্তু না, প্রেমিকার গোলাপ কাঁটাহীন হলেও বাস্তবের গোলাপ কাঁটাযুক্ত। সে গোলাপই আজ বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে এবং দেশীয় বাজার পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

মূলত দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ শুরু হয় ১৯৮৩ সাল থেকে। যশোর জেলার গদাখালী এলাকায় সর্বপ্রথম ফুলের চাষ শুরু হয়। যা ক্রমান্বয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৫ সাল থেকে ফুলের চাষ ব্যাপকতা লাভ করে। ধীরে ধীরে ফুলের চাহিদাও বাড়তে থাকে। বিয়ে-শাদি, জন্মদিন, সভা-সমিতিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মঞ্চ সাজসজ্জায় ব্যাপকভাবে বিভিন্ন ধরনের ফুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফলে উৎসবপ্রিয় বাঙালির কাছে বসন্ত উৎসব, পৌষ উৎসব, পয়লা বৈশাখ, ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি, জাতীয় শোকদিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, ঈদ-পূজা-অর্চনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফুলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে বাংলাদেশের এমন কোনো জেলা, উপজেলা বা বড় বাজার নেই যেখানে ফুল বিক্রির একাধিক দোকান নেই। রাজধানীর শাহবাগ ফুল বিক্রয়ের প্রধান কেন্দ্র। এটা পাইকারি বাজারও বটে। এ ছাড়া রাজধানীর অভিজাত বিপণি বিতান, আধুনিক শপিং মলসহ প্রতিটি বাজারে ফুলের দোকান রয়েছে।

ফুল ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রায় ২০ লাখ মানুষ ফুল ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত। এর মধ্যে রয়েছে ফুল চাষ, ফুলের যত্ন-পরিচর্যা, পরিবহন, বিপণন, মালা গাঁথাসহ বিভিন্ন কাজ। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ফুলের উৎপাদন বাড়ছে— সম্প্রসারিত হচ্ছে বাণিজ্যিক ফুল চাষ এলাকা। যশোরের গদাখালীতে ৩৩ বছর আগে যে ফুল চাষ শুরু হয়েছিল তা আজ যশোর ডিঙিয়ে ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের ২৪টি জেলার প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে খুলনা বিভাগেই সবচেয়ে বেশি ফুল চাষ হচ্ছে- প্রায় ৩০০০ হেক্টর জমিতে। শুধু গোলাপ, রজনীগন্ধা বা গাঁদা নয়, গ্লাডিওলাস, করনেশান, কসমস, অর্কিডসহ বিভিন্ন বিদেশি ফুলও ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। দিন দিন এসব ফুলের চাহিদা বাড়ছে, বাড়ছে সাধারণ মানুষের পুষ্পপ্রীতি। তাই ফুল আজ রাঙালি নাগরিক জীবনের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছে। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ফুল উৎপাদিত হয় প্রায় ৫০ হাাজর টন যার আর্থিক মূল্য ছিল ৭০০ কোটি টাকা। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ফুলের মোট উৎপাদন হয় প্রায় ৬০ হাজার টনের কাছাকাছি—যাতে পুষ্পবাণিজ্য ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ থেকে সীমিত পরিসরে ফুল রপ্তানিও হচ্ছে। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে সুইডেনে প্রায় ২৫০০ মার্কিন ডলারে গোলাপ রপ্তানি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে নানা কারণে রপ্তানি কমে যায়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, ফুল রপ্তানি খুবই স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা। সংশ্লিষ্ট সব মহল যৌথভাবে নির্বিঘ্নে ও দ্রুত রপ্তানি কার্যক্রম সম্পাদনে এগিয়ে এলে বিদেশে বাংলাদেশের ফুল রপ্তানির ভালো বাজার সৃষ্টি হবে। আমাদের প্রত্যাশাও তাই। আমরা চাই বাংলাদেশ ফুলে ফলে ভরে উঠুক। বাংলাদেশ ধানের দেশে, গানের দেশের পাশাপাশি ফুলেল বাংলা হয়ে উঠুক।

লেখক : সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা

সর্বশেষ খবর