মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

আমাদের হাসান-হোসেন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

আমাদের হাসান-হোসেন

ইসলামের সূচনায় বিশ্বনবী (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হাসান-হোসেন জহরে কহরে নিহত হয়েছিলেন। বিরাট প্রভাব পড়েছিল মুসলিম উম্মাহর ওপর। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে আক্রান্ত হয়ে আমাদের হাসান-হোসেন ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন। হাসান-হোসেনের চেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সভ্যতা-ভব্যতা ও মর্যাদা। পৃথিবীর সর্বত্রই কমবেশি দুর্নীতি আছে এবং থাকবে। কিন্তু দুর্নীতি হওয়ার আগেই দুর্নীতির স্বপ্ন দেখা— এ নিয়ে এত বড় ঝড়-তুফান আগে কখনো দেখিনি। হ্যাঁ, আল্লাহতায়ালা সব দেখেন, সব জানেন। মনে মনে ভাবার অপরাধেও তিনি শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু এই জগৎ সংসারে কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই সে অপরাধ নিয়ে কে কী চিন্তা করছে বা কারা কী কৌশল করছে তা নিয়ে কাউকে আদালতে নেওয়া যায় এবং সে কারণে কোনো দেশ বা জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এসব ছিল কল্পনার অতীত। তবু বাস্তবে তেমনটাই হয়েছে।

হোসেন নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না, হাসান নিয়ে ছিল। আমার পরম সুহৃদ আপনজন হাসানের বাবা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। বহির্বিশ্বে তার অবদান সূর্যের মতো উজ্জ্বল। মুসলিম লীগ পরিবার হওয়ার কারণে হাসানের দাদা আবদুল হামিদ চৌধুরীর যেমন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও অবদান ছিল, তেমনি তার বাবা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় দাদার চেয়ে শতগুণ বেশি ভূমিকা রেখেছেন। তাই অমন একটি পরিবারকে যখন নিগৃহীত করা হয় তখন বুকে না বিঁধে পারে না। সে কারণে সাহসের সঙ্গে সত্য বলার চেষ্টা করেছি। সেটা হাসান-হোসেনের ব্যাপার ছিল না, ছিল ন্যায় ও সত্যের। শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ অসত্য প্রমাণিত হওয়ায় নিশ্চয়ই আমরা আনন্দিত। আমার কথা ছিল হাসানকে নিয়ে। সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী কায়সারকে নিয়ে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সে কাউকে কাউকে নিয়ে তদবির করেছেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে সাহায্য করা আমাদের দেশে কোনো অপরাধ নয়। বরং আমাদের দেশে সেটা সেবা। সেই মানবিক গৌরবের কাজটিই আমাদের প্রিয় ভাতিজা করেছে। এজন্য আমরা গর্ব করি। সে যে কোনো অন্যায় করেনি বরং যা করেছে ন্যায় করেছে, শেষ পর্যন্ত তাই প্রমাণিত হলো, এজন্য আল্লাহকে লাখ লাখ শুকরিয়া।

প্রেমের কারণে এ জগৎ। আশিক-মাশুকের দুনিয়া। আমরা আল্লাহর আশিক। কিন্তু আল্লাহ রসুলের আশিক। এই জগৎ সংসারে যৌবনে সব নর-নারী প্রেম করে। কারণ আল্লাহর সৃষ্টিলীলাই প্রেম। রূপ-রস-প্রেমহীন জগৎ কল্পনাতীত। অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের বাংলায় যৌবনে কেউ প্রেম করেনি, কবিতা লেখেনি, গান গায়নি সে এক বিরল ঘটনা। বাংলার আকাশ-বাতাস, রাস্তাঘাট, মাঠ-ময়দান ছেলেমেয়েদের কবিতা লেখার স্থান। যারা লেখাপড়া জানে না, তারাও মনে মনে সুর তোলে। আমি এক সৌভাগ্যবান বা দুর্ভাগা, যৌবনে কোনো মেয়ের হরিণ চোখ দেখিনি, ভালোবাসিনি। কোনো গানের সুর তুলিনি, এক লাইন কবিতা লিখিনি বা লিখতে পারিনি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমার মধ্যে ভালোবাসা বা প্রেম ছিল না। আমি এক বিশ্বপ্রেমিক। জগৎ সংসার, দেশ, দেশের নেতা, বন্ধু-বান্ধব, মা-বাবা, ভাইবোন সর্বোপরি স্ত্রী-পুত্র-কন্যার ভালোবাসার মধুর সাগরে ডুবে আছি— এমন আবহাওয়া বা পরিবেশ খুব বেশি মানুষের ভাগ্যে জোটে না। আমি মুক্তিযুদ্ধের রক্তারক্তি দেখেছি। লক্ষাধিক জনবল নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহে কত রক্তে ভেসেছি। হানাদারদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া, ছিন্নভিন্ন ক্ষতবিক্ষত শত শত রক্তাক্ত দেহ যেখানে সেখানে পড়ে থাকতে দেখেছি। কিন্তু সেই যুদ্ধেও দেখে-শুনে একটি পিঁপড়ার গায়ে পা দিতে চেষ্টা করিনি। কোনো অভিযুক্তকে পশুর মতো নির্মম নির্যাতন করিনি। অভিযুক্তের আত্মীয়স্বজন, বাবা-মাকে অযথা অপমান-অপদস্থ করিনি। তার পরও জানি, যেহেতু যুদ্ধবিগ্রহ করেছি তাই অনেকের ধারণা, ধরো-মারো-কাটো এমনটাই হবে। কিন্তু আমি জানি বড় কাজে উত্তেজনা, ধরো-মারো-কাটো ওসবের কোনো মূল্য নেই। বড় কাজে ধীরস্থিরশান্ত থাকতে হয়। সব সময় পেরেছি তা হয়তো নয়। কিন্তু নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। তাই আজ হাজারো বঞ্চনার মাঝেও আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে তাঁকে ভয় করে হাজারো ধনবানের চেয়ে অনেক আনন্দে আহ্লাদে শান্তি-স্বস্তিতে আছি। সংসারে তেমন খিটিমিটি নেই। ছেলেমেয়ে নিয়ে দুর্ভাবনা নেই। শরীরের ৭০-৮০ জায়গায় আঘাতের চিহ্ন নিয়ে ক্ষতবিক্ষত আমার কলিজার টুকরা, বুকের ধন কুশিমণি তুলোয় পেঁচিয়ে বাড়ি এসেছিল। কিন্তু তাকে নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না। বাড়িতে যখন তখন তেমন শোকবালাই, বালা-মুসিবত নেই। এজন্য আল্লাহর প্রতি লাখো কোটি শুকরিয়া। তিনি যখন যাকে যা দেন তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। মোটামুটি তাই থাকি এবং আছি।

৯ ফেব্রুয়ারি সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মেয়ে আনিকা নুসরাতের সঙ্গে চৌধুরী নাদওয়াৎ মুনীর নাদীরের বিয়ে ছিল। ১০ তারিখ সকালে টাঙ্গাইলে এক ঘরোয়া সভা ছিল। সুলতানের মেয়ের বিয়ে, না করতে পারছিলাম না। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে সর্বস্বান্ত আমি যখন মেঘালয়ে তখন হালকা-পাতলা লিকলিকে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আমার কাছে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল বিয়ানীবাজারের ক্যাপ্টেন জলিল ও বেশ কয়েকজন। ক’দিন পর ইল্লি দিল্লি লন্ডন ঘুরে শাহ আজিজ এসে যোগ দেয়, তারও আগে না পরে নাসিম, মঞ্জু, শেখ মারুফ, খালেদ খুররম আরও অনেকে এসে প্রতিরোধ শিবির ভরে তোলে। সুলতান ছিল বাবরুল হোসেন বাবুলের কর্মী। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সরকারের পতনের পর শ্রী মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হয়ে আমাদের কয়েক হাজার প্রতিরোধ যোদ্ধাকে জিয়াউর রহমানের হাতে তুলে দিলে মৌলভী সৈয়দসহ প্রায় ১০০ জনকে এক দিনে গুলি করে মেরে ফেলে। তার পরও রাজা দীপঙ্কর, নাসিম, মাহাবুব, সুলতান, গিয়াস, বৌদ্ধ, গৌর পাশে ছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজের কাছে পরাজিত নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা পাটনা যেতে চেয়েছিলেন। পারেননি। সেজন্য হয়তো নবাবি উদ্ধার হয়নি। কিন্তু ’৭৭ সালে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে সরিয়ে শ্রী মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হলে নেতাজি সুভাষ বোসের ব্যক্তিগত সহকারী ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা শ্রী সমর গুহ এমপির সহযোগিতায় জনতা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের বিহারের কদমকুয়ার বাড়িতে গিয়েছিলাম। পরে কতবার গেছি হিসাব নেই। সুলতান গেছে, নাসিম গেছে, একসময় বাসসের প্রধান জাওয়াদুল করিম গেছেন। শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণকে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশের অগণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা বোঝাতে পেরেছিলাম। তাই পরবর্তীতে শ্রী মোরারজি দেশাই আমাদের ওপর তেমন কঠোর হতে পারেননি। ’৮১ সাল পর্যন্ত যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিরাপদে ভারতে ছিলেন সেও ছিল শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে আমাদের আলোচনার ফসল।

 

 

সত্তর দশকে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণকে দ্বিতীয় মহাত্মা বলা হতো। ধ্যানে-জ্ঞানে-মায়া-মমতায় মানুষ কত বড় হতে পারে জয় প্রকাশ নারায়ণ তার উজ্জ্বল প্রমাণ। তাকে সর্বোদয় নেতা বলা হতো। উত্তর প্রদেশের কত দুর্দান্ত ডাকাত তার কাছে এসে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়েছে। ২০-২৫ বছর যেখানে সরকার কোনো শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, সেখানে নিরস্ত্র নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ অবলীলায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সে এক অভিনব ব্যাপার। ডাকাত মালকান সিং, ফুলন দেবীর মতো যারা ছিলেন, তাদের প্রায় সবাইকে সুপথে আনার নজির সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের অবদান অবিস্মরণীয়। সরকার কতজনকে কত সম্মাননা দেওয়ার চেষ্টা করছে, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পর বেসরকারি কারও কোনো অবদান থাকলে তা সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের। তিনি ভারতের প্রতিনিধি এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সারা পৃথিবী চষে বেরিয়েছিলেন। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে তার ভাবমূর্তি ছিল দেব-দেবতার মতো। আজ তাকে নিয়ে কোনো কথা নেই, আলোচনা নেই। জয়প্রকাশ নারায়ণ আমাদের বুঝেছিলেন যেহেতু তিনি স্বাধীনচেতা ছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯৩১-৩২ সালে ঢাকার ঠাটারী বাজারে তিনি আত্মগোপন করে ছিলেন। এক বাঙালিকে তিনি স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছিলেন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর স্ত্রী কমলা নেহেরু আর জয়প্রকাশ নারায়ণের স্ত্রীর মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। এসব কারণে আমাদের প্রতি বিশেষ করে বাংলাদেশ ও বাঙালির প্রতি তার আলাদা দরদ ছিল। তাই তিনি দুর্দিনে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে বেশ কয়েক বছর যাতায়াত করে জেনেছিলাম নেপালের নির্বাসিত নেতা ভি বি কৈরালাকে তিনি যেমন আদরযত্ন করতেন, আমাকেও নাকি ঠিক তেমনি করতেন। শেষের দিকে পাটনা গেলে একবারও না খেয়ে আসতে দিতেন না, সঙ্গে বসে খাওয়াতেন। ভি বি কৈরালার ছোট ভাই জি পি কৈরালা পরে বেশ কয়েকবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তার সঙ্গে কতবার জি পির বাড়িতে দেখা হয়েছে হিসাব নেই। সেই জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইর হাত থেকে আমাকে রক্ষা করতে জনতা পার্টির সভাপতি শ্রী চন্দ্রশেখরকে পাটনায় ডেকে সবরকম সাহায্য করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সাধারণ সম্পাদক মধু লিমায়ে, রাজনারায়ণ, বিজু পট্টনায়েক, সুরেন্দ্র মোহন, হেমবতী নন্দন বহুগুণা, জর্জ ফার্নান্দেজ কতজনকে আমাদের সাহায্য করতে লিখেছেন, বলেছেন কোনো ইয়ত্তা নেই। সেই দিনগুলোতে সুলতান আমার ছায়ার মতো ছিল। সুলতানের হাতের লেখায় কতজনকে কত চিঠি পাঠিয়েছি, বলে শেষ করতে পারব না। দেশে ফিরে ডাকসুর ভিপি হয়েছিল। নম্র-ভদ্র সাবলীল, যন্ত্রণা যতই থাকুক তার পরও মাথা তুলে কথা বলে না। ’৯৯-এ সখীপুরে ভোট চুরির সময় হাফ মন্ত্রী খালেকের সঙ্গে বহেড়াতৈল গিয়েছিল। ওদের ভ্যানে তুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। মাঝেমধ্যে সমালোচনা করে, এটাওটা বলে লেখে। তার পরও আমার সুলতান সুলতানই— সন্তানের মতো। সেজন্য ওর মেয়ের বিয়েতে না গিয়ে পারিনি। অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানে একা যাই। স্ত্রীকে খুব একটা পাই না। কুশিমণির জন্য ঘর ছাড়ে না। কিন্তু সুলতানের মেয়ের বিয়েতে প্রায় সবাইকে পেয়েছিলাম। কুশিমণি, কুশিমণির মা, ছোট বোন শুশু, শাহানা, শাহানার বর আরিফ আহমেদ দুলাল, শাহানার মেয়ে ইয়ামণি, তার ছেলে জিহাদ। মানে পরিবারের বাইরেও আরেক পরিবার। অনুষ্ঠানে অনেকেই ছিলেন। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা, দিনাজপুরের রহিম ভাইয়ের ছেলে বিচারপতি এনায়েতুর রহিম, আমান উল্লাহ আমান, ডা. জাফরুল্লাহসহ আরও অনেক নামকরা জ্ঞানী-গুণী। খাবার টেবিলে আমার পাশে বসেছিলেন খালেদ মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী। তাকে বলেছিলাম, আপনার স্বামী ’৬৮ সালে ১৫ পুরানা পল্টন ছাত্রলীগের অফিস থেকে রিকশায় করে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। লতিফ সিদ্দিকীর ভাই হিসেবে আমার হাতে একটা টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বললেন, ‘ওই টেবিলে মোহাম্মদ আলী।’ পরে গিয়ে তাকেও কথাটি বলেছিলাম। মোহাম্মদ আলীর পাশে ছিলেন এসপি মাহবুব বীরবিক্রম। তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে বরিশালের সুলতান শরীফ ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তারা দুজন হরিহর আত্মা। সুলতান শরীফ একজন নিবেদিত মানুষ। তার স্ত্রী নোরা ভাবী ছিলেন অসাধারণ মানুষ। তার দুই মেয়ে রাজিয়া, ফৌজিয়া। আমার নির্বাসনের সময় ওরা খুবই ছোট ছিল। এখন নাকি বেশ বড় এবং বেশ ভালো আছে। সবাই মিলে মঞ্চে মেয়েকে দোয়া করতে গিয়েছিলাম। সাজগোজ করা পরীর মতো মেয়েটি যখন পায়ে হাত দিয়ে সালাম করছিল তখন আমার মেয়েই মনে হচ্ছিল তাকে। বলছিলাম, মাগো তুমি আমায় চিন? মেয়েটি বলছিল, ‘চাচা, ২৭ বছর আপনার কথাই শুনেছি।’ বেরোবার পথে ড. কামাল হোসেন, তার স্ত্রী, আ স ম আবদুর রব, তার স্ত্রী, সুফিয়া খালার মেয়ে সুলতানা কামাল, আরও অনেকের সঙ্গে দেখা এবং কথা হয়। আমার টাঙ্গাইলে ফেরার তাড়া ছিল। দেখি গেটে বর দাঁড়িয়ে। মনে হয় টাকা-পয়সার জন্য গেট ধরা হয়েছিল। ছেলে অপূর্বসুন্দর। চোখ-মুখ দেখে হৃদয় জুড়িয়ে যায়। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলাম, বাবা গো, বিয়ের পর মানুষের দ্বিতীয় জন্ম। প্রথম প্রথম আমাদের মেয়ের ছোটখাটো ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করো। শিশুকালে মা যেমন সন্তান-সন্ততি আগলে রাখে বিয়ের পর একটা পর্যায়ে ভালো স্ত্রী মায়ের মতো স্বামীকে আগলে রাখে। আমার স্ত্রীর সঙ্গেও দুয়েকবার খোঁটাখুঁটি হয়েছে, মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু আমি যেমন আমার মায়ের ছায়ায়মায়ায় ছিলাম, তেমনি এখন স্ত্রীর ছায়ায়মায়ায় ডুবে আছি। ছেলেবেলায় কোথাও গেলে মা যেমন উতলা থাকেন, এখন স্ত্রীও তেমনি থাকে। দূরে কোথাও গেলে বা থাকলে, ‘কী করছ? কী খেয়েছ? ওষুধ বাদ পড়েনি তো? কে কাছে আছে?’ ওসব শুনে মায়ের কথা মনে পড়ে।

আগেই বলেছি, পরদিন সকালে ছোটদের একটা জরুরি বৈঠক ছিল। তাই রাতেই টাঙ্গাইলের পথ ধরেছিলাম। সাড়ে ৭টায় বেরিয়ে সুলতানের মেয়ের বিয়েতে যোগ দিয়ে রাত ১০টা ৫ মিনিটে মোহাম্মদপুর থেকে টাঙ্গাইলের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। কপালে যে অত কষ্ট ছিল জানা ছিল না। রাস্তা ফাঁকাই ছিল। ১১টা ৫-৬ মিনিটে চন্দ্রা পৌঁছেছিলাম। তারপর দুর্দশার শেষ ছিল না। মনে হলো কেমন যেন একেবারে অসহায় নির্জন দ্বীপে পড়ে গেছি। দুই দিকেই গাড়ি একচুল নড়ছে না।

বয়স হয়েছে। আগের মতো সেই ২০-২৫ বছরের সক্ষমতা নেই। অনেক কিছুই খারাপ লাগে। বরং ভালো লাগে কম। অসহায়ের মতো রাস্তায় পড়ে থেকে বেশ কয়েকবার মনে হচ্ছিল যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে ফোন করি। আবার ভাবলাম এত রাতে কী না কী মনে করবেন। মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে একবার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আমাকে বলেছিলেন পাকিস্তানি জাহাজ থেকে কিছু বাঙালি লন্ডনের এক বন্দরে নেমে আশ্রয় প্রার্থনা করছিল। ব্যাপারটা তাকে জানালে তিনি পিটার শোর এমপিকে ফোন করেন, বন্দরে বাঙালি নাবিকদের কী করা যায়? তখন রাত ১২টা-সাড়ে ১২টা। ৩টায় পাকিস্তানি জাহাজ বন্দর ছাড়বে। সরকারি কোনো হুকুম না পেলে যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানিয়েছে তাদের পুলিশ পাকিস্তানি জাহাজে তুলে দেবে এবং সেটা হলে তাদের নিশ্চিত জীবনহানি। তাই আবু সাঈদ চৌধুরী ফোন করে এমপিকে জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলে কিছু করা যায় কিনা। পিটার শোর বলেছিলেন, ‘অত রাতে মন্ত্রীকে ফোন করা যায় না। যে কোনোভাবে সকাল পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখুন।’ স্বাধীনতা আন্দোলনকারীরা যেমন হতাশ হয়েছিলেন, তেমনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী খুবই উদ্বিগ্ন-মর্মাহত হয়েছিলেন। তরতাজা কয়টি প্রাণ বাংলাদেশের জন্য ভূমিকা রাখতে গিয়ে পাকিস্তানের হাতে জীবন দেবে দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায় তারা আধখানা হয়ে গিয়েছিলেন। কত আর হবে, ঘণ্টাখানেক পর ফোন বেজে ওঠে। তুলতেই পিটার শোর গলা, ‘মি. চৌধুরী, মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। আপনার লোকদের আর পাকিস্তানি জাহাজে ঠেলে দেওয়া হবে না।’ কৌতূহলী আবু সাঈদ চৌধুরী পিটার শোরকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি না এইমাত্র বললেন, অত রাতে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলা ব্রিটিশ সভ্যতা নয়। তাহলে কী করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বললেন? পিটার শোর অট্টহাসি হেসে বিচারপতিকে বলেছিলেন, ‘আমি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলেছিলাম তখন মনে হয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু একজন মন্ত্রী। কিন্তু যখন দেখলাম জীবন-মরণ সমস্যা আর তিনি তো শুধু মন্ত্রী নন, একজন এমপিও। ব্রিটিশ সভ্যতায় একজন এমপি আরেকজন এমপির সঙ্গে যখন তখন, এমনকি বেডরুমে গিয়েও কথা বলতে পারে। তাই সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেললাম।’ চন্দ্রা থেকে টাঙ্গাইলের পথে গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে যখন হাত-পা জ্বালাপোড়া, মাথা ঝিমঝিম করছিল তখন আমারও কথাগুলো মনে পড়ছিল। কিন্তু তবু ওবায়দুল কাদেরকে ফোন করিনি। নিশ্চয়ই ওবায়দুল কাদের একজন কর্মঠ মানুষ। আমি তাকে ভালোবাসি, স্নেহ করি। নেত্রীর ওপর যখন গ্রেনেড হামলা হয়েছিল তখন আহত হয়ে দিল্লির এ্যাপোলো হসপিটালেস পড়ে থাকার সময় তার চেপে ধরা হাত এখনো আমাকে নাড়া দেয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে যখন তখন যতবার ফোন করেছি, পেয়েছি। ব্যস্ততার জন্য এখন তেমন পাই না। তাই আর তাকে ফোন করিনি, তিনি এবং আমি দুজনই রাজনীতি করি।

কয়েকটা পত্রিকায় দেখলাম সেতুমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। কাকের মতো নাকমুখ পুঁছে অস্বীকার করা খুব একটা সহজ নয়। রাস্তাঘাট সত্যিই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যেসব রাস্তায় নির্মাণ চলছে। মনে হয় ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা রাস্তায় দুর্ভোগ সবচেয়ে বেশি। বর্তমান নির্মাণকাজে কত শর্ত। কিন্তু যে এলাকায় নির্মাণ হচ্ছে সে এলাকার মানুষের দিনের পর দিন ধুলাবালু-শব্দ-যানজট নানা কারণে পেরেশানির কোনো প্রতিকার নেই, তার কোনো ক্ষতিপূরণ নেই। রাত ৪টায় আমি তো টাঙ্গাইল পৌঁছেছিলাম। কিন্তু ওই সময় ঢাকার দিকে কোনো গাড়ি এক ইঞ্চিও নড়েনি। কত বাচ্চা, কত রোগী, কত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা চিৎকার করছিল, দেখার কেউ ছিল না। মনে হয় নবীনগর থেকে যমুনা পর্যন্ত ৭০-৮০ কিলোমিটার গাড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যা চলেছে পরদিন দুপুর পর্যন্ত। আবার সন্ধ্যা থেকেই যানজট।

মাননীয় সেতুমন্ত্রী! এই অল্প কয়েক দিনে কয়েক শ মানুষ মারা গেছে শুধু সড়ক দুর্ঘটনায়। জানি আপনি মৃত্যু নিয়ে কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু তবুও কি আপনার খারাপ লাগে না? আমার বিশ্বাস চেষ্টা করলে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে পারবেন। শ্রমিকনেতা শাজাহান খানকে সরিয়ে দিন, মন্ত্রী থেকে বরখাস্ত করুন। দেখবেন শতকরা ২৫ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হয়ে গেছে। চালকদের প্রশিক্ষণের মধ্যে আনুন তাতে আরও ২৫ ভাগ কমবে। ছোট গাড়ি, বড় গাড়ি একসঙ্গে একই সড়কে নয়, আলাদা করুন। রাস্তার অর্ধেকটা হকার, গাড়িঘোড়া, ইট-পাটকেল ফেলে বন্ধ না করে যাতায়াতের জন্য খোলা রাখার চেষ্টা করুন। সর্বোপরি যেখানে যেখানে প্রয়োজন জানাশোনা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্রাফিক দিন। দেখবেন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু অনেক কমে গেছে। নিজে বা নিজেরা যদি না পারেন যাদের এ নিয়ে আগ্রহ আছে তাদের দায়িত্ব দিন। অকারণ জীবনহানির কারণ হবেন না।      লেখক : রাজনীতিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর