বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

স্বাধীনতা পুরস্কার ও কিছু প্রশ্ন

সামসুদ্দিন আহমদ

স্বাধীনতা পুরস্কার ও কিছু প্রশ্ন

স্বাধীনতা পুরস্কার বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতি বছর এই পদক প্রদান করা হয়ে আসছে। এই পুরস্কার জাতীয় জীবনে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের নাগরিক এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে প্রদান করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও ব্যক্তির পাশাপাশি জাতীয় জীবনের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে অনন্য উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য প্রতিষ্ঠানকেও এই পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে।

স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন জাগতে পারে। স্বাধীনতা পুরস্কার প্রবর্তন হয়েছিল যখন তখন সামরিক শাসকের আমল। আসলে ১৯৯১-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত সামরিক শাসকরাই বিভিন্ন সাজে শাসন করেছে। ১৯৭৫-এর আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো শক্তি ক্ষমতায় যেতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তারা জামায়াত আর পাকিস্তানপন্থিদের সঙ্গে গলাগলি করে দেশ চালিয়েছে। কাজেই সে আমলে প্রদত্ত স্বাধীনতা পুরস্কারে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাধান্য থাকবে না সে সহজেই অনুমেয়। সে সময়ের পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকা দেখলেই তা বোঝা যায়। ১৯৭৭-এর তালিকায় দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য কোনো পুরস্কার দেওয়া হয়নি। এমন অনেককেই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে যারা কীভাবে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হতে পারে তা কল্পনায় আসে না। প্রথম বারেই মাহবুবুল আলম চাষীকে পুরস্কার দেওয়া হলো। এটা কী জন্য? বঙ্গবন্ধু হত্যায় তার সমর্থন আর মোশতাকের দোসর হওয়ার উপহার স্বরূপ? রুনা লায়লা সংগীতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি সম্পদ সন্দেহ নেই। ইকবাল মন্দাবানু নেভি অফিসারের স্ত্রী (খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের শাশুড়ি)। কিন্তু পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানে ছিলেন। যে ক্ষেত্রেই পুরস্কার দেওয়া হোক পুরস্কারটা যেহেতু স্বাধীনতা পুরস্কার, স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে তো পুরস্কার প্রাপকের কিছুটা সংশ্লিষ্টতা থাকতে হবে। ১৯৭৯-তে সমর দাসকে সংগীতে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তাকে তো স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধা ক্ষেত্রে পুরস্কার দেওয়া যেত। শর্সিনার পীরকে পুরস্কার দেওয়া নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সেটা তো একটা বিস্ময়কর লজ্জার ব্যাপার।

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় নির্মিত জহির রায়হান ক্যামেরা নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। তার ‘ংঃড়ঢ় মবহড়পরফব’ ‘অ ংঃধঃব রং ইড়ত্হ,’ ‘খরনবত্ধঃরড়হ ঋরমযঃবত্ং’ এবং ‘ওহহড়পবহঃ গরষষরড়হং’ ছবিগুলোর জন্য তিনি চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাছাড়া ১৯৬৯ সালে তার নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ তখনকার গণআন্দোলনের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। স্বাধীনতা যুদ্ধেও এ ছবিটির বিরাট প্রভাব ছিল। এত কিছু সত্ত্বেও তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে সাহিত্য ক্ষেত্রে ১৯৯২-এ। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার পরিচয়টা কি বড় ছিল না? ১৯৭৭-৯৫ পর্যন্ত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রে কোনো পুরস্কারই দেওয়া হয়নি। ওই শব্দটার ধার-কাছ দিয়েও যায়নি তখনকার শাসকগোষ্ঠী।

১৯৯৮-তে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রথমবার পুরস্কার প্রদান করা হয় সাতজনকে। সে বছর মোট পুরস্কারের সিংহভাগই স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধার ভাগে। উল্লেখ্য, সে সময়ে শাসন ক্ষমতায় ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। ১৯৯৯ আর ২০০০ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ভাগে একটা করে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ২০০১ সালে আবার সিংহভাগ পুরস্কার স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেওয়া হয়। সেটা ছিল ওই টার্মে আওয়ামী লীগের শেষ বছর। তবে এম আর আখতার মুকুলকে কেন সাংবাদিক হিসেবে পুরস্কৃত করা হলো বোঝা গেল না। তার চরমপত্র মুক্তিযুদ্ধের সময় সব শ্রেণির মানুষকে কীভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে তা অবর্ণনীয়। মানুষ সে সময় চরমপত্রের অপেক্ষায় বসে থাকত। চরমপত্র তার সাংবাদিক পরিচয়কে বহুগুণ ছাপিয়ে গেছে। কাজেই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রটাই তার জন্য মানানসই হতো।

এরপর বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটে। হয়তো লোক দেখানোর জন্য স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য প্রতিবছর এক বা দুজনকে পুরস্কার দেওয়া হতে থাকে। কিন্তু সে নির্বাচনে অগ্রাধিকার পাওয়ার যারা তারা তা পায়নি। ২০০৩-এ যা করা হয় আমার মনে হয় সে একটা তামাশা। ওই বছরে বঙ্গবন্ধু আর জিয়াউর রহমানকে একই সঙ্গে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু আর জিয়াউর রহমান কি একই স্তরের একই পর্যায়ের ব্যক্তি? দুজনকে একই সঙ্গে পুরস্কার দিয়ে কি একই পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে? এর চেয়ে বড় রঙ্গ আর কী হতে পারে? পুরস্কার দিয়ে কি বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন করা যায়? বাংলাদেশ মানেই তো বঙ্গবন্ধুু? বিএনপি বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে লজ্জা পায়। তারা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে। ওই ঘোষণার আসল কাহিনী সবাই জানে। কাজেই সেটা আর বলার দরকার নেই। বাংলাদেশ বেতারের বেলাল মোহাম্মদ সাহেব এটা অনেকবার বলে গিয়েছেন। তাহলে কি চট্টগ্রাম বেতারের সে ঘোষণা ছাড়া কেউ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিত না? তাহলে ৭ মার্চের ভাষণের পর মানুষ এত উত্তাল হয়ে পড়ল কেন? তখন থেকেই লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু করল কেন? চট্টগ্রাম বেতারের ঘোষণার আগেই পাকিস্তানি আক্রমণের বিরুদ্ধে এত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলো কীভাবে? প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার জিয়া সাহেব গঠন করলেন না কেন? বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি তো হয় ছয় দফা। তারপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ছাত্রদের এগারো দফা, ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর জয়, ইয়াহিয়ার ১ মার্চের ভাষণের জবাবে দেশে উত্তাল গণজাগরণ, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। এসব কিছুর নায়ক কি তবে জিয়া সাহেব নাকি? ছয় দফার রূপকার, আগরতলা মামলার প্রধান আসামি কি তাহলে তিনিই ছিলেন? তাকে সঠিক মর্যাদা দিতে তো কারও আপত্তি নেই। কিন্তু সঠিক আসনে তাকে বসাতে হবে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, মেজর রফিকুল ইসলাম, মীর শওকত আলী ইত্যাদি মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তার আসন হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাকে কীভাবে মিলাতে চাওয়া হয় এ তো কল্পনাও করা যায় না। আবার রফিকুল ইসলাম, বীরোত্তমের গ্রন্থ “লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে” থেকে জানা যায় জিয়াউর রহমান তো প্রথমে রাজিই হননি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যেতে।

 

 

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর স্বাধীনতা পুরস্কারে পরিবর্তন এসেছে। এখন মুক্তিযুদ্ধের অবদান স্বীকৃতি পাচ্ছে। শুধু তাই নয় প্রধানমন্ত্রী আরও একটি যে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রবর্তন। স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও সংগঠনকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়। ২০১১ সালের ২৫ জুলাইয়ে সর্বপ্রথম সম্মাননা স্মারক (মরণোত্তর) প্রদান করা হয় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। বঙ্গভবনে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ইন্দিরা গান্ধীকে দেওয়া ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা’ পদক তার পুত্রবধূ ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সোনিয়া গান্ধীর হাতে তুল দেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। ২০১২ সালের ২৭ মার্চে দ্বিতীয় পর্বে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ পদক গ্রহণ করেন ঢাকার নেপালের রাষ্ট্রদূত হরি কুমার শ্রেষ্ঠা। এই শ্রেণিতে সম্মাননা পান মোট আটজন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদমর্যাদার ব্যক্তিদের প্রতিনিধিদের হাতে পদক তুলে দেওয়ার পরপরই ৭৪ ব্যক্তি ও সংগঠনকে দেওয়া হয় ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী’ সম্মাননা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে অ্যালিওড ট্রুডোকে মরণোত্তর ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ প্রদান করেছেন। প্রধানমন্ত্রী কানাডার মন্ট্রিয়েলে হায়াত রিজেন্সি হোটেলে পিয়েরে ট্রুডোর ছেলে বর্তমান কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কাছে ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ান অনার’ হস্তান্তর করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ও এতে বিশেষ অবদান রাখায় কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোকে বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে এই সম্মাননা প্রদান করে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এ উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক সুবিধা প্রদান করেছেন। স্বাধীনতা পুরস্কারে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাও বেড়েছে। তবে মনোনয়নের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে অগ্রাধিকার বিবেচনা করা হচ্ছে কি-না এ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আছে। সব মুক্তিযোদ্ধাকে কি পুরস্কার দেওয়া সম্ভব? না, তা সম্ভব নয়। কিন্তু যাদের অবদান স্পষ্ট, যাদের অবদান সম্পর্কে মোটামুটি সবাই জানে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের নাম সবারই জানা। তাদের অনেককেই এখনো বিবেচনায় আনা হয়েছে বলে দেখা যায় না। বিশেষ করে তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফ, শফিউল্লাহ, সি. আর. দত্ত, আবুল মঞ্জুর, এ টি এম হায়দার, মেজর রফিকুল ইসলাম, নাজমুল হক, কাজী নুরুজ্জামান তালিকায় আসেননি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের নাম হরদম শোনা যেত। মেজর নাজমুল হক তার দ্বিতীয় কমান্ডার ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পেয়েছেন। কিন্তু মেজর নাজমুল হক প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকসেনাদের হাতে শাহাদাতবরণ করেন। তাদের দুজনের কবর সোনা মসজিদের পাশে আছে। নাজমুল হকের রণাঙ্গনের যুদ্ধটা সব সময় বিবিসি সম্প্রচার করে। তার এই অবদানের কেন মূল্যায়ন করা হলো না?

মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা শিল্প মাধ্যম দিয়ে জনগণ, মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন, অর্থ সংগ্রহ করেছেন, পাকিস্তানি বর্বরতা বিশ্বে তুলে ধরেছেন তাদের অনেকেই এখনো হিসাবের বাইরে রয়ে গেছেন। ‘জল্লাদের দরবার’ ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম একটি অনুপ্রেরণাময় অনুষ্ঠান। সেটার মূল চরিত্র করতেন রাজু আহমেদ। শাহীন সামাদসহ অনেক শিল্পী বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। স্বাধীন বাংলা বেতারে যারা কাজ করেছিলেন তাদের  কেন  মূল্যায়ন করা  হলো না। এ ছাড়া আরও ছিলেন— গীতিকার : সিকান্দার আবু জাফুর, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, টিএইচ শিকদার প্রমুখ।

শিল্পী : সমর দাস, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, অরুণ গোস্বামী, মান্না হক, মাধুরী চ্যাটার্জি, এম চান্দ, ইয়ার মোহাম্মদ, প্রবাল চৌধুরী, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, নমিতা ঘোষ, স্বপ্না রায়, জয়ন্তী লালা, অজিত রায়, সুবল দাশ, কাদেরী কিবরিয়া, লাকি আখন্দ, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, বুলবুল মহালনবীশ, ফকির আলমগীর, মকসুদ আলী সাঁই, তিমির নন্দী, মিতালী মুখার্জি, মলয় গাঙ্গুলী, রফিকুল আলম আরও অনেকে। 

সংগীত কম্পোজ : প্রণোদিত বড়ুূয়া। যন্ত্রসংগীত : শেখ সাদী, সুজেয় শ্যাম, কালাচাঁদ ঘোষ, গোপী বল্লভ বিশ্বাসসহ আরও অনেকে। ঘোষক : শেখ সাদী, শহিদুল ইসলাম, মোতাহের হোসেন. আশরাফুল আলমসহ আরও অনেকে।

লাইব্রেরিয়ান : রঙ্গলাল দেব চৌধুরী। স্টুডিও কর্মকর্তা : এস এম সাজ্জাদ। এদের সবার অবদান হয়তো সমান নয়। কিন্তু এদের মধ্যে হতে গোনা দুই-একজন ছাড়া আর কেউ স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছে বলে মনে হয় না। ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ ও পিলখানা ইপিআর প্রাণ দিয়েছেন এবং চট্টগ্রাম সেনা নিবাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে হাজারের ওপরে বাঙালি সৈনিককে হত্যা করে। চট্টগ্রাম বন্দরে কয়েকশত বাঙালি সৈনিককে হত্যা করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে ও জগন্নাথ হলে ছাত্রদের হত্যা করা হয়। তাদের সবাই কি স্বাধীনতা পুরস্কারের সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে?

স্বাধীতনা সংগ্রামের সংগঠক যারা তারাইতো এ পুরস্কারের জন্য সবার আগে বিবেচিত হওয়ার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে খুব কমসংখ্যক পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন, ড. এ আর মল্লিক, দেওয়ান ফরিদ গাজী, ডা. জাফর, এম আর সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, স্বাধীনতার ঘোষণা লেখক এ কে খান এদের মতো আরও অনেকেই পুরস্কারের তালিকায় প্রথম সারিতে থাকার কথা। কিন্তু তা হলো কই?

পুরস্কার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বলতে গেলে শূন্যের কোঠায় আছেন মনে হয় আমলারা। তাদের মধ্যে খুব নগণ্য সংখ্যক এ পর্যন্ত পুরস্কারের তালিকায় এসেছেন। অথচ তারা অনেক ঝুঁকি নিয়ে অনেক দামি চাকরির মায়া ত্যাগ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের যারা বিভিন্ন পদে নিয়োজিত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- রুহুল কুদ্দুস, নুরুল কাদের খান, এইচটি ইমাম, ডা. এস এ সামাদ, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, কামাল উদ্দিন আহমদ, আকবর আলী, সা’দত হোসেন, দীপক কুমার চৌধুরী, ওলিউল ইসলাম, বজলুর রহমান, এম এ সামাদ, নরেশ চন্দ্র রায়, মতিউর রহমান, কাজী রকিবউদ্দীন, এম এ আউয়াল, আবু তালেব, মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ, শাহ মতিউর রহমান, এম এ খালেক, খসরুজ্জামান চৌধুরী, সৈয়দ মাহবুব রশিদ, জ্ঞানরঞ্জন সাহা, ডিকে নাথ এবং আরও অনেক। সেক্টর কমান্ডার ও তার সাথী যোদ্ধারা যদি খেতাব পায় মুজিবনগর প্রশাসনের কর্মকর্তারা কেন খেতাব থেকে বঞ্চিত হলো?

জনাব সৈয়দ রেজাউল হায়াত মাদারীপুরের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণের পরে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য সর্বস্তরের জনগণকে সংগঠিত করেন। পরবর্তীতে পাকসেনাদের হাতে বন্দী হয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন। তাকে পাক আর্মির সামরিক আদালতে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাকে বৃহত্তর ফরিদপুরে জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগ দেন পরে বৃহত্তর ঢাকা জেলার প্রশাসক নিয়োগ দেন। এখনো পর্যন্ত তার কোনো মূল্যায়ন করা হলো না।

মুুক্তিযুদ্ধ প্রধানত তিনটি ফ্রন্টে হয়েছিল। একটি তো অধিকৃত বাংলাদেশ ভূখণ্ড পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ; তাছাড়া উল্লেখযোগ্য ফ্রন্ট ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার ও বিদেশি কূটনৈতিক ফ্রন্ট। সে সময়ে বেশ কয়েকটি দেশে পাকিস্তানি দূতাবাসের বাঙালি কুটনীতিকরা বিরাট ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন জ্ঞাপন করে। তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নয়াদিল্লিতে কর্মরত কে এম শিহাব উদ্দিন, কলকাতায় হোসেন আলী প্রমুখ।

আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। তিনি বিদেশে ছিলেন কোনো একটা প্রোগ্রামে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে। তিনি সেখানেই পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে ইউরোপে বাংলাদেশের বিশেষ দূত হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি নিশ্চয়ই স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু ঘটনাটা এখনো ঘটেনি।

১৯৭১ সালে জুলাই মাসে ৯টি অঞ্চলে এবং সেপ্টেম্বর মাসে চূড়ান্তভাবে ১১টি অঞ্চলকে সেক্টর করে ভাগ করা হয়। সেক্টর কমান্ডারদের পরে বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। উপরে প্রদত্ত তালিকায় স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত আছেন মাত্র ছয়জন। কূটনৈতিক মিশনের পাঁচজন আর সাধারণ প্রশাসনের শুধু একজন। তার মধ্যে এনায়েত করিম (১৯৭৭) আর হোসেন আলীকে পুরস্কৃত করা হয়েছে জনসেবার জন্য। কিন্তু তারা সবার কাছে পরিচিত মুক্তিযুদ্ধের সময় পকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করার কারণে তাদের সে ভূমিকা বাঙালিদের মনোবল অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। কাজেই তারা বিবেচ্য হওয়ার কথা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য। কে এম শিহাবুদ্দীনকে ২০১৬ এবং শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও আবুল মাল আবদুল মুহিতকে ২০১৫ পুরস্কারের জন্য বিবেচনায় এনেছেন বর্তমান সরকার। মুজিবনগর সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে পুরস্কার পেয়েছেন মাত্র রুহুল কুদ্দুস। বর্তমান সরকার এদের অনেককে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে বিভিন্ন মর্যাদাপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে একটা আশা থাকা স্বাভাবিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার। আগেই বলা হয়েছে ১৯৭৭-১৯৯৬ এবং ২০০২-২০০৮ পর্যন্ত এ পুরস্কারের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা সঠিকভাবে বিবেচিত হননি। বিশেষ করে মুজিবনগর সরকারে এবং আঞ্চলিক পরিষদের বিভিন্ন জোনে যেসব সিভিল সার্ভেন্ট যুক্ত ছিলেন তাদের এ পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করা হয়নি বললেই চলে। বর্তমানেও তাদের কমই বিবেচনা করা হচ্ছে। এদের সবাইকে হয়তো একসঙ্গে পুরস্কৃত করা সম্ভব নয়। কিন্তু ভূমিকা অনুযায়ী তাদের অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করা যায়। দ্বিতীয়ত এ পুরস্কারটার জন্য বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে যারা অবদান রেখেছেন তাদেরই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। সংগীত, সাহিত্য, চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি পুরস্কার দেওয়া হয়। সরকার থেকেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রয়োজন হলে সেসব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার চালু করা যেতে পারে। তবে যাই হোক স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মুক্তিযুদ্ধের অবদানকেই আগে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনো বাকি আছে। তাদের সবাইকে বিবেচনায় আনতে অনেক সময় লাগবে। কাজেই উদ্যোগটা এখনই গ্রহণ করা উচিত। এদের অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন, তবে সবাই জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। জীবদ্দশায় স্বীকৃতি পেলে তারা তৃপ্তিটুকু উপভোগ করে যেতে পারতেন। মরণোত্তর পুরস্কারতো প্রাপক নিজে দেখতে পায় না। এ সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর সম্মান আর সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন এবং পাচ্ছেন। আশা করি এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না।

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বলছি জেনারেল জেকবের বইতে লিখেছেন বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভিতরে মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের রাত-দিন আতঙ্কিত অবস্থায় রেখে ছিল। তারা গেরিলা হামলায় ব্যস্ত রাখত। ভূখণ্ডের ভিতরে মুজিব বাহিনী ও মুক্তি বাহিনী না হলে এত সহজে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করত না। কিন্তু যুদ্ধের পরে এদের কপালে কোনো খেতাব তো দূরের কথা স্বাধীনতার পরে সম্মান পর্যন্ত জুটল না। আপনি ক্ষমতায় আসার পর সম্মান ও আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছে।

অতএব, প্রধানমন্ত্রীকে বলব স্বাধীনতা পুরস্কারটা যেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধারা পায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট ছিল তারাই যেন এ পুরস্কারটা পায়, আপনার আমলে আইন করে গেলে শহীদ পরিবার ও মুুক্তিযোদ্ধারা আনন্দিত হবে।

     লেখক : মুক্তিযোদ্ধা

সর্বশেষ খবর