হালদা নদী পার্বত্য চট্টগ্রামের বদনাতলি পাহাড় থেকে উত্পন্ন হয়ে ফটিকছড়ির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম জেলায় প্রবেশ করেছে। এটি বয়ে চলেছে ফটিকছড়ির বিবিরহাট, নাজিরহাট, সাত্তারঘাট, হাটহাজারী, রাউজান এবং চট্টগ্রাম শহরের কোতোয়ালি থানার মধ্য দিয়ে। এরপর কালুরঘাটের কাছে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে এ নদী। ৮৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীর ২৯ কিলোমিটার অংশ সারা বছর বড় নৌকা চলাচলের উপযোগী থাকে। প্রতি বছর হালদা নদীতে বর্ষার ঘনবৃষ্টির অমাবস্যার রাতের একটি বিশেষ মুহূর্তে রুইজাতীয় মাতৃমাছ ডিম ছাড়ে। কার্পজাতীয় মাছের উত্কৃষ্ট প্রজনন ক্ষেত্র এ হালদা নদী। প্রাকৃতিক প্রজননের এক স্বর্গীয় ক্ষেত্র বলতে পারি আমরা হালদাকে। ঘন মেঘের দিনে দুপুরে কিংবা বিকালেও ডিম ছাড়ে মাছ। ডিম ছাড়ার সেই বিশেষ সময়কে তিথি বলা হয়। স্থানীয় জেলেরা ডিম ছাড়ার তিথির আগেই নদীতে অবস্থান নেন। ডিম দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপিয়ে পড়েন নদীতে।
সংগ্রহ করা ডিম থেকে তারা পোনা তৈরি করেন সনাতন কায়দায়। জোয়ার-ভাটার নদী থেকে সরাসরি ডিম আহরণের এমন নজির পৃথিবীতে বিরল। রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ পোনার জন্য এ নদীর আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, বাঁক কাটা, মা-মাছ নিধন, দূষণ, সরকারের উদাসীনতা নানা কারণে এটি এখন বিপর্যয়ের মুখে। প্রতি বছর মা-মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। ১৯৪৫ সালে যেখানে ৪ হাজার কেজি রেণু উৎপাদিত হয়, সেখানে গত বছর কোনো ডিমই সংগ্রহ করতে পারেননি হালদাপাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা। ২০১৬ সালে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ডিম ছাড়ার প্রতিটি তিথি অপেক্ষা করে তিনবার শুধু নমুনা ডিম পেয়েছেন তারা। তাতে মাত্র ১২ কেজি রেণু উৎপাদিত হয়েছে। স্মরণকালে হালদার এমন বন্ধ্যত্ব আর দেখা যায়নি। পাঠক! রুই মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র বিনষ্ট হলে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশের মাতৃমাছের উৎস হারিয়ে যাবে। হালদার পোনা থেকেই হয় মাতৃমাছ। এর ওপর নির্ভর করে চলে সারা দেশের হ্যাচারি। হালদাই কার্প-জাতীয় মাছগুলোর প্রকৃত জাত রক্ষা করে চলেছে। হালদার এ উৎস যদি না থাকে তাহলে রুই, কাতলা মাছের উৎপাদনে বড় এক প্রভাব পড়বে। আমরা হারিয়ে ফেলব আসল জাতগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের পর বছর হালদায় রুই মাছের ডিম ছাড়ার হার কমতে কমতে বর্তমান এই দশা। এবার কারণগুলো সন্ধান করার চেষ্টা করব আমরা। সব কারণই মানবসৃষ্ট।
বাঁধ আছে, কৃত্রিম সেচের জন্য হালদার অনেক জায়গায় স্লুুইস গেট তৈরি হয়েছে। আবাসিক, শিল্প ও ট্যানারির বর্জ্য এসে পড়ছে হালদা নদীতে। ফটিকছড়ির ভুজপুরে দুটি রাবার ড্যামের (বাঁধ) কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে হালদা নদীর একটি অংশ। নদী থেকে বালু তোলায় এর মাটির গঠন নষ্ট হচ্ছে। তীরে একের পর এক গড়ে ওঠা ইটভাটায় ব্যবহৃত হচ্ছে নদীর মাটি ও পানি। নদীর ১১টি স্থানের বাঁক সমান করে ফেলায় মাছের বিচরণ ও প্রজনন কমে গেছে। এ ছাড়া ফটিকছড়ির চা-বাগানগুলোর জন্য নদীর পানি ব্যবহার হচ্ছে, নদী থেকে প্রতিদিন চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উত্তোলন, খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে নদীর তীরে তামাক চাষ ও যন্ত্রচালিত নৌযান থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ে দূষিত হচ্ছে হালদা নদী।হালদা নদী শুধু মৎস্যসম্পদের জন্য নয় এটি যোগাযোগ, কৃষি ও পানিসম্পদেরও একটি বড় উৎস। কিন্তু হালদা এখন বন্দরনগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের আরেক ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। দিনের পর দিন হালদার বিপন্ন দশা যেন বেড়েই চলেছে। হালদার নিয়তি এখন রাবার ড্যাম, ড্রেজিং, একপাশে জলাবদ্ধতা আরেক পাশে শুষ্কতার অভিশাপে জর্জরিত। চট্টগ্রাম শহরের সব নাগরিক বর্জ্যনালা এসে মিশছে একসময়ের এ মাছের খনিতে। চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে এ নদী থেকে। পাঠক বলে রাখি, ৬০ লাখ মানুষের পানির চাহিদা মেটায় হালদা। চট্টগ্রামের মানুষের লাইফলাইন বলা হয় এ নদীকে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলেও এ নদীকে টিকিয়ে রাখা খুবই জরুরি।
জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ যে কয়েকটি প্রাকৃতিক সম্পদ বাংলাদেশে রয়েছে তার মধ্যে হালদা অন্যতম। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগের অভাব এবং পরিবেশ দূষণসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণে প্রাকৃতিক এ ক্ষেত্র এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। আমি টানা কয়েক বছর হালদা নদীর এ বিপর্যয় ও পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। এ নিয়ে একাধিকবার প্রতিবেদনও তুলে ধরেছি। সর্বশেষ কয়েক মাস আগে যখন হালদা নদীর বিপন্ন দশা অনুসন্ধানে কাজ করছি তখন আমাদের সঙ্গে দেখা হয় হালদা বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়ার সঙ্গে। তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন হালদার দিনে দিনে ধ্বংসমুখে পতিত হওয়ার আরও কিছু কারণ। মনজুরুল কিবরিয়ার মতে হালদা নদীর বাঁকগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হালদার এসব গভীর জায়গা মাছের সারা বছরের আবাসস্থল। বাঁকগুলোয় মাছ অবস্থান করে প্রজননের সময়। মনজুরুল কিবরিয়া যখন এ কথা বলছিলেন, তখন খেয়াল করছিলাম এ বাঁকগুলোতেও চর পড়ছে। মানবসৃষ্ট কারণে কী দ্রুতই না আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। হালদার ওপরে চলতে চলতে দেখলাম মদুনাঘাট সেতু; যা চট্টগ্রামের সঙ্গে কাপ্তাইকে যুক্ত করেছে। পুরনো সেতুর কিছু অংশও রয়ে গেছে এখনো। স্থানীয়রা বলছেন ওয়াসার প্রকল্পের জন্য যে পানির পাইপলাইন নেওয়া হয়েছে এর জন্য পুরনো সেতুটি এখনো রাখা আছে। এ দুটো সেতুর কারণে বাঁকের ওপর বেশ প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
হালদার দুরবস্থা দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। সামনেই মিলল হালদার মাছ নিধনের আরেক চিত্র। যা মাছের প্রজননের অন্যতম এ ক্ষেত্রের জন্য এক ধ্বংসের আয়োজন বলা যায়। হালদার বুকজুড়ে জাল মারা হয়েছে। জোয়ারের সময় জাল ফেলা হয়। ভাটায় আটকা পড়ে মাছ। এ অপকর্ম নিরোধে কোনো কর্তৃপক্ষের নজরদারি নেই। এ কারণে হালদায় মাছ কমে আসছে। এর পাশেই চলছে আরেক অপকর্ম। এটিও হালদা ধ্বংসেরই আরেক প্রক্রিয়া। নদীর কূলঘেঁষে গড়ে তোলা হচ্ছে ইটের ভাটা। হাই কোর্টের রায় অনুযায়ী জোয়ার থেকে দেড়শ ফুট জায়গা নদীর, জানালেন মনজুরুল কিবরিয়া। অথচ সেখানেই গড়ে উঠেছে ইটের ভাটা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে বিষয়টি তা হলো ধীরে ধীরে ইটের ভাটাগুলো এগিয়ে আসছে নদীর একদম পাড়ে। নদী ধ্বংস করে ফেলার এক চূড়ান্ত কর্মযজ্ঞ।
চলতে চলতে আরেকটি খাল চোখে পড়ল। এ খাল দিয়েও আসছে নাগরিক বর্জ্য। পাঠক! এভাবেই দিনের পর দিন ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে হালদা নদী। রুই-জাতীয় মাছের এ প্রজনন ক্ষেত্র ইতিমধ্যেই হারিয়েছে তার অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য। এখন এ নদীর টিকে থাকাই প্রশ্নের মুখে। চারদিকেই যেন চলছে ধ্বংসের তত্পরতা। অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে বালুও উত্তোলন করা হচ্ছে যান্ত্রিক ড্রেজার দিয়ে। এদিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার উত্তর মেখন ইউনিয়নের রহল্লাপুরে হালদা সম্প্রসারণ সেচ প্রকল্প নামে আরেকটি ব্যয়বহুল কর্মযজ্ঞ চালানো হয়েছে। শুরুতে এটি ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প ছিল, এখন প্রকল্পটি পৌঁছেছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকায়। বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায় এটিও অপরিকল্পিত একটি প্রকল্প, যা হালদা ধ্বংসেরই আরেক তত্পরতা। এখন পাহাড়ি যে ঢল হালদার পানিতে মেশে তাও নিরাপদ নয়। সেটিও দূষণের আরেক ক্ষেত্র। এখন পাহাড়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তামাক চাষ। পাহাড়ি ঢলের পানি মিশছে খেতের অবশিষ্ট তামাকের সঙ্গে। তার মানে হালদার পানিও এখন তামাকের বিষে দূষিত। হালদার এ বহুমুখী ক্ষতি নিয়ে সমন্বিত কোনো জরিপ ও উদ্যোগ আজও পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এ পর্যন্ত যা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার বেশির ভাগই খণ্ডিত ও আংশিক। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ভুজপুর রাবার ড্যাম স্থাপনে হালদার ওপর প্রভাব বিষয়ে কথা হয়েছে বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের সঙ্গে। ড. আইনুন নিশাত বলছেন, রাবার ড্যাম দুটোর একটি মূল নদীতে অন্যটি শাখা নদীতে। যার কারণে পানি আটকে গেছে, বলছেন ড. নিশাত। এ কারণে মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণীর চলাচল বলা চলে বন্ধ হয়ে গেছে। রাবার ড্যাম স্থাপনার ক্ষেত্রে উজান-ভাটিতে পানির চাহিদার যে সম্পর্ক তা আগে নির্ণয় করা উচিত বলে মনে করেন এই বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ। রাবার ড্যাম নির্মাণের আগে ভাবা উচিত এর উচ্চতা কতটুকু হবে। কতটা পানি উপচে যাবে, যেতে পারে বা একদম যাবেই না, সে বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. নিশাত। এদিকে চট্টগ্রাম নগরীর বর্জ্য হালদায় অপসারণ, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে হালদার গতিপথ রুদ্ধ করার মতো তত্পরতায় রীতিমতো উদ্বিগ্ন চট্টগ্রাম জেলা নদীরক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান তথা জেলা প্রশাসক। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও নদীরক্ষা কমিটির সভাপতি মেজবাহ উদ্দিন জানালেন, শুধু মোবাইল কোর্ট দিয়ে কাজ হবে না। প্রয়োজনে তারা আরও আলোচনা করতে চান হালদা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। প্রিয় পাঠক! আমাদের যা কিছু আছে গলা বাড়িয়ে বিশ্ববাসীর সামনে বলার মতো, তার অন্যতম এক সম্পদ হচ্ছে এ হালদা নদী। এ নদীর প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য পৃথিবীতে বিরল। আমরা আজও হালদার এ ঐশ্বর্য হয়তো পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পারিনি, তাই মূল্যায়নের বদলে দিনের পর দিন অবমূল্যায়ন করে চলেছি। যেসব কারণে হালদা আজ সংকটে পড়েছে, বিপন্ন দশার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার সব কারণই মানবসৃষ্ট। আমরা চাই, সরকার হালদা নদীকে মানবসৃষ্ট এসব অভিশাপ থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেবে। খালের মাধ্যমে হালদা নদীতে শিল্প ও আবাসিক বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা, ভারী শিল্প কারখানায় ইটিপি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, মা-মাছ ধরা বন্ধে নদীতে পাহারা জোরদার করা, রাবার ড্যাম প্রত্যাহার, তামাক চাষ বন্ধ করবে। প্রয়োজনীয় গবেষণা ও উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আবারও ফিরিয়ে আনবে মাছের প্রজননের উপযুক্ত ক্ষেত্রগুলো। তা না হলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই নিঃশেষ হয়ে যাবে আমাদের দেশি রুইজাতীয় মাছের এ প্রাকৃতিক উৎস ক্ষেত্র।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।