শিরোনাম
শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

লেনদেন পরিশুদ্ধতা দীনের গুরুত্বপূর্ণ বিধান

মুফতি মুহিউদ্দীন কাসেম
পেশ ইমাম. বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

লেনদেনের পরিশুদ্ধতা দীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে : হে ইমানদারগণ! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবল তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা হয় তা বৈধ। (সূরা নিসা : ২৯)। এ আয়াতে পারস্পরিক লেনদেন স্বচ্ছ করার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে স্বচ্ছ পরিচ্ছন্ন লেনদেনের ক্ষেত্রে অনেকেই অবহেলা করে। তাদের ধারণা, দীন অর্থ নির্দিষ্ট কিছু ইবাদত যেমন নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি। স্মরণ রাখতে হবে, উল্লিখিত বিধানাবলি যেমন শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, তদ্রূপ ইসলাম নির্দেশিত পদ্ধতিতে লেনদেন করাও শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। শুধু তাই নয়, অন্যান্য ইবাদত থেকে স্বচ্ছ লেনদেন অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ইবাদতের মাঝে অবহেলা থাকলে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়। কোনো নামাজ ছুটে গেলে তা পরে কাজা করে নেওয়া যায়। মারা গেলে অসিয়ত অনুযায়ী তার সম্পদ থেকে কাফফারা আদায় করা যায়। তওবার মাধ্যমেও কিছু কিছু ইবাদতের ক্ষতিপূরণ হতে পারে। কিন্তু অসদুপায়ে সম্পদের ক্ষতিপূরণ তখনই সম্ভব যখন সম্পদের প্রকৃত মালিক থেকে মাফ নেওয়া যায়। অন্যথায় হাজারো তওবা করলেও, শতবার নামাজ পড়লেও তার ক্ষমা নেই। মনে রাখতে হবে, সততা, সত্যবাদিতা ও আমানতদারিতা ইসলামী লেনদেনের মূলনীতি। লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনোরূপ মিথ্যা, ধোঁকা বা খিয়ানতের আশ্রয় নেওয়া সঠিক পরিচ্ছন্ন লেনদেন হতে পারে না। সুতরাং সঠিকভাবে লেনদেন করতে হলে অবশ্যই মিথ্যা বলা, ধোঁকা দেওয়া, মাপে কম দেওয়া, একটা বলে অন্যটা দেওয়া, খাদ্যে ভেজাল মেশানো, অধিক মুনাফার উদ্দেশ্যে খাদ্যে বিষাক্ত পদার্থ প্রয়োগ, অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা বন্ধ করতে হবে। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে : হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। (সূরা আহজাব : ৭০)।

এক হাদিসে এসেছে, ইমানদারদের মাঝে অন্য দুর্বলতা থাকলেও মিথ্যাবাদিতা ও খিয়ানত থাকতে পারে না। মুসনাদে আহমাদ ৫/২৫২। অন্য হাদিসে আছে, তিন শ্রেণির মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ১. বৃদ্ধ ব্যভিচারী ২. মিথ্যাবাদী ৩. সম্পদহীন অহংকারী। মুসনাদে বাজ্জার ৬/৪৯৩। মিথ্যার সঙ্গে খিয়ানত ও প্রতারণার জোরালো সম্পর্ক। মিথ্যার পথ দিয়েই মানুষের মাঝে খিয়ানত ও প্রতারণার স্বভাব সৃষ্টি হয়। রসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমানতদারকে ইমানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, যার আমানতদারি নেই তার ইমানদারি নেই। সহি ইবনে হিব্বান ১/৪২২। সুতরাং ইমানদার ব্যক্তির দায়িত্ব পরিচ্ছন্ন লেনদেনের মাধ্যমে হালাল উপার্জন করা। হারাম উপার্জনকারীর ক্ষেত্রে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তির মাংস হারাম মাল দ্বারা বর্ধিত হবে তার জন্য দোজখই উপযুক্ত। (তিরমিজি)।

পক্ষান্তরে সত্য ও আমানতদার লেনদেনকারীদের জন্য হাদিসে সুসংবাদ এসেছে। ইরশাদ হয়েছে : যদি ক্রেতা ও বিক্রেতা সত্য বলে এবং সবকিছু স্পষ্ট করে লেনদেন করে তাহলে তাদের লেনদেনে বরকত হবে। আর যদি গোপন রেখে লেনদেন করে এবং মিথ্যা বলে, তাতে তাদের ব্যবসায় বরকত থাকবে না। সহি বুখারি : ২১১৪। নিম্নে ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কে জরুরি কিছু আহকাম উল্লেখ করা হলো।

ক্রয়-বিক্রয় মুয়ামালাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ সম্পর্কে অনেক বিধিবিধান রয়েছে। যা জানা প্রত্যেক মুসলিম ব্যবসায়ীর জন্য জরুরি। হজরত ওমর (রা.)-এর যুগে কোনো ব্যবসায়ীকে ব্যবসার অনুমতি দেওয়া হতো না যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যবসাসংক্রান্ত দীনি আহকাম না জানতেন। আজকাল ব্যবসায়ীরা ব্যবসা সম্পর্কে শরিয়তি বিধিবিধানের কোনো পরোয়াই করেন না। যার কারণে আমাদের মুয়ামালাত তথা লেনদেনের মধ্যে অধঃপতন ও বিপর্যয় নেমে এসেছে।

* ক্রয়-বিক্রয় এবং পাওনা আদায়ের সময় মিষ্ট আলাপ ও নম্র-ভদ্র ব্যবহার করবে, কর্কশ বা অভদ্র ব্যবহার করবে না।

* জিনিস বিক্রির জন্য কসম খাবে না। কারণ হয়তো দু-একটি মিথ্যা কথা মুখ দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে, তাহলে বরকত নষ্ট হয়ে যাবে।

* ব্যবসা বড়ই ভালো জিনিস। যদি বিশ্বস্ততা এবং সত্যবাদিতার সঙ্গে করা হয়। কারণ, এতে দুনিয়ায় বিশ্বাস বাড়ে এবং আখিরাতে আম্বিয়া, সিদ্দিকিন ও শহীদদের সঙ্গ লাভ হয়।

* নিজের জিনিস/বা টাকা-পয়সায় যদি কোনো দোষত্রুটি থাকে, তবে তা কিছুতেই লুকাবে না। পরিষ্কার বলে দেবে; নতুবা বরকত থাকবে না।

* সুদের কারবারের কাছেও যাবে না; নেবেও না, দেবেও না, লিখবেও না, সাক্ষ্যও দেবে না। কারণ, হাদিসে এসবের ওপরই লানত এসেছে।

* একজন একটা জিনিস দর করছে, বিক্রেতা দেবে কিনা তা এখনো ঠিক হয়নি এবং ক্রেতার গ্রহণ না করাও নিশ্চিত হয়নি। এ অবস্থায় অন্য কারও সেখানে গিয়ে জিনিসটার দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। কারণ, এতে আগেরজনের কষ্ট লাগতে পারে। তবে যখন তার গ্রহণ না করা নিশ্চিত হয়ে যাবে, তখন গিয়ে দর করতে পারবে।

কেনার উদ্দেশ্য ছাড়া খরিদ্দারকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য দাম বাড়াবে না। পণ্যে ভেজাল দেবে না।

কোনো ধরনের পণ্যে বিষাক্ত মেডিসিন, ফরমালিন মেলাবে না। কেননা এ ক্ষেত্রে শুধু দেনদেনের ধোঁকার গুনাই নয়, বরং বিষাক্ত ওষুধ মেশানো ফল, মাছ ইত্যাদি খেয়ে যত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও অসুস্থ হবে তার দায়ভার ও গুনা ওই অসৎ ব্যবসায়ী এবং তাকে এ অবৈধ কাজে প্রশ্রয়দাতার হবে।

সর্বশেষ খবর