সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

হোক চির অবসান, শিশু নিধন শিশু নির্যাতন

লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান

হোক চির অবসান, শিশু নিধন শিশু নির্যাতন

সুকান্ত তার ছাড়পত্রে লিখেছিলেন...

চলে যাব-তবুও যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল।

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি।

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

সুকান্ত মানুষের নিষ্ঠুরতা, সমাজের অবিচার আর অবক্ষয় তার কবিতায় বলে গেছেন।

সুকান্ত তারুণ্যের কবি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের কবি। সুকান্ত স্বপ্নচারী। শোষণহীন, বঞ্চনাহীন সমাজ তিনি সৃষ্টি করতে পারেননি। পারেননি শিশুদের বাসযোগ্য পৃথিবী নির্মাণ করতে। তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তিনি অকালে মাত্র বাইশ বছর বয়সে তার অঙ্গীকার পালন না করেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। বাংলা সাহিত্য এক মহান প্রতিভাকে হারিয়ে ফেলে। হারিয়ে ফেলে এক প্রতিশ্রুতিবান মহান কবিকে, যা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। সাহিত্য কাননে এক অঙ্কুরিত গোলাপ কুসুমেই ঝরে পড়ে। দুর্ভাগ্য এ বিশ্বের। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের হতভাগা শিশুদের।

শিশুরাই আমাদের প্রজন্ম। আমাদের ভবিষ্যৎ। তারাই তো ভাবিকালের আমরা। ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে। শিশুরাই গড়বে উন্নত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। নির্মাণ করবে আগামী দিনের শোষণহীন, বঞ্চনাহীন, বৈষম্যহীন এক আনন্দ পৃথিবী।

বাংলাদেশের শিশুরা চরম অসহায়। তারা নির্যাতনের সহজ শিকার। তারা অমানবিকভাবে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। তারা খেটেই চলে। সবাই মিলে খাটতে বাধ্য করে। বিশ্রামহীন, নিদ্রাহীন, ক্লান্তিহীন জীবন তাদের। তাদের শ্রমের কোনো মূল্য  নেই। শিশুশ্রম বাংলাদেশে পানির চেয়েও সস্তা এক পণ্য। ঢাকা মহানগরীতে কোটি মানুষের বাস। নগরবাসীর জীবনকে চলমান রেখেছে স্বস্তি দিচ্ছে শিশুশ্রম। শিশুরাই প্রত্যেকের ঘরে ঘরে ভৃত্যের কাজ করে চলেছে। গৃহভৃত্যরা সবাই মোটামুটি শিশুভৃত্য। এটাই বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র। ঘরের বাইরেও শিশুরা নাগরিক জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও সহজ করতে রক্ত পানি করছে। তাদের এ কঠিন শ্রমের ফসল উপভোগ করছে তাদের পিতা-মাতা ও অভিভাবকরাও। উপচিয়ে উপভোগ করছে তাদের শ্রমগ্রহীতারা, তাদের মালিকরা, মালিকপত্নীরা, মালিক পরিবারের সদস্যরা। শ্রম-শিশুরা শ্রমের বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক পায় না। হয়তো দুমুঠো খাবার জোটে। মালিকরা এটা ভালো করেই জানেন শিশু শ্রমের দীর্ঘ সুবিধা নিতে হলে তাকে ন্যূনতম হলেও কিছু খাবার খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাদের ভাগ্যে কখনো জোটে না কোনো ভালো ব্যবহার, কোনো ভালো কথা। হয়তো জোটে ঈদে, পূজা-পার্বণে দু-এক পয়সা বকশিশ এর বেশি কিছু নয়।

শ্রম-শিশুরা শিক্ষাবঞ্চিত। অধিকারবঞ্চিত আন্তর্জাতিক আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ, অপরাধযোগ্য। কিন্তু বাংলাদেশে লাখ লাখ শিশু উদয়াস্ত খেটে চলেছে। আইন রক্ষাকারী সংস্থাকে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোথাও কেউ এগিয়ে আসতে দেখেনি। আইন অমান্যকারীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে দেখেনি। ঘরের শ্রমে শিশুদের গৃহবধূরা অগ্নিদগ্ধ করে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। কেরোসিন গায়ে ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। অ্যাসিড ছুড়ে মারে। এমন ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটছে। বার বার ঘটেই চলেছে। এর ব্যাপকতা প্রতি পাড়ায় প্রতি মহল্লায় প্রতি ঘরে ঘরে। সমাজে আজ শিশু শ্রমিক সবচেয়ে নিরাপত্তাহীনতার শিকার। তারা সবচেয়ে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত।

কিছুদিন আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম এক কাজের শিশুকে শাস্তি দিতে গাড়িচালক চাকায় গ্যাস দেওয়ার মেশিন শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গে প্রবেশ করিয়ে গ্যাস ছেড়ে মেরে ফেলে। এ রকম মর্মান্তিক পৈশাচিক মৃত্যুর শিকার শিশুরা ঢাকা শহরে ও বিভিন্ন জায়গায় বার বার হচ্ছে। শিশু শাস্তির এ অভিনব আবিষ্কার ও কার্যকরণে এ রকম পৈশাচিক পরিতৃপ্তি নরকের অপদেবতাকেও হার মানায়। সমাজ আজ কোথায় চলেছে।

 

 

কিছুদিন আগে পত্রিকায়, টেলিভিশনে দেখেছিলাম চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার চেয়ারম্যান এক হাইস্কুলের অনুষ্ঠানে এক মানব সাঁকো বানিয়ে পরম আনন্দে গর্বের সঙ্গে জুতা পরে তাদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে কিছু পথ হেঁটে চলেছেন। কী এক অদ্ভুত পৈশাচিক আনন্দ তিনি লাভ করেছেন, গর্ববোধ করেছেন। স্কুলের হেডমাস্টার উপজেলা চেয়ারম্যানের সম্মানে এত বড় মানব সাঁকোর অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পেরে নিজেকে ধন্য ধন্য মনে করেছেন। প্রধান শিক্ষকের একি বিকৃত অভিরুচি, একি বিচিত্র মন-মানসিকতা! অবাক হই এই ভেবে, এরাই কি মানুষ গড়ার কারিগর! আমি দিনাজপুর জিলা স্কুলে পড়াশোনা করেছি। সে গত শতকের পঞ্চাশ দশকের দিকের কথা। কবি কাজী কাদের নেওয়াজ ছিলেন আমার প্রধান শিক্ষক। তার নাম মনে হলে এখনো শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে আসে। তার ছাত্ররা যুগ যুগ ধরে তাকে স্মরণ করে চলেছে। আমার অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক ছিলেন গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য্য। তিনি শরত্চন্দ্রের ইন্দ্রনাথ চরিত্র পড়াতেন। আমরা প্রত্যেকে ইন্দ্রনাথের মতো পরোপকারী দুঃসাহসী হতে চাইতাম। তিনি তার পছন্দের বইগুলো আমাদের পড়তে বলতেন। লাইব্রেরি থেকে জোগাড় করে দিতেন। আমার স্কুলের শিক্ষকরা সবাই আদর্শ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। আমাদের নীতির প্রশ্নে অবিচল থাকতে বলেছেন। প্রতিকূল অবস্থায় সাহস ও ধৈর্য ধরতে বলেছেন। মানুষ হতে বলেছেন। আমার অনেক সময় মনে হয় অনেক স্কুলে ছাত্রদের যেভাবে দৈহিক শাস্তি দেওয়া হয় তা নির্যাতনেরই নামান্তর। শাস্তির পরিণতিতে অনেক ছাত্রকে মৃত্যুবরণ করতে শুনেছি। অনেক ছাত্র বিকলাঙ্গ হয়েছে। অনেক স্কুল যেন এখনো টর্চারিং সেল।

শিশুদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়ের জায়গাটি তার মাতৃকোল। কী নির্মম হৃদয়হীন এ পৃথিবী! শিশুরা হত্যা হচ্ছে। ঘাতক আর কেউ নয় শিশুর স্বীয় জন্মদাত্রী মা। এও কি সম্ভব! কী নিষ্ঠুর, কী নিদারুণ মা। স্বামী-স্ত্রীর কলহ। বলি হচ্ছে সন্তান। মা আছাড় দিয়ে মারছে। পিতা পানিতে ডুবিয়ে মারছে। ছুরি দিয়ে গলা কাটছে। মায়ের পরকীয়ার বলি হচ্ছে তার গর্ভজাত সন্তান। মা আপন সন্তানকে বিষ খাওয়াচ্ছে। শ্বাসরোধ করে গলাটিপে হত্যা করছে। এ শিশু হত্যার মহামারী রোগ গোটা সমাজে বিস্তার ঘটাচ্ছে। শিশুর সবচেয়ে নির্ভরের জায়গাটি, সবচেয়ে নিরাপদ স্থানটি তার মা, তার মায়ের কোল। এটি আর এখন থাকল না। উদগ্র যৌন কামনা, লোভ লালসা, প্রতিহিংসা, মায়ের স্বর্গীয় স্নেহ ভালোবাসার জায়গাটি ভেঙে তছনছ করেছে। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব! তবে কি মানুষ ইতিমধ্যে পশুতে পরিণত হয়েছে? কিন্তু পশুদের মধ্যেও মাতৃস্নেহ হাজার কোটি বছরে এতটুকুও কমতি কেউ দেখেনি। একটি মুরগিও তার ছোট্ট ছানাগুলোকে চিলের কবল থেকে রক্ষা করতে কী রুদ্ররূপ ধারণ করে চিলকে প্রতিহত করে তা আমরা সব সময় দেখি।

আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে আরব দেশে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে পিতা তাকে মাটিতে পুঁতে হত্যা করত। তখন নারীদের কোনো মর্যাদা, কোনো কদর সম্মান ছিল না। পরিবারে নারীদের চরম কলঙ্ক বলে গণ্য করা হতো। কিন্তু সে তো দেড় হাজার বছর আগে আইয়ামে জাহেলিয়াতের কথা। বাংলাদেশ কি সে অন্ধকার যুগে ফিরে যাচ্ছে? একবিংশ শতাব্দীর মাঝ পথে তারা কীভাবে শিশু হত্যা করছে? তারা শিশু হত্যা করছে, লিঙ্গ বিচারে নয়, তারা হত্যা করছে যৌনাচারের তাড়নায় পশুত্বের চরম নিম্নতায় নেমে এসে।

শিশুরা প্রত্যেকে স্বর্গোদ্যানের এক একটি কুসুমিত ফুল। তারা সুন্দর, নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ। তারা সবাই বিশাল সম্ভাবনাময় অমিত প্রতিশ্রুতিবান। তারা আমাদের প্রজন্ম, আমাদের উত্তরসূরি, আমাদের ভবিষ্যৎ। প্রতিটি শিশুকে পরিপূর্ণ বিকশিত হওয়ার সুস্থ পরিবেশ আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনো ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে, প্রতিটি পিতা-মাতাকে, প্রতিটি নাগরিককে এর পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। এ দায়িত্ব বিধাতা প্রদত্ত, প্রতিটি মানুষের জন্য। শিশুর অযত্নে, অবহেলায়, দায়ী যে-ই হোক না কেন, তাকে আইনের কঠিন আওতায় এনে চরম শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি শিশুই দেবশিশু। তারা স্বর্গ হতে প্রেরিত। বিধাতার পবিত্র দান। প্রতিটি শিশুর জীবন পরিপূর্ণতা লাভ করে বিকশিত হোক উদ্ভাসিত হোক। যারা পথে কাঁটা বিছায়, পথ রুদ্ধ করে, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তারা দুর্বৃৃত্ত, তারা পাপিষ্ঠ। তাদের বিরুদ্ধেই সুকান্তের প্রতিবাদ ও অঙ্গীকার— ‘এ পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করে যাব আমি’ দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারিত। বাংলার আকাশে বাতাসে সুকান্তের অঙ্গীকার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হোক সবার কণ্ঠে। মুক্তিযুদ্ধে একটি গান ছিল— একটি ফুলকে বাঁচাব বলে মোরা যুদ্ধ করি। দেশের প্রতিটি শিশু এক একটি কুসুমিত ফুল। তাদের বাঁচাতে হবে। প্রয়োজনে জাতিকে তার জন্য যুদ্ধ করতে হবে, যেমন করেছিল ১৯৭১-এ।

     লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।

সর্বশেষ খবর