সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

শিক্ষার সর্ব অঙ্গে ব্যথা

তুষার কণা খোন্দকার

শিক্ষার সর্ব অঙ্গে ব্যথা

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে প্রায় প্রতি বছর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হাতে সময়মতো পাঠ্যবই পৌঁছে দিয়ে যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছিল। ছাত্রছাত্রীদের হাতে সময়মতো পাঠ্যবই পৌঁছানোর সাফল্য নিয়ে সরকার গর্ব করেছে এবং যৌক্তিক কারণে সরকারের গর্ব নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। মানুষ ভেবেছে, বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে কোটি কোটি পাঠ্যবই ঠিকঠাক ছাপিয়ে সময়মতো স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া সহজ কাজ নয়। এমন কঠিন কাজ সরকার প্রতি বছর সঠিক সময়ে সঠিকভাবে করতে পেরেছে বলে আমরা ভেবেছি, দুরূহ একটা কাজে সাফল্য দেখিয়ে সরকার বাহবা দাবি করতেই পারে। কাজেই ভালো কাজের জন্য সরকারকে মানুষ মন খুলে বাহবা দিতে কার্পণ্য করেনি। পরপর কয়েক বছর ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই পৌঁছানোর সাফল্যের গল্প সরকার মাঠেঘাটে জনগণকে বলেছে, জনগণ হাসিমুখে কান ফেলে সেটি শুনেছে। দেশের মানুষ সরকারের প্রশংসা করতে দ্বিধা করেনি কারণ বিএনপি সরকারের আমলে বছর শেষ হয়ে গেলেও স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা হাতে বই না পাওয়ায় মানুষের মধ্যে একটা ক্ষোভ ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার সময়মতো বই ছাপিয়ে সেগুলো ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছে দিয়ে বলতে পারছিল, আমরা বিএনপির চেয়ে ভালো। এ বছর হঠাৎ করেই সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। সরকারের সাফল্যের গায়ে মোটা দাগে কালির দাগ লেগে গেল। সরকারের গায়ে এ বছর যে মাপে কালির দাগ পড়েছে সেটি সময়মতো বই না পৌঁছানোর মতো হালকা বিষয় নয়। দাগটি খুব গভীর এবং ভয়ঙ্কর। কারণ স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের হাতে সময়মতো যে বই তুলে দেওয়া হয়েছে তার বিষয়বস্তু ছাত্রছাত্রীদের মনের সুস্থ বিকাশের অনুকূল নয় বলে শিক্ষাবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিএনপি সরকার সময়মতো বই ছাপতে পারেনি কিংবা ছাত্রছাত্রীদের কাছে বই পৌঁছাতে পারেনি বিষয়ের অর্থ বিএনপি সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু এ বছর সরকারের ব্যর্থতা বই ছাপানো কিংবা ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই পৌঁছানোর মতো সাধারণ লজিস্টিক বিষয় নয়। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু  বিকৃত করেছে। শিক্ষা বিষয়ে বিজ্ঞজনেরা পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন, হেফাজতিদের খুশি করার জন্য শিশুদের পাঠ্যপুস্তকের বিষয় বিকৃত করা হয়েছে। অনেকে বলছেন, আগামী নির্বাচনে কোন ঘরানার ভোট কী কৌশলে টানতে হবে সেই চিন্তা মাথায় রেখে স্কুলের শিশুদের বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। শিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের মতামত সত্য হলে বুঝতে হবে বর্তমান সরকার ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে চাচ্ছে না। তারা বর্তমান সময়ের গোলকধাঁধায় বন্দী হয়ে পড়েছে। ভাবছে, নগদ যা পাও হাত পেতে লও। ভবিষ্যতে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের কথা মুখে বললেও বাস্তবে সরকার সিংহাসন নিষ্কণ্টক রাখার কাজে মজে গেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ার দায়িত্ব মন থেকে ঝেড়ে ফেলে সরকার প্রমাণ করেছে তারা দেশের মধ্যে দৃশ্যমান উন্নতি অর্থাৎ পদ্মা সেতু কিংবা মেট্রোরেল প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে আগ্রহী। কারণ অবকাঠামোর উন্নতি চোখে দেখা যায়, হাতে ছোঁয়া যায়। ভোট চাওয়ার জন্য দৃশ্যমান উন্নতির জরুরত সরকারের কাছে বড় হয়ে গেছে। দৃশ্যমান উন্নতির দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলা যায়, আমাদের ভোট দাও আমরা এমন উন্নতি আরও করব। উন্নত জাতি গঠনের স্বপ্নসাধ ভোটের বাক্সের চিপায় পড়ে পিষ্ট হলেও সরকার সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নয়। বড় কথা উন্নত জাতি গড়ার কাজ সময়সাপেক্ষ। সততা এবং ধৈর্যের সঙ্গে উন্নত জাতি গড়ার ভিত গড়তে হয়। এটি তাত্ক্ষণিক ভোট চাওয়ার জন্য দৃশ্যমান কোনো উদাহরণ নয়। ভোট বাক্সের দিকে নজর দিতে গিয়ে সরকার উন্নত জাতি গঠনের চিন্তা থেকে দূরে সরে কায়েমি কূপমণ্ডূকদের সঙ্গে আপসের পথ বেছে নিয়েছে? সরকার কি ইচ্ছা করে শিশু-কিশোরদের ধর্মান্ধতার পথে ঠেলে দিচ্ছে? কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে অন্ধ আপস করলেই কি সরকার অনন্তকাল গদিতে টিকে থাকতে পারবে? বর্তমান সরকারের ভাব দেখে মনে হচ্ছে গদি রক্ষার তাগিদে তারা জাতির মৌলিক স্বার্থ বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করছে না। আমার প্রশ্ন, আওয়ামী লীগের মতো অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল কি অন্ধ আপসকামিতার ফলাফল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়?  আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো বলেছিলেন, ‘ছোটরা অন্ধকার দেখে ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বড়রা যখন আলোর দিকে তাকাতে ভয় পায় তখন সেটি সত্যি ভয়ঙ্কর।’ আমরা কি এখন তেমন সংকটে পড়িনি? শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকার আলোর দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছে। মুক্তচিন্তার টুঁটি টিপে ধরার মতলবে ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সরকারের তরফ থেকে সেটি খণ্ডন করার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সরকার ভাবছে ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দিলে ধর্মান্ধদের ভোটে আওয়ামী লীগের ভোট বাক্স কানায় কানায় ভরে যাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের জানা উচিত ধর্মান্ধতা দিয়ে মুক্তচিন্তার পথ রুদ্ধ করা যায় না কিংবা ভোটেও জেতা যায় না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের কথা ভেবে দেখুন। ধর্মান্ধতা দিয়ে ভোটে জেতা গেলে পাকিস্তানের কায়েমি শক্তি সত্তরের দশকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ওভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত না। ধর্মান্ধতার জোর দিয়ে যদি মুক্তচিন্তার দরজা বন্ধ করা যেত তাহলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের লড়াই বাধত না আর বাংলাদেশ নামের দেশটার জন্ম হতো না। পাকিস্তান আমলে আমাদের পাঠ্যবইয়ে সবরকম ধর্মান্ধ শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। নজরুলের কবিতায় মহাশ্মশান শব্দটি বদলে লেখা হয়েছিল, ‘সজীব করিব গোরস্থান’। মহাশ্মশানকে গোরস্থান বানিয়ে কি পাকিস্তানকে টেকানো গিয়েছিল? এই সত্য জানার পরেও আমাদের ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তিত কারণ শিক্ষার বড় ভিত্তি শিক্ষক সমাজের যোগ্যতা এবং সততার ওপরে মানুষের আস্থা কমে গেছে। বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজ এখন হরেক পদের ব্যক্তিগত স্বার্থের গ্যাঁড়াকলে আটকে গেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের ব্যক্তিগত ফায়দা লোটার প্রবণতা দেখে শিক্ষকদের ওপর জাতির বিশ্বাসের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে গেছে। সরকারের মনে যাই থাকুক আর পাঠ্যবইয়ে যেনতেন যাই লেখা হোক শিক্ষক সমাজ পাঠ্যবইয়ের বাইরে সুশিক্ষা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মুক্তমনা করে গড়তে পারতেন। কিন্তু বর্তমান শিক্ষক সমাজের কাছে কি এটা আশা করা সম্ভব? প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাস্টারির চাকরি কিনতে নাকি নগদ পাঁচ-দশ লাখ টাকা লাগে, এটা এখন এ দেশের শিশুরাও জানে। দেশের হাইস্কুলগুলোর কমিটিতে থাকা না থাকাকে কেন্দ্র করে খুন-রাহাজানির খবর পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। স্কুল কমিটির পদ-পদবি কতটা লাভজনক হয়ে গেছে যে, ওটি দখল করার জন্য গুণ্ডা বাহিনীও লালায়িত হয়ে পড়েছে। অনুসন্ধিত্সু মানুষ স্কুল কমিটির সদস্যদের লাভের উৎসগুলো তালাশ করে দেখতে পারেন। দেখবেন ওখানেও মাস্টারির পদ বেচাকেনার জমজমাট হাট বসে গেছে। মাস্টাররা টাকা দিয়ে মাস্টারির পদ কিনে মাস্টার হওয়ার পরে কোচিং বাণিজ্য করে চাকরির জন্য বিনিয়োগ করা টাকা সুদে-আসলে অসুল করতে চাইলে তাদের দোষ দেওয়া চলে না।

এবার আসুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতির খতিয়ান নিয়ে দেখি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা স্মরণ করে দেখুন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই দল একে অপরের ওপর হামলে পড়লে একজন ছাত্র খুন হয়ে গেল। এটা কোনো নতুন ঘটনা নয় যে, মানুষ এটা নিয়ে নতুন করে মাথা ঘামাবে। আমি নিজেও খবরটি পড়ে ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির ঐতিহ্যের অংশ বলে মেনে নিয়েছিলাম। সেই ঘটনার জের ধরে পরবর্তী সময়ে যে ঘটনা ঘটল সেটি আমাকে সত্যি হতাশ করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের অন্তর্কোন্দল মেটানোর জন্য আওয়ামী লীগের বর্তমান জেনারেল সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদের চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা প্রাক্তন মেয়র মহিউদ্দিনের বাসায় এক শালিস বৈঠকে বসেছিলেন। প্রাক্তন ছাত্রনেতা এবং বর্তমান আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি হিসেবে তিনি সেটি করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের শালিস বৈঠকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর উপস্থিত ছিলেন বলে পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়েছে, যা আমার মনে খটকার জন্ম দিয়েছে। মহিউদ্দিনের বাসায় শালিস বৈঠকে ভাইস চ্যান্সেলর কি শালিসকারী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, নাকি তিনি ওখানে নালিশকারীদের পক্ষভুক্ত হয়ে উপস্থিত ছিলেন, সে প্রশ্নের জবাব ওবায়দুল কাদেরের কথায় খোলাসা হয়ে গেল। ওবায়দুল কাদের বৈঠকে উপস্থিত ভাইস চ্যান্সেলরকে প্রশ্ন করেছেন, ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারিতে আপনি পক্ষ নেন কেন? ছাত্রলীগ কি আপনাকে ভাইস চ্যান্সেলর বানিয়েছে নাকি তারা আপনাকে ভাইস চ্যান্সেলর পদে ধরে রাখতে পারবে? মন্ত্রীর প্রশ্নের সূত্র ধরে আমার প্রশ্ন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর কি নিজ যোগ্যতায় ভাইস চ্যান্সেলর পদটি অর্জন করেননি? তাহলে কে তাকে দয়া করে অমন মূল্যবান পদটি উপহার দিল? মন্ত্রীর প্রশ্ন এবং ভাইস চ্যান্সেলরের দলীয় আনুগত্যের বহর দেখে একটি পুরনো কথা মনে পড়ল। আশির দশকে মাদার তেরেসা বাংলাদেশ সফরে এসে পিজি হাসপাতালে ডাক্তারদের উদ্দেশে বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনারা কেউ ডাক্তার হননি। ঈশ্বর মানুষের সেবা করার জন্য আপনাদের বেছে নিয়েছেন।’ মহিউদ্দিনের বাসায় শালিস বৈঠকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের নত মস্তক এবং ওবায়দুল কাদেরের শাসানির ধরন দেখে মনে হলো, ভাইস চ্যান্সেলর নিজ যোগ্যতায় ভাইস চ্যান্সেলর হননি। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যখন আওয়ামী লীগের কোনো নেতার বাড়িতে ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে এক কাতারে বসে মন্ত্রীর ধমক শুনে ভাইস চ্যান্সেলর পদে চাকরি করেন তখন তার কাছে জাতি কী আশা করতে পারে। এ বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই তুলে দেওয়ার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বললেন, যারা শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে তারা যেন মাঝে মাঝে গ্রামে গিয়ে শিশুদের দুই-এক বেলা পড়িয়ে আসে। আমি বিশ্বাস করি, দেশের অনেক শিক্ষিত ভালো মানুষ স্বেচ্ছা শিক্ষাদানের ব্রত নিয়ে মাঝে মাঝে গ্রামে যেতে দ্বিধা করবেন না। কিন্তু তাতে কি পরিস্থিতির উন্নতি হবে? ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া শেখানো একটি পদ্ধতিমাফিক নিয়মিত বিষয়। একজন স্বেচ্ছাসেবীর দুই-এক দিনের শিক্ষা দান দিয়ে কি কোটি কোটি শিক্ষার্থীর সুশিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব? শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচকদের তুলাধোনা করে কি সমস্যার সমাধান হবে? বরং সরকার সমালোচনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করে শিক্ষার উন্নতির জন্য ভালো পরামর্শগুলো মেনে নিতে পারে।

     লেখক : কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর