সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন মমতা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন মমতা

তিস্তা চুক্তি সাড়ে পাঁচ বছর পিছিয়ে দেওয়ার পর এবার বঙ্গেশ্বরী মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। বাংলাদেশ ঢাকা বিভাগের রাজবাড়ী জেলার পাংশায় পদ্মার ওপরে একটি বাঁধ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কেন উদ্যোগ নিয়েছেন? ওই সব এলাকার পানি, চাষিদের প্রয়োজন এবং পানীয় জলের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য হাসিনা সরকারের এই উদ্যোগের কথা ইতিমধ্যে ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে আলোচনা হয়েছে। দিল্লি বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে জানানোর পর মমতা দেবী ফোঁস করে উঠেছেন। তার এই ফোঁসের নেপথ্যের কারণ কী?

বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য সে দেশের সরকার, সরকারি দল যে কোনো উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। সে জন্যই তারা সে দেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। তিস্তা চুক্তি ২০১২ সালেই সম্পন্ন করার জন্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সব কাগজপত্র নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন। সেদিনও মমতার আপত্তিতে পাঁচটা বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষকে পানিহীন করে রেখেছেন মমতা ব্যানার্জি। সেই ঘটনার নেপথ্যে ছিল মমতার এক বিশাল ষড়যন্ত্র। আর এবার তার চেয়েও বড় ষড়যন্ত্র হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তার সরাসরি হস্তক্ষেপ। মমতা তার এই আপত্তির কথা এতদিন চুপ করে থেকে নিজেই ফাঁস করে দিয়েছেন। ভারতের কূটনৈতিক মহলেই নয়, প্রাক্তন ৪-৫ জন বিদেশ সচিব, যাদবপুর, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নদী বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছি। রাজবাড়ীর পাংশায় বাঁধ নির্মাণ করলে পশ্চিমবঙ্গের কী কী অসুবিধে হবে। কূটনীতিকরা বলছেন, এটা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। মমতা যুক্তি দেখাচ্ছেন, বাংলাদেশের পাংশায় প্রস্তাবিত বাঁধ এবং জলাধার নির্মাণ করলে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, করিমপুর, মুর্শিদাবাদ ও মালদায় নদীতে ভাঙন দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতারা বলছেন, মনমোহন সিংয়ের আমলে নদীভাঙনের জন্য ভারত সরকার মমতা সরকারকে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা মঞ্জুর করেছিল। সেই টাকায় ভাঙন না আটকে তিনি তৃণমূল ক্লাবগুলোর মধ্যে বিলি করে দিয়েছেন। ঢাকার বক্তব্য— পাংশায় বাঁধ দিলে পদ্মা ও গঙ্গার নাব্য বাড়বে। জমা জল দুই দেশ তাদের প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতে পারবে।

তিনি যে অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেটা ভুলে গিয়ে এমন আচরণ করছেন, যেন তিনিই প্রধানমন্ত্রী এবং তিনিই ভারতবর্ষ। তাই নাম বলতে অনিচ্ছুক একাধিক নদী বিশেষজ্ঞ বলেছেন, মমতা রাজ্যের অভ্যন্তরে যে প্রমোটার রাজ ও চিটকাণ্ডের রাজত্ব কায়েম করেছেন এবং যার ফলে পশ্চিমবঙ্গের ১০ কোটি মানুষ ক্ষুব্ধ, সেই ক্ষোভকে অন্য পথে পরিচালিত করতে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে সংঘাতের দিকে যেতে চাইছেন। তাদের বক্তব্য সব কিছুই তার হাতের বাইরে চলে গেছে। তাই যে কোনো উপায় হোক, তিনি চান বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো না কোনো ব্যাপারে বিরোধ জিইয়ে রাখতে।

 

 

তিনি যে অঙ্ক কষে খবরটি ফাঁস করেছেন, সে ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের সব বিরোধী রাজনৈতিক দল একাট্টা হয়ে বলেছে, আমরা মমতার এই বজ্জাতি আর মেনে নেব না। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালে যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাকে পেছন দিক থেকে ছুরি মেরেছে মমতা। মমতা ভুলে গিয়েছেন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মমতার নাক গলানো কখনই মেনে নেওয়া হবে না। একটি সূত্র থেকে বলা হয়, কেন্দ্রীয় জল বিশেষজ্ঞ এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ এই প্রকল্পের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করতে রাজি নয়। এটা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার। মমতা এই সাহস কোথা থেকে পেলেন? পশ্চিমবঙ্গে তার পুলিশ ও দলের দেওয়া কয়েক লাখ জামায়াত, জেএমবি ও বিএনপি নেতা তাকে সাহস জুগিয়েছে। আর বাংলাদেশের ওইসব লোকের পেছনে আছে ৪৭ সালের পরে উত্তর বিহার থেকে যে সব মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা ’৭১-৭৫ এর পর পশ্চিমবঙ্গে এসে কংগ্রেস বা বামফ্রন্টের আমলে রাজনৈতিক পাত্তা পায়নি। এখন তারা এ রাজ্যে বসবাসই করছে না। মমতার দৌলতে এরা এ দেশের ভোটার পরিচয়পত্র জোগাড় করে ফেলেছে। তারাই এখন এ রাজ্যের ভোটব্যাংক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমান এক বছরের মধ্যে জাতিসংঘে গিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে ফারাক্কার পানি নিয়ে নালিশ জানিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী ওই নালিশের জবাব দেওয়ার জন্য জাতিসংঘে পাঠিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের প্রাক্তন মন্ত্রী বরকত গনি খান চৌধুরীকে। উভয় পক্ষের কথা শুনে জাতিসংঘ সেদিন রায় দিয়েছিল দ্বিপক্ষীয় এই বিষয়টি ঢাকা ও দিল্লি মিটিয়ে নিক। আর ’৯৬ সালে হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তিন মাসের মধ্যে তার পানিসম্পদ মন্ত্রী আবদুর রাজ্জাককে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে পাঠিয়েছিলেন। জ্যোতি বসু বিষয়টি নিয়ে বরকত গনি খান চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি রাজ্জাক সাহেবকে তার মালদহের বাড়িতে বসে কথা দিয়েছিলেন, কংগ্রেস এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি করবে না।

ইন্দিরা গান্ধীর জীবদ্দশায় এবং রাজীব গান্ধী যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাংলাদেশের কোনো সামরিক শাসকের সঙ্গে ভারত কোনো চুক্তি করবে না। সেখানে নির্বাচিত সরকার এলে দ্বিপক্ষীয় সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। হয়েছিলও তাই। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে মালদহে গনি খানের বাড়িতে যেসব আলোচনা হয়েছে তার সাক্ষী আমি নিজে। সেসব রিপোর্টও করেছিলাম। বছর তিনেক আগে ঢাকায় আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বাংলাদেশের প্রবীণ মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আপনি শুধু একাত্তরেই সাহায্য করেননি, ফারাক্কার ব্যাপারেও আমাদের সাহায্য করেছেন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কী করে জানলেন যে রাজ্জাক সাহেবকে নিয়ে আমি মালদহে গিয়েছিলাম। তিনি তখন আমাকে বললেন, রাজ্জাক ফিরে এসে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিষয়টি রিপোর্ট করেছিলেন। এটা তো ইতিহাস। ভাগ্যিস তখন বঙ্গেশ্ব্বরীর রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়নি।

তিনি এখন যুক্তি দেখাচ্ছেন, নদীয়ার করিমপুর এবং মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি এলাকায় আকাশ ভেঙে পড়বে যদি পাংশার বাঁধ দেওয়া হয়। তার এই যুক্তির যথার্থতা একেবারেই নেই। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা মমতার পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আর তিনি বোঝার চেষ্টাও করেন না। সে বিদ্যা-বুদ্ধিও তার নেই। ধুুম করে খবরের আলোয় আসার জন্য তিনি একটা কিছু করে বসেন। তিনি ভুলে যান, তিনি একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মাত্র। তাই তিনি বিরোধ বাধিয়ে উভয় দেশের সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারেন। তারপর তিনি কতদূর যাবেন? জামায়াত, জেএমবিরা তার ওপর যতই চাপ সৃষ্টি করুক, উভয় দেশের সম্পর্ক তার অঙ্গুলি হেলনে চলবে না। চলবে কূটনৈতিক পরিভাষায়। এ মাসের শুরুতে কলকাতায় আমার সঙ্গে এক মন্ত্রীর দেখা হয়েছিল। তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আওয়ামী লীগ এবং হাসিনা যদি ক্ষমতায় না থাকে, তাহলে মমতা বা পশ্চিমবঙ্গের কী লাভ? আমি তাকে সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেছিলাম, আপনারাই ভেবে দেখুন। গত ২০ জানুয়ারি কলকাতায় এসেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকেই জিজ্ঞেস করলেন তিস্তা চুক্তি এখন কোথায় কীভাবে আছে? তখন তিনি বললেন, আমি ঢাকা যাওয়ার আগে বিজেপির লালকৃষ্ণ আদভানি, সুষমা স্বরাজ ও অরুণ জেটলির সঙ্গে আলোচনা করে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে তাদের রিপোর্টও করেছিলাম। কিন্তু কারও কারও জেদের জন্য বাংলাদেশকে আমরা কাছে টেনে নিতে পারিনি। কংগ্রেস দল বরাবরই বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ এবং হাসিনাকে পাশে চায়। সেটা বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জানেন।

বাংলাদেশের রাজবাড়ীর পাংশায় প্রস্তাবিত বাঁধটি দিলে পশ্চিমবঙ্গে যে বিশেষ ক্ষতি হবে না, সে কথা বিশেষজ্ঞরাই বলছেন। তাহলে কি মমতা সুসম্পর্ক রাখতে চান বাংলাদেশের বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে? পাংশায় বাংলাদেশের বাঁধ দেওয়া একান্তই তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এই ব্যাপারে কোনো অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। বিদেশনীতি এক দেশের সঙ্গে অপর দেশের। কোনো অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে নয়। সৌজন্য ও সহযোগিতা সম্পূর্ণ ভারতের ব্যাপার, অঙ্গরাজ্যের নয়। এখন প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে মমতা দেবী হঠাৎ কেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরের প্রতিটি বিষয়ে নাক গলাতে চাইছেন? দিল্লি এ ব্যাপারে কী ভাবছে, তা জানা না গেলেও ভারতের বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল মনে করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যে সম্পর্ক চিড় ধরেছে তা সফল করতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে।

পাংশা নিয়ে মমতা যদি কোনো ইস্যু করতে চান এবং নিজের মিডিয়াগুলোকে দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেন, তার যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঢাকায় দেখা দেবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিজেপির গেরুয়া অংশটি তলে তলে মমতাকে সমর্থন করছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। তাই দিল্লির উচিত হবে, আর কালবিলম্ব না করে তিস্তাসহ উভয় দেশের মধ্যে নদী সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলা। তা তারা কতটা করবেন, তা জানা না গেলেও বেশি দেরি করা যে উচিত হবে না তা অনেকেই বলছেন।  লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর