মঙ্গলবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
স্মরণ

সেলিম ও দেলোয়ারের আত্মদান

শফী আহমেদ

সেলিম ও দেলোয়ারের আত্মদান

আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮৪ সালের এই দিনটি ছিল এ দেশের ছাত্রসমাজের জন্য এক দুঃখজনক অধ্যায়। সেদিনও ফাগুনে আগুন ঝরেছিল। কেন জানি না বসন্তের আবহাওয়া ছিল সেদিন গুমোট বাঁধা। আকাশে মেঘ জমেনি। কুয়াশাও ছিল না। বসন্তের স্নিগ্ধতাও ছিল না। দিনের শুরুতেই মনে হয়েছিল আজ কিছু একটা অকল্যাণ হবে। তখন দেশে ছিল সামরিক শাসন। বিকালে ছিল ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের মিছিলের কর্মসূচি। শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্যপরিষদ আহূত ধর্মঘট সফল করার লক্ষ্যে কর্মসূচি পালনের প্রথা অনুযায়ী প্রত্যেক হল থেকে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত সব ছাত্র-সংগঠনের পৃথক পৃথক মিছিল বিকাল ৪টার মধ্যে মধুর কেন্টিন এবং তত্সংলগ্ন অঞ্চলে পৃথক পৃথক সমবেত হয়। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ মধুর কেন্টিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেন, সমাবেশকে উজ্জীবিত করেন। অতঃপর মূল মিছিল শুরু হয়। সেদিনের কথা মনে হলে আজও আমার গা শিউরে ওঠে। সেদিন কেন জানি আমার মিছিলে যেতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা, মিছিলে না গেলে কী হয়? আমি আমার কয়েকজন বন্ধুকে আমার মনের অবস্থা খুলে বলেছিলাম। কিন্তু তারাও আমাকে অনুরোধ করল- যা হয় হবে, মিছিলে থাক। ডান-বাম খেয়াল রাখ। মধুর কেন্টিনের পাশেই ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের মাঠে আমাদের জমায়েত ছিল, সেই জমায়েতে কর্মীদের উজ্জীবিত করার জন্য বক্তব্য দিলাম— যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করতে হবে। তারপর খণ্ড খণ্ড মিছিল মধুর কেন্টিনের সামনে সমবেত হলো। নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখলেন। কর্মীদের আরও চাঙ্গা করার জন্য কবি মোহন রায়হান আবৃত্তি করলেন এক বিপ্লবী কবিতা— ‘আমাদের মৃত্যুর জন্য আজ কোনো পরিতাপ নেই, আমাদের জন্মের জন্য আজ কোনো ভালোবাসা নেই, আমাদের ধ্বংসের জন্য আজ কোনো প্রতিকার নেই, আমাদের সবকিছু আজ শুধু ছলনার, ব্যর্থতার ক্লেদ নিয়ে আসে। আজকে এখানে একজন শিক্ষক জন্মাক, আজকে এখানে একজন বুদ্ধিজীবী থাক, আজ নবজন্ম হোক এ দেশের লেখক-কবির আর তারা অন্ধকারে ঝলসিত আগ্নেয়াস্ত্রের মতো হোক স্পর্ধিত; স্পর্ধিত হোক আজ তারা স্পর্ধিত হোক।’ 

মিছিলটি শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে দিয়ে রোকেয়া হল পেরিয়ে টিএসসি হয়ে, কার্জন হলের দিকে এগোতে থাকে। মিছিলের সামনে ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের নেতা, ডাকসু ভিপি আক্তারুজ্জামান, খন্দকার মোহাম্মদ ফারুক, মুনির উদ্দীন আহমেদ, ফজলে হোসেন বাদশা, আনোয়ারুল হক, আবদুল মান্নান, শিরীন আখতার, মোস্তাক হোসেন, মুকুল বোস, জাহাঙ্গীর কবির নানক প্রমুখ। মিছিলটি কার্জন হল পার হয়ে ফুলবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। দাঙ্গা পুলিশ মিছিলের সামনে ও পেছনে অবস্থান নেয়। এ যেন মিছিল নয়, পুলিশি ঘেরাওয়ের মধ্যে জেলখানা। তার পেছনেই ছিল পুলিশের পুলিশবিহীন ট্রাক। আমরা ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি কী ঘটতে যাচ্ছে আমাদের ভাগ্যে! মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে, আকস্মিক পুলিশের পুলিশবিহীন ট্রাকটি মিছিলের মধ্যে উঠিয়ে দেওয়া হলো খুনি জান্তার নির্দেশে। ঘটনাস্থলে শহীদ হলেন ছাত্রলীগ নেতা ইব্রাহীম সেলিম ও দেলোয়ার হোসেন। চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্র-কর্মী। সে এক নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ! সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র অর্জনের লড়াইয়ের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করল, নির্বিচারে লাঠিচার্জ করল, কে নেতা কে কর্মী সেই লাঠিচার্জে কোনো বাছ-বিচার ছিল না। ইব্রাহীম সেলিম ও দেলোয়ারের লাশ পুলিশ ছিনিয়ে নিয়ে গেল ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। তারপরের ইতিহাস আরও নিষ্ঠুর-নির্মম। সেই লাশগুলো তাদের গ্রামের বাড়িতে পুলিশ পাহারায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো এবং দাফন করা হলো। আজ সেলিম-দেলোয়ারের শহীদ হওয়ার দিনে তাদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। সেলিম-দেলোয়ারের আত্মদান সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর থেকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অপ্রতিরোধ্য গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আমাদের হারাতে হয়েছে বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীকে। সেলিম  দেলোয়ারসহ অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্র বার বার মুখ থুবড়ে পড়েছে অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্রে। তবুও গণতান্ত্রিক ধারা এগিয়ে চলেছে, তার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে তৎকালীন ১৫-দলীয় ঐক্যজোটের নেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের ধারা। এই উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করতে ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি ও তাদের সহযোগীরা নানারকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। আমাদের অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের ভিতরে-বাইরে শত্রু। যে মহান লক্ষ্য নিয়ে আমরা এ দেশ স্বাধীন করেছিলাম, স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রের অভিযাত্রার সূচনা ঘটিয়েছিলাম, অব্যাহত থাকুক সেই অভিযাত্রা। আমাদের মনে রাখতে হবে গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত হলে জাতিকে অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। আর যদি ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তির অপতত্পরতাকে এখানেই থামিয়ে দেওয়া না যায় তবে বড় বিপদ অপেক্ষায় আছে। আমরা তা হতে দিতে পারি না। আজ সেলিম-দেলোয়ারের মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রত্যেকের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, মৌলবাদী শক্তি ও যারা সমাজকে দুর্নীতির দিকে ধাবিত করছে তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাই। রক্তের আখরে লেখা ইব্রাহীম সেলিম ও দেলোয়ারের আত্মদান আমাদের পথ দেখাক।

লেখক : স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা, আওয়ামী লীগ নেতা।

সর্বশেষ খবর