রবিবার, ৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

ড. আহমদ শরীফ ও তার বিবেকী বোধ

ড. পৃথ্বিলা নাজনীন নীলিমা

ড. আহমদ শরীফ ও তার বিবেকী বোধ

বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ড. আহমদ শরীফ ছিলেন একজন প্রধান বিতর্কিত আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তিত্ব। আলোচিত, শ্রদ্ধেয় ও আকর্ষিত ছিলেন সাধারণ শিক্ষিত, বোধশক্তিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী ও সংস্কারমুক্ত বা মুক্তমনাদের কাছে। অপরদিকে কঠোরভাবে সমালোচিত ছিলেন সংস্কারবদ্ধ অবিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মান্ধ, ভীরু, সরকারের দ্বারা লালিত জাতীয় (!) বুদ্ধিজীবী ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের কাছে। তবে   এ কথা সত্য যে, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে অদ্যাবধি পৃথিবীতে এমন কেউ নেই যিনি পুরোমাত্রায় শুদ্ধ, মার্জিত, শিক্ষিত, কিংবা সমালোচনার ঊর্ধ্বে। তাই ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, তেমনি ড. আহমদ শরীফও এর ব্যতিক্রম নয়, তারও গ্রহণযোগ্যতা সমাজের সবার কাছে ছিল না বরং অপছন্দ করত সবচেয়ে বেশি; তাকে যারা জানত বা চিনত তারাও তাকে পছন্দ করত না। কেননা তিনি কোনো রকম ভূমিকা না দিয়ে, মন না জুগিয়ে অকপটে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতেন। এতে তার সামনে যারা থাকতেন বা কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলার জন্য আসতেন, তারা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হতেন।

সব সমাজেই দেখা যায়, মানুষ মাত্রই সচেতন এবং এই সচেতনতা থেকেই তার মধ্যে স্বার্থচেতনা প্রকাশ পেয়ে থাকে এবং এরই বশবর্তী হয়ে মানুষ মনুষ্যত্বকে দমিত করে নিজের সুবিধার জন্য স্ব স্ব স্বার্থ হাসিল করে থাকে। আমাদের সমাজে আর্থ-সামাজিক কাঠামো অনুযায়ী মানুষ শুধু নিজের জন্য সুবিধা পেতে চায়, অন্যের অসুবিধাকে বিবেচনায় আনে না। কিন্তু এ জাতীয় মনোভাব ধারণ করলে একসঙ্গে সহাবস্থান করা যায় না। সহাবস্থানের পূর্বশর্ত হচ্ছে নিজের কিছু স্বার্থ বা সুবিধা ছাড় দিয়ে অন্যকে কিছু সুবিধা দেওয়া।

ড. আহমদ শরীফ, কোনো সময় নিজের জন্য কোনো সুবিধা নেননি, নিতে চাইলে হয়তো নিতে পারতেন। আজীবন তিনি গণমানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তি চেয়েছেন এবং এ লক্ষ্যে তিনি বক্তৃতা ও লেখনীর মাধ্যমে চেষ্টা করে গেছেন। তবে সুবিধা নেওয়ার দৌড়ে কোনো অবস্থায়ই তিনি জাতীয় বুদ্ধিজীবীদের (!) সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারতেন না, কেননা তারা নগদে বিশ্বাসী, তাই ‘নগদজীবী’ (!)

জীবিতকালে তো বটেই এমন কি মৃত্যুর পরেও তিনি ভীষণ সমালোচিত হয়েছেন তার বিশাল সাহিত্যকর্মের জন্য নয়, হয়েছিলেন দেশ-কাল-সমাজ তথা সাধারণ মানুষের কল্যাণার্থে তার চিন্তা, ভাব ও কর্মের জন্য। প্রথাগত বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো বিষয়ে তার কোনো উৎসাহ ছিল না। কেননা, বাংলাদেশের সমাজ মূলত রক্ষণশীল এবং এ গোষ্ঠীই মূলত এ সমাজের চালিকাশক্তি এবং এই গোষ্ঠীই নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আদিম ও অকৃত্রিম সব সামাজিক মূল্যবোধ ধারণ করে সেগুলো জিয়েই রাখার চেষ্টায় প্রতিনিয়ত তৎপর। এই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাত থেকে সমাজকে সময়ের হাত থেকে সামঞ্জস্য রেখে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে হাতে গোনা যে কজন মুক্তমনা ব্যক্তি অবিরাম সংগ্রাম করে গেছেন তাদের মধ্যে ড. আহমদ শরীফ নিঃসন্দেহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ড. আহমদ শরীফের জীবন ঘটনাবহুল এবং বর্ণাঢ্যময়, দেশের যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে যখন কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিবিশেষ কোনোরূপ মন্তব্য করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, তখন আর কেউ নয়, অন্তত ড. আহমদ শরীফ তার লেখনী বা বক্তৃতার মাধ্যমে অবলীলায় দেশ ও মানুষের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। তার ঘটনাবহুল জীবন থেকে নিম্নে কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রকাশ করার প্রয়োজন যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ‘ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি দিবস’ উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবে শিক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত বাংলা ভাষার জন্য  অবৈজ্ঞানিক রোমান হরফ প্রবর্তনের তীব্র বিরোধিতা করা হয়। (দৈনিক ইত্তেফাক, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯)

১৯৬২ সালে সফল শিক্ষা আন্দোলনের পর গঠিত হয়েছিল ‘অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার’ সংক্ষেপে ‘অপূর্ব সংসদ’ বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এই অপূর্ব সংসদই লিখিত আকারে স্বাধীনতার প্রথম ইশতেহার প্রকাশ করেছিল এবং এটি ড. আহমদ শরীফ রচনা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ‘অপূর্ব সংসদের কথা’ শিরোনাম প্রবন্ধে বলেন ‘...১লা অক্টোবর ১৯৬৫-তে আহমদ শরীফ রচিত অপুর তৃতীয় ইস্তেহার : ‘ইতিহাসের ধারায় বাঙালী’ প্রকাশিত হয়। কী কী ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কারণে বাঙালি স্বাধীনতা চায় তা সংক্ষেপে ইশতেহারে লিখিত হয়েছিল। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আরও উল্লেখ করেছেন যে, ড. আহমদ শরীফ ইশতেহারে পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ এবং জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি প্রস্তাব করেছিল...। (প্রথম আলো, ৪ জানুয়ারি ২০০০, বিস্তারিত তথ্যের জন্য দেখুন : আবদুল আজিজ বাগমার রচিত-স্বাধীনতার স্বপ্ন : অর্জন ও উন্মেষ, অক্টোবর ১৯৯৯)

অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমানসহ আঠারো জন বুদ্ধিজীবী সরকারি মাধ্যমে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে যুক্ত বিবৃতি প্রদান করেন। (দৈনিক পাকিস্তান), ২৫ জুন ১৯৬৭)

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ আয়োজিত ‘আবহমান বাংলা’ শীর্ষক এক সেমিনারে ড. আহমদ শরীফ প্রকাশ্যে ‘পূর্ব পাকিস্তান’কে ‘বাংলাদেশ’ নামে পরিচিতি করানোর পক্ষে দৃঢ় যুক্তি ব্যাখ্যা করেন। বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে আয়োজিত এ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন আবুল হাশেম। বক্তব্য রাখেন কবি জাহানারা আরজু, আতাউর রহমান খান, কাজী লতিফা হক প্রমুখ। (সংবাদ, ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯)

পাকিস্তান আমলে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সিংহভাগের ভূমিকা নিয়ে  প্রশ্ন থাকলেও আক্ষরিক অর্থে পাকিস্তান সরকার যে, ‘লেখক সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেছিল লেখকদের বশীভূত রাখার জন্য সেই ‘লেখক সংঘ’-এর সেগুনবাগিচাস্থ নতুন অফিস থেকে ঢাকার লেখকরা ১৯৭১-এর ৫ মার্চ বিকালে এর মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে সমবেত হন। সেখানে সভা শেষে জাগ্রত বাঙালির প্রার্থিত দেশ হিসেবে পূর্ব বাংলা’কে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামের শপথ ও সংগ্রামী জনতার সঙ্গে তাদের একাত্মতা ঘোষণা করেন। এ সমাবেশে লেখকরা হাত তুলে শপথ নেন। সভায় ড. আহমদ শরীফ সভাপতিত্ব করেন ও লেখকদের শপথবাক্য পাঠ করান। (রফিকুল ইসলাম : একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন ও বুদ্ধিজীবীরা, সাপ্তাহিক রোববার ১৯ ডিসেম্বর ১৯৮২)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন ড. আহমদ শরীফ সংবাদ সংস্থা এনা’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, চরিত্রের অভাব ছাড়া বাংলাদেশে আর কোনো অভাব নেই। (২৩ জুলাই ১৯৭৩)

বাংলাদেশ লেখক শিবিরের দুই দিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘লেখকের সামাজিক দায়িত্ব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ পড়েন ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও অধ্যাপক শওকত আলী। সভাপতির ভাষণে ড. আহমদ শরীফ বলেন, আমাদের তিন শ্রেণির বুদ্ধিজীবী আছেন। সরকার ঘেঁষা, সরকারভীরু এবং সরকারবিরোধী। (দৈনিক বাংলা, ৭ জুন ১৯৭৭)

কমরেড মাও সে তুংয়ের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত জনসভায় ড. আহমদ শরীফ বলেন, মুক্তির একমাত্র পথ সমাজতন্ত্র। (ভোরের কাগজ, ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩)

বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে বাংলাদেশ লেখক শিবিরের অষ্টম দ্বিবার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধনকালে শিক্ষাবিদ ড. আহমদ শরীফ চাটুকার ও তোষামোদকারীদের হাত থেকে বাঙালির আজন্ম লালিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সত্য ও অপ্রিয় কথা কাউকে না কাউকে বলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আয়োজনের, জ্ঞানের সঙ্গে সাহসের এবং শক্তির সঙ্গে সদিচ্ছার সম্মিলন ঘটলে মানুষের অসাধ্য আর কিছুই থাকে না। (আজকের কাগজ, ৮ অক্টোবর ১৯৯৩)

উপসংহারে বলা যায়, তিনি যেহেতু কোনো সরকারি মন্ত্রী, আমলা বা গণমাধ্যমে কিংবা অভিজাত প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রাখেননি বলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলেন না, তাই তার বিশাল গ্রন্থরাজির সঙ্গে কারও পরিচিতি ঘটেনি, সবই অপঠিত রয়েছে, আজ শারীরিকভাবে তিনি আমাদের মাঝে নেই। তারপরেও তার রচিত এবং প্রকাশিত সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ইতিহাস ও দর্শনের ওপর লেখাগুলো আগামীতে মুক্তচিন্তা বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের বিবেককে উজ্জীবিত ও চালিত করতে সহায়ক হবে।

লেখক :  অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর