সোমবার, ৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

মিয়ানমারের ওপর জাতিসংঘের চাপ বাড়াতে হবে

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

মিয়ানমারের ওপর জাতিসংঘের চাপ বাড়াতে হবে

২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হওয়া একটা খবরে দেখলাম জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংঘি লি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন শেষে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের প্রমাণ রয়েছে। কিছু দিন আগে আরেকটি বক্তব্যে ইয়াংঘি বলেছেন, সম্প্রতি সেনাবাহিনীর হাতে প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গা নিহত এবং ৬৫ হাজার মানুষ ভিটাবাড়ি থেকে উত্খাত হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে একটা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে নিধনযজ্ঞ ও গণহত্যা চালাচ্ছে, যা বন্ধ করার জন্য এতদিন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। নিরুপায় রোহিঙ্গা নারীরা স্বামী-সন্তান হারিয়ে বিলাপ করছেন আর বলছেন, নিত্যদিনের নির্যাতনের চেয়ে বোমা ফেলে তাদের একদিনে মেরে ফেললে সব জ্বালা-যন্ত্রণা নিভে যাবে। কাউকে আর কিছু করতে হবে না। নির্যাতনের চরম সীমা লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের বসতি এলাকা ঘেরাও করে, সব আন্তর্জাতিক সাহায্যকর্মী ও সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা দিয়ে একনাগাড়ে প্রায় চার মাস অপারেশন চালায় সেনাবাহিনী। জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বের মানুষ সব জেনেও কিছুই করতে পারেনি, সেখানে ত্রাণ সাহায্য পর্যন্ত পাঠাতে পারেনি। একবিংশ শতাব্দীতে মানবজাতির এমন অসহায়ত্ব মেনে নেওয়া যায় না। তাই অসহায়-নিপীড়িত মানুষকে বাঁচানোর জন্য অনবরত প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে এই বর্বরতার প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে, থেমে যাওয়ার সুযোগ নেই।

দেরিতে হলেও জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংঘির বক্তব্যকে স্বাগত জানাই। তবে তার এই বক্তব্য রোহিঙ্গাদের রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট নয়। সাদামাটা গতানুগতিক বক্তব্য সমস্যা সমাধানের জন্য যা করণীয় তার তুলনায় কিছুই না। জাতিসংঘের মহাসচিবের পক্ষ থেকে জোরালো কোনো বক্তব্য এ পর্যন্ত শোনা যায়নি। এই সংকট নতুন কোনো ঘটনা নয়। সুপরিকল্পিতভাবে শুরু হওয়া এই গণহত্যা ও উত্খাতের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭৮ সালে, যখন মিয়ানমার সেনাবাহিনী কোনো রকম উসকানি ও প্রেক্ষাপট ব্যতিরেকে নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান চালায়। নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অকস্মাৎ এমন সামরিক অভিযান বিশ্বে একমাত্র হিটলার ছাড়া আর কেউ করেনি। জাতিগতভাবে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রায় ১০ লাখেরও কিছু বেশি মানুষের বসতি ছিল এক সময়ে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে, যার পূর্ব নাম আরাকান। এরা ধর্মীয়ভাবে মুসলমান। এক সময় ১০ লাখের বেশি থাকলেও এখন তার সঠিক সংখ্যা কত তা নির্দিষ্টভাবে বলা না গেলেও এ কথা বলা যায় অর্ধেকও নেই। যারা নেই তাদের বড় অংশ, প্রায় পাঁচ লাখের আশ্রয় হয়েছে কক্সবাজারের ঝোপজঙ্গল এবং দুর্গম পাহাড়ের খাদের মধ্যে। উন্নত ও নিরাপদ জীবনের আশায় মালয়েশিয়া অথবা অস্ট্রেলিয়ায় গমনের যাত্রাপথে অনেকের সলিল সমাধি ঘটেছে গহিন জঙ্গলে, আর নয়তো উত্তাল সাগরের মাঝখানে। নিজের জীবন হাতে নিয়ে শত শত বছরের চৌদ্দ পুরুষের ভিটামাটি তারা স্বইচ্ছায় ত্যাগ করেনি, কেউ করে না। জাতিগত নিধন বা এথনিক ক্লেঞ্জিংয়ের কবলে পড়ে রোহিঙ্গারা আজ ভিটামাটি ছাড়া উদ্বাস্তু। যারা এখনো মাটি কামড়ে আছেন তারা প্রতিনিয়ত কেয়ামত দর্শন করছেন। জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা-ধর্ষণ, লুণ্ঠন চলছে। চালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা, সঙ্গে যোগ দিচ্ছে স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একশ্রেণির উগ্রবাদী মানুষ। গৌতম বুদ্ধের অহিংসা পরম ধর্মের বাণী এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ধর্মই এখন অধর্মের বড় হাতিয়ার। মানবতার ঝাণ্ডা বহনকারী পশ্চিমা বিশ্ব প্রায় চার দশক নীরবতা পালন করার পর ইদানীং উচ্চবাচ্য শুরু করলেও ঝেড়ে কাশছেন না। কেমন যেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি, এরকম একটা ভাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিশ্বাসযোগ্য স্বাধীন তদন্ত করার কথা বলা হয়েছে। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতসহ পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকজন রাষ্ট্রদূত কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে ওই একইভাবে উদ্বেগ প্রকাশ ও তদন্ত দাবি করেছেন। কোনো কোনো রাষ্ট্রদূত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এতে মিয়ানমার সরকার কিছুটা নড়াচড়া শুরু করেছে। কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার একটা তদন্ত বা পরিস্থিতি মূল্যায়ন কমিটি গঠন করেছে, যার প্রধান করা হয়েছে মিইন্টসিউ নামের একজন জেনারেলকে, যিনি এর আগে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের নেতৃত্ব দেন। সে সময়ের অপকর্মের জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল। তাছাড়া ওই কমিটিতে রোহিঙ্গাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি। সুতরাং ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন কেমন হবে তা এখনই বোঝা যাচ্ছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মিডিয়া সোচ্চার হতে শুরু করে ২০১২ সালে আরেক দফা নিধনযজ্ঞের পর। তখন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একজন নারী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগে আবার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী অভিযানে নামে। সে সময়ের ঘটনার ওপর ব্যাংকক ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনের প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ স্মিথ কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেন। সেগুলো সিএনএন এবং টাইমস ম্যাগাজিনে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। একটি রিপোর্টের সামান্য অংশ এখানে উল্লেখ করছি। ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর। ঘটনাস্থল ছোট গ্রাম ম্রাউকইউ। সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বর্মি সম্প্রদায়ের লোক একসঙ্গে ওই গ্রামে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ৭০ নারী পুরুষ শিশুকে অস্ত্রের মুখে এক জায়গায় তারা জড়ো করে এবং ব্রাশ ফায়ার করে সবাইকে হত্যা করে। তারপর একসঙ্গে গণকবর দেওয়া হয়। ৭০ জনের মধ্যে ২৮ জন ছিল শিশু, যার ভিতর আবার ১৩ জন পাঁচ বছরের নিচের বয়সের। কয়েকজন শিশুকে জ্বলন্ত আগুনের ভিতর নিক্ষেপ করার কথা উল্লেখ করেছেন ম্যাথিউ তার প্রতিবেদনে। এটাকে প্রতিবেদক সেনাবাহিনী ও বর্মি সন্ত্রাসীদের ঠাণ্ডা মাথার গণহত্যা বলে অভিহিত করেছেন। ওই সময়ে আল জাজিরা টেলিভিশন গোপনে ধারণকৃত কয়েকটি প্রতিবেদন প্রচার করে। তাতে রোহিঙ্গা নারীদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনাসহ সবচেয়ে অমানবিক ঘটনা দেখা যায় ৪০টি কনসেল্ট্রেশন ক্যাম্পের দৃশ্যে, সেখানে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে উত্খাত করে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এগুলো গত চার দশক ধরে চলে আসা নির্যাতনের সামান্য কিছু প্রতীকী বর্ণনা। তবে সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে আলো দেখার মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। সপ্তাহ দুই আগে বাংলাদেশ সফরে এসে নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বের্গে ব্রেন্দি বলেছেন, রাখাইন রাজ্য ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও চাপ বৃদ্ধি করা উচিত। কিছুদিন আগে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মুখ থেকে নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনী শুনে গেছেন। সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য ও সময়োচিত আহ্বান জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রেজাক। তিনি বলেছেন, আমরা চোখ-মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারি না। তাদের রক্ষা করতে হবে শুধু এই জন্য নয় যে তারা মুসলমান, এই জন্য যে তারাও মানুষ। তিনি জাতিসংঘকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ছেন এবং বলেছেন, বিশ্ব সমাজ বসে বসে গণহত্যা দেখতে পারে না। জানুয়ারি মাসে কুয়ালালামপুরে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ১০ দফা ইশতেহার প্রকাশসহ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এই সংগঠনটি সত্যিকার অর্থে কার্যকর হলে বিশ্বের পথেপ্রান্তে মুসলমানদের এত নিগ্রহের সম্মুখীন হতে হতো না। ৫৭টি দেশের সংগঠন ওআইসি সৃষ্টির পর থেকে ঠুঁটো জগন্নাথ এবং মাকাল ফলের পরিচয় দিয়ে আসছে। মুসলিম বিশ্ব আজ ছিন্নবিচ্ছিন্ন, লাখ লাখ মানুষ নারী শিশুসহ ঘরবাড়িছাড়া। প্রতিদিন আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করছে। এসব দেখে শুনে ওআইসি সটান হয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব বন্ধ এবং সব অন্ধত্বের পথ ত্যাগ করে মুসলিম শাসকরা যদি পশ্চিমা বিশ্বের লেজুড়বৃত্তি ছাড়তে পারে তাহলে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধ হবে এবং মিয়ানমারসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন বন্ধে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একের পর এক যেভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে তার কোনো প্রতিবাদ মুসলিম বিশ্বের নেতাদের মুখে শোনা যায় না। ওআইসির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য নেই অথবা কী করা যায় তা নিয়ে কোনো বৈঠক বা আলোচনাও নেই। কুয়ালালামপুরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠককে ফলপ্রসূ করতে হলে ওআইসির পক্ষ থেকে জাতিসংঘের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘ মহাসচিবকে আহ্বান জানাতে হবে যাতে তিনি জরুরি ভিত্তিতে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে এবং বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের দুর্দশা সচক্ষে দেখতে আসেন। একই সঙ্গে স্থায়ী সমাধানের পথের সন্ধান ও সুপারিশের জন্য বিশেষ কমিশন গঠন এবং মিয়ানমার সরকারের ওপর জাতিসংঘের অব্যাহত চাপ বজায় রাখতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

নিউ অরলিনস, ইউএসএ

সর্বশেষ খবর