মঙ্গলবার, ৭ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুনিয়ার সেরা দিন ৭ মার্চ

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

দুনিয়ার সেরা দিন ৭ মার্চ

৭ মার্চ বাঙালি জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। ৭ মার্চ আমাদের স্বাধীনতার সূচনার দিন। ১৯৭১-এর আগে ৭ মার্চ দিনপঞ্জি বা ক্যালেন্ডারের পাতায় অন্য দিনের মতো নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু ’৭১-এর ৭ মার্চ পৃথিবীর ইতিহাসে আলাদা এক মর্যাদা, এক মহিমা পায়। এ মর্যাদা যতকাল বাংলাদেশ থাকবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা থাকবে, ততকাল পৃথিবীর ইতিহাসে দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অন্যান্য জাতির বরণীয় স্মরণীয় দিনগুলো যেভাবে বিশ্ব বিবেচনা করে তার চেয়ে কোনো অংশে ৭ মার্চকে ছোট করে দেখা যাবে না। শাশ্বত বাঙালি হিসেবে আমরা যদি নিজেদের ধ্বংস না করি, নিন্দিত এবং নিকৃষ্ট না করি, আমাদের মানসম্মান, প্রতিপত্তি হবে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্ঘ হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘারও ওপরে। আর যদি আমরা হানাহানি, কাটাকাটি, ভোট চুরি করে মর্যাদা নষ্ট করি তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব জানি না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যিনি বাংলাদেশের পিতা, শেরেবাংলার যুক্তফ্রন্টের প্রথম মন্ত্রিসভায় বিতর্কিত বলে স্থান হয়নি। সেই ’৫৪-৫৫-এ বিতর্কিত মানুষটি সারা জাতিকে একত্রিত করেছিলেন তার ত্যাগ-তিতিক্ষা, মেধা ও সাহসের কারণে। ’৫৯ সালে পাকিস্তানে সর্বজনীন নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছিলেন। কত সংগ্রাম, কত ত্যাগ, ’৬২-তে শেরেবাংলার মৃত্যু, ’৬৩-তে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাঙালি জাতিকে কাঙাল করে চলে যান। একা হয়ে গিয়ে শেখ মুজিব ছয় দফা দেন। পাকিস্তানের নেতারা তো ছয় দফা প্রত্যাখ্যান করেছিলেনই, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারাও কেউ কেউ ছয় দফা সমর্থন করেননি। জেলে জেলে তার দিন কাটতে থাকে। ’৬৮ সালের জানুয়ারিতে আগরতলা মামলার এক নম্বর আসামি করা হয়। আইয়ুব-মোনায়েম প্রায় ধরেই নিয়েছিলেন শেখ মুজিবকে আর বাঁচতে দেবেন না। তাকে এবার ফাঁসিতে ঝোলাবেনই। মানুষ ভাবে এক আল্লাহ করেন আর এক। দেশের মানুষ গর্জে ওঠে। কত নির্যাতন, কারফিউ কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। ’৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান নতিস্বীকার করে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ সবাইকে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিলের আহ্বান করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষে তোফায়েল আহমেদ টুঙ্গিপাড়ার শেখ লুত্ফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আইয়ুবের গোলটেবিল বাঙালির নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ব্যর্থ হয়। ক্ষমতায় আসেন ইয়াহিয়া। তিনি ঘোষণা করেন, রাজনীতির প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাবেন। তার কথা বিশ্বাস করে অনেকে আবার আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু সব আশায় গুড়েবালি। পৃথিবীর ইতিহাসে ইয়াহিয়া খানই হন এক মারাত্মক নরঘাতক। তিনি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না করলেও রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। ’৭০-এর ১ জানুয়ারি রাজনীতির দরজা খুলে যায়। মানুষ আবার রাস্তায় নামে। প্রথম অক্টোবরের পরে আবার ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচন পিছিয়ে দেন। নির্বাচনের আগে আগে উপকূলীয় এলাকায় মারাত্মক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে ১০-১২ লাখ মানুষ এবং তার চেয়েও বেশি গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি মারা যায়। এমন প্রলয় বাঙালি কখনো দেখেনি। ইয়াহিয়া পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে চীন সফর করে ঢাকার ওপর দিয়ে উড়ে যান। কিন্তু বিমানে বসেও দুর্গত এলাকায় চোখ ফেরাননি। ইয়াহিয়ার এমন নির্দয় অবহেলা বাঙালিদের আরও উতালা করে তোলে। যার পরিণতি ’৭০-এর ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন। পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯ আসনের ১৬৭টিতে বঙ্গবন্ধু জয়ী হন। আসনের দিক থেকে ৯৮-সাড়ে ৯৮ শতাংশ হলেও ভোটের দিক থেকে তেমন ছিল না। ২৫-৩০ শতাংশ ভোট আওয়ামী লীগের বাইরে যায়। কিন্তু সেই ভোটে কেউ কোনো আসনে জয়ী হননি। এর মূল কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং হুজুর মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছাড়া আর কোনো দলের তেমন কোনো গণভিত ছিল না। নির্বাচনের আগে একসময় হুজুর এবং তার দল নির্বাচন থেকে সরে যেতে থাকেন। ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো, পূর্ব বাংলা কায়েম করো। ভোট ভোট করে যারা, ইয়াহিয়ার দালাল তারা’— এ রকম স্লোগান দিয়ে হুজুরের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি মাঠ গরম করতে থাকে। মুখে তারা যাই বলুন, নির্বাচন যত কাছে আসে তারা তাদের কর্মকাণ্ড ততই কমিয়ে আনেন। আগে না বুঝলেও স্বাধীনতার পরে বুঝেছি, এসবই ছিল গুরু-শিষ্যের কৌশল।

হুজুর মওলানা ভাসানী যদি জোর দিয়ে নির্বাচন করতেন তাহলে আরও ৫-১০ শতাংশ ভোট বাইরে যেত। তাতে ওই ধরনের নির্দেশাত্মক ফলাফল হতো না। ১৬৭-র জায়গায় বঙ্গবন্ধুর দল যদি ১৪৫ সিট পেত পাকিস্তানিরা তাদের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখতে সবার সঙ্গে আপস-মীমাংসা করে তারাই সরকার গঠন করত। বঙ্গবন্ধু হতেন প্রচণ্ড শক্তিশালী বিরোধী দলের নেতা। ওতে পাকিস্তানিদের কিছু এসে যেত না। যেমন বর্তমান সরকারের এখন তেমন কিছু যায় আসে না। ’৭০-এর নির্বাচনে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছিল। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে সাড়ে ৯৮ শতাংশ সিট পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো সিট পায়নি, উল্লেখযোগ্য ভোটও পায়নি। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান দল পিপিপি পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় শূন্য। এটা ঠিক, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়ায় বঙ্গবন্ধু অবশ্যই পাকিস্তানের প্রধান নেতা। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে কোনো সিট না পাওয়ায় তিনি সমগ্র পাকিস্তানের নেতা— এটা বলায় দুর্বলতা ছিল। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩১ আসনের ৮৩টিতে জয়ী হয়েছিল পিপিপি। জুলফিকার আলী ভুট্টো নিজেকে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা দাবি করতে পারলেও পূর্ব পাকিস্তানের নেতা দাবি করার কোনো সুযোগ ছিল না। পাকিস্তানিদের প্রতি সাধারণ মানুষের সন্দেহ এবং অবিশ্বাস ছিল বহুকাল থেকে। সেটা ’৭০-এর নির্বাচনে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ’৭০-এর আগে রাজনীতিতে মানুষের সম্পৃক্ততা কতটা শক্তিশালী ছিল বলতে পারব না। কিন্তু নির্বাচনের পর ছাত্র-জনতার সম্পৃক্ততা পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানে অনেক বেশি ছিল। ’৭০-এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই জয় বাংলা ধ্বনি দিতে চাননি। তাদের ভয় ছিল জয় বাংলা স্লোগান দিলে ভোটের ওপর প্রভাব পড়বে। ‘জয় বাংলা জয় হিন্দ, লুঙ্গি খুলে ধুতি পিন্দ’ দুষ্ট লোকের এ সমালোচনা তো ছিলই। কিন্তু ছাত্র-জনতার চাপে সব প্রার্থীকেই জয় বাংলা মাথায় তুলতে হয়েছিল। নির্বাচনের ফলাফলে তারা হন বিস্মিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সব সদস্য নিয়ে ৩ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের সামনে শপথ করেন। ছয় দফা, ১১ দফার সঙ্গে কোনো আপস হবে না। ছয় দফা, ১১ দফা এখন আর আওয়ামী লীগের নয়, ওটা জনতার সম্পত্তি।

ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছিৃেলন। কিন্তু লারকানার নবাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা গোপন বৈঠক করে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু তখন মতিঝিলের হোটেল পূর্বাণীতে এমপিদের নিয়ে সংসদীয় কমিটির সভা করছিলেন। এখনকার মতো তখন এত রেডিও-টিভি ছিল না। রেডিও পাকিস্তান ও পাকিস্তান টিভি চলত সন্ধ্যার পর। একমাত্র রেডিও ছিল ভরসা। ঘোষণা শুনে মানুষ ছুটে যায় হোটেল পূর্বাণীতে। অন্যদিকে স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা ছিল। জানি না আন্দোলনের সমর্থনে পৃথিবীর কোথাও ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়েছে কিনা। কিন্তু সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। লাখো মানুষ বঙ্গবন্ধুর কাছে ছুটে গিয়েছিল, এখন তারা কী করবে? চারদিকে উত্তেজনা। মিছিল মিটিং হরতাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পাকিস্তানের পতাকা পোড়ে, আ স ম আবদুর রব বাংলাদেশের নতুন পতাকা তোলেন। নিজের দেশে সেটা কোনো ব্যাপার নয়। জেনারেলরা পারে, এমনকি ফকির মিসকিনও তুলতে পারে। কিন্তু একটা দেশকে অস্বীকার করে অন্য দেশের পতাকা তোলা সেটাই হলো মারাত্মক ব্যাপার।

দেশ উত্তাল হতে থাকে। সবকিছু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের হাতে এসে যায়। পৃথিবীর কোথাও সরকারের বাইরে একটি নির্বাচিত দলের পেছনে মানুষ এতটা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তা কল্পনার অতীত। অসহযোগ চলতে থাকে। পাকিস্তানি প্রশাসন একেবারেই নিষ্ক্রিয়। রেডিও-টেলিভিশন-টেলিফোন-টেলিগ্রাম-রেল-স্টিমার-ব্যাংক-বীমা সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে চলতে থাকে। দেশের মানুষ ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে। ছোটখাটো ঘটনা কমবেশি ঘটতে থাকে।

৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল। আগে থেকেই প্রচার হচ্ছিল, ঢাকা বেতার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচার করবে। না হলে আরও ২-৪ লাখ বেশি হতো। একসময় বঙ্গবন্ধু সভামঞ্চে এলে জনতা উত্তাল হয়ে ওঠে। এমন জনতা কোনো নেতা দেখেননি, দেশ দেখেনি। তিনি তার স্বভাবজাত ভঙ্গিতে সারা জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন। তিনি বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’ শিল্পপতিদের বললেন, ‘২৮ তারিখে বেতন দিয়ে দেবেন। ব্যাংক বীমা আমাদের হুকুমে চলবে। পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা পাঠানো যাবে না। দেশের ভিতরে খবর আদান-প্রদান করবেন, কিন্তু বাইরে নয়।’ তিনি আরও বললেন, ‘শত্রু বাহিনী ঢুকেছে। তারা লুটতরাজ করবে। হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, নন-বাঙালি তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের। আমাদের যেন কোনো বদনাম না হয়। আরটিসি কল করেছেন। আমাদের দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন, মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সৈন্যবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব আমরা আরটিসিতে যেতে পারি কি পারি না। তার পূর্বে আরটিসিতে যেতে আমরা পারি না। জনগণ সে অধিকার আমাদের দেয় নাই।’ একেবারে শেষে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

আমি ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আলোচনা করছি না। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণ ছিল পৃথিবীর কয়েকটি শ্রেষ্ঠ ভাষণের অন্যতম। এমন কোনো দিক ছিল না যা তাতে ফুটে ওঠেনি। এমনকি তিনি যদি না থাকেন, আর কিছু বলতে না পারেন, আমাদের কী করতে হবে তাও বলেছিলেন। অত সাজানো-গোছানো অলিখিত ভাষণ একজন মানুষ শুধু অন্তর উৎসারিত করেই দিতে পারেন, যা বঙ্গবন্ধু পেরেছিলেন।

যেহেতু ভাষণটি সরাসরি প্রচার করার কথা ছিল। আগেই বলেছি অমন প্রচার করার কথা না থাকলে আরও ২-৪ লাখ লোক বেশি হতো। সবকিছু তৈরি ছিল। মাঝে মাঝেই সভার ঘোষণা রেডিওতে শোনা যাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু এলেই তার ভাষণ শোনানো হবে। শুরুও হয়েছিল। সভার ঘোষণা এবং বঙ্গবন্ধু উত্তাল জনতাকে সালাম জানিয়ে কথা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে রেডিও বন্ধ হয়ে যায়। মাঠে যারা ছিলেন তারা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছিলেন। কিন্তু অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ কোটি কোটি শ্রোতা, তারা সেদিন বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষণা রেডিওতে সরাসরি শুনতে পাননি। ঢাকা রেডিওর কর্মচারী-কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশের সব কটি স্টেশন বন্ধ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার নতিস্বীকার করে। তারা পরদিন সকাল সাড়ে ৮টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচারে রাজি হয়। ৭ মার্চ বিকাল থেকে বন্ধ থাকার পর ৮ মার্চ বার বার ঘোষণা আসে সকাল সাড়ে ৮টায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রিলে করা হবে। তাই হয়। ২২-২৩ মিনিটের ভাষণ সকাল সাড়ে ৮টায় রিলে করা হয়। কোটি কোটি মানুষ সেটা শোনে। এখন অনেকেই বলেন তারা পাকিস্তানেও রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছেন, কথাটা মোটেই ঠিক নয়। পাকিস্তানে ঢাকা কেন্দ্র শোনা যেত না, কোনো উপায়ও ছিল না। এখন কত পণ্ডিত কত কথা বলেন। কারও প্রশ্ন বঙ্গবন্ধু সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। মানে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে করেছেন। এতে তাদের কী? কেউ বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে যুদ্ধও হতো না, অত লোক ক্ষয় হতো না। আমরা সহজেই স্বাধীন হয়ে যেতাম।’ কথা বলতে ট্যাক্সও লাগে না, সেজন্য অনেকে অনেক কথাই বলেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, বাকি কোথায় ছিল আমরা বুঝি না, পণ্ডিতেরা বুঝেছেন। এই তো কয়েক বছর আগে এ কে খন্দকার তার ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’ বইয়ে ও রকম একটা কিছু বলতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যদি বলতেন, এখন থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন; সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওপরে পাকিস্তানি হানাদারদের যে হেলিকপ্টার উড়ছিল, তারা শুধু ট্রিগার টিপত। তাতে লোকজন মারা যেত না? তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে বিমানবাহিনীর সব থেকে বড় কর্মকর্তা। তার তো জানাই ছিল কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে সাতখানা যুদ্ধবিমান বগলে বোমা নিয়ে রানওয়ের পাশে হুকুমের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। তার বইয়ে এক জায়গায় বলেছেন, ঝড়বৃষ্টিতে কী করে যুদ্ধবিমান চালাতে হয় তার প্রশিক্ষণ তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল আজগর খানকে দিয়েছিলেন। সেই তাকে যদি বলা হতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় বোমা ফেলে সব তামা করে দাও। তিনি কী করতেন? তিনি পাকিস্তানি হুকুম মানতেন, নাকি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তার বিমানবহর নিয়ে বাংলাদেশের প্রতি, বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্য জানাতেন? বলা সোজা, করা কঠিন। ৭ মার্চ এবং তার আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রশাসন আওয়ামী লীগের কথা শুনেছে, সংগ্রাম পরিষদের হুকুমে চলেছে তারাও কিন্তু ২৫ মার্চের পর যখন যে জায়গা পাকিস্তানিরা দখল করে নিয়েছে সে জায়গার শতকরা ৯০ ভাগ কর্মকর্তা আগেও ছিলেন পাকিস্তানি, পরেও পাকিস্তানি হয়েছিলেন। ১৯ জেলার পাঁচজন এসপিও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, পাঁচজন ডিসিও করেননি, পাবনার ডিসি নুরুল কাদের ছাড়া। ৪০-৪৫টি মহকুমার ৬-৭টির বেশি মহকুমার অফিসার বা এসডিও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। এর মধ্যে মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী আর এসডিপিও মাহবুবের নাম উল্লেখ করা যায়। সিরাজগঞ্জের এসডিও শামসুদ্দিন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে প্রতিরোধে শরিক হয়েছিলেন। ২৫ মার্চ পর্যন্ত বেশ নাচানাচি করেছিলেন। কিন্তু হানাদাররা নগরবাড়ী পৌঁছার আগেই ভদ্রলোক পাকিস্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। একসময় পাকিস্তানিরা তাকে মেরে ফেলে বলে তাকে নিয়ে আবার নাচানাচি। তিনি আত্মসমর্পণ না করে প্রতিরোধের সময় ধরা পড়ে নিহত হলে আমার কোনো আপত্তি থাকত না। হুমায়ূন আহমেদ ও জাফর ইকবালের বাবা ফয়েজ আহমেদের ব্যাপারও একই রকম। শুরুর দিকে তিনিও দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করেছেন। মিলিটারিরা গেলে কয়েক দিন গ্রামে পালিয়ে থেকে চাকরিতে যোগ দেন। দু-এক দিন পর আর্মিরা জিজ্ঞেস করে ‘হাতিয়ার কা হা, গুলি কাহা?’ উত্তর না পেয়ে আর্মিরা বলে, ‘শালা মুক্তি বনতা, গাদ্দারকা বাচ্চাকো মার ডালো।’ মেরে ফেলে। তিনি শহীদ হয়ে যান। এটা আমার কথা নয়, হুমায়ূন আহমেদের মায়ের লেখা বইয়ের কথা। তাই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিলেই সবকিছু হয়ে যেত ঠিক নয়। জিয়াউর রহমান বীরউত্তম মুক্তিযুদ্ধে এক গৌরবোজ্জ্বল ব্যক্তি। ইপিআরসি ক্যান্টনমেন্টের হাজার দেড়েক রিক্রুটকে পাকিস্তানিরা গুলি করে মেরে না ফেললে, ঢাকার বুকে অমন হত্যাযজ্ঞ না চালালে ২৬ মার্চেও আমাদের সঙ্গে শরিক হতেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতেন এটা জোর দিয়ে বলা যায় না। ইপিআরের মেজর রফিক বলতে গেলে সবার আগে পাকিস্তানের প্রতি বিদ্রোহ করেছিলেন। তাও ১৭-১৮ মার্চের আগে নয়। সফিউল্লাহ, ভদ্রলোক তো ২৮ মার্চ জয়দেবপুর রাজবাড়ী থেকে বেরিয়েছিলেন। তিনি নাকি সেদিন পর্যন্ত হানাদারদের হত্যাযজ্ঞের কথা জানতেন না। এটা আমার কথা নয়, রাষ্ট্রদূত হিসেবে তার ছাপা সাক্ষাৎকারের কথা। যেটি এখনো আমার  কাছে আছে। কার কথা বলব? খালেদ মোশারফ, সাফায়েত জামিল সেনাবাহিনীর মধ্যে যাদের ভূমিকা সব থেকে উজ্জ্বল তাদেরও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং সীমান্ত এলাকায় নকশাল আক্রমণের কথা বলে ২৪ তারিখ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে পাঠানো হয়েছিল। তারা ২৫ তারিখ পাকিস্তানকে অস্বীকার করে তাদের কোম্পানিতে যেসব পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার ছিলেন তাদের বন্দী করে মাটিচাপা দিয়েছিলেন। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলার পরও তো ২৫ মার্চের আগে সেনাবাহিনীর ১০ সদস্যও ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য জানাননি। পণ্ডিতদের কথা শুনলে আমাদের স্বাধীনতা পেতে হতো না। পাকিস্তান আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে লাখ লাখ লোক হত্যা করত। সঙ্গে বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধুকে। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ তখনকার মতো সেখানেই শেষ হয়ে যেত।

লেখক :  রাজনীতিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর