বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

গ্যাস আর গ্যাস্ট্রিক : অসুবিধার সমস্যা নেই

মোস্তফা কামাল

গ্যাস আর গ্যাস্ট্রিক : অসুবিধার সমস্যা নেই

গ্যাসের দাম আবার বাড়ানো হয়েছে তো কী হয়েছে? শিগগির আবার বাড়ানো হবে বিদ্যুতের দামও- সাফ জানিয়েছেন সরকার বাহাদুর। সেই সঙ্গে তারা গ্যারান্টি দিয়ে বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে জনগণের কোনো সমস্যা হবে না। বিরূপ কোনো প্রভাব পড়বে না অর্থনীতিতেও। ব্যাখ্যায় বলেছেন, এলপিজি গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানো ও এলএনজি গ্যাস আমদানি করায় দাম সমন্বয়ের প্রয়োজনে গ্যাসের দাম বাড়াতে হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ায় ব্যবসায়ীদের সমস্যা হবে না।

এ ছাড়া দুই কিস্তিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়টি অত্যন্ত দরদি সিদ্ধান্ত। জনগণের কথা ভেবেই তা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসির চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম। সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি জানান, মানুষের পকেটের ওপর যাতে চাপ না পড়ে সেজন্য গ্যাসের দাম দুই দফায় বাড়ানো হয়েছে। ভোক্তা পর্যায়ে দুই বছরের মাথায় ফের বাড়ানো এ দামের প্রথম ধাপ কার্যকর হবে ১ মার্চ থেকে। দ্বিতীয় ধাপ ১ জুন থেকে। সেই মোতাবেক, ১ মার্চ থেকে আবাসিক খাতে দুই চুলার জন্য ৮০০ এবং এক চুলার জন্য ৭৫০ টাকা গুনতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে ১ জুন থেকে আবাসিক খাতে দুই চুলার জন্য ৯৫০ এবং এক চুলার জন্য দিতে হবে ৯০০ টাকা। আর বাণিজ্যিক ইউনিট মার্চে ১৪.২০ টাকা এবং জুনে ১৭.০৪ টাকা। সিএনজির দাম মার্চে প্রতি ঘনমিটার ৩৮ টাকা ও জুনে ৪০ টাকা করা হয়েছে। বর্তমানে আবাসিকে দুই চুলার জন্য দিতে হয় ৬৫০ ও এক চুলার জন্য ৬০০ টাকা। বর্ধিত এই দাম চলে আসছে ২০১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে। এর আগে দুই চুলার জন্য দিতে হতো ৪৫০ টাকা এক চুলার জন্য ৪০০ টাকা।

দুই দফায় এবং ২২ দশমিক ৭ হারের দাম বৃদ্ধিতে বাহ! আমিন! আমিন, বা মাশাল্লাহ না বলে উপায় কী? নইলে জনমভর কাফফারা দিয়েও বোধ হয় এ কবিরা গুনাহর আজাব শেষ হবে না। ব্যাপারটা তো যেনতেন নয়। দেশের স্বার্থেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে বছরে সরকারের বাড়তি আয় হবে ৪১৮৫ কোটি টাকা। এ টাকা দিয়ে নাকি বাজেটের ঘাটতিও মেটানো হবে। যুক্তির কী নমুনা! আমাদের অঞ্চলে বলা হয়, দাদারে আদা দেওয়া। রিজার্ভ চুরির টাকা ফেরত আনা গেলে, গ্যাস চুরি বন্ধ হলে, হলমার্ক কেলেঙ্কারির টাকা উদ্ধার করলে, ধান্ধাবাজি-চান্দাবাজির ক্ষেত্র কমিয়ে আনলে, ওয়ান-ইলেভেনের পিরিয়ডে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খাবলা মেরে নেওয়া টাকাগুলো ফেরত দিলে কি সরকারের আয় কম হতো? তাতে কি বাজেট ঘাটতি মিটিয়ে আরও উদ্বৃত্ত থাকত না?

গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির মতো বিষয়ে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি মোটামোটি নিশ্চুপ। জনদরদি হয়ে দু-চার কথা বলার শক্তি তারা কবেই হারিয়েছে। দলটির বড় নেতাদের গ্যাস সমস্যা থাকলেও কোনোমতে দম নিতে পারাই তাদের যথেষ্ট। খুচরারা কে কোথায় কীভাবে কোথায় সেই খবর কে রাখে। গ্যাস কেন তারা আলসারও উতরে গেছে। গ্যাসের দাম নিয়ে তোপখানা, পুরানা পল্টন বেল্টে নানান কথা বলে বেড়াচ্ছে সিপিবি-বাসদসহ বামরা। সরকারের বিরুদ্ধে টুকটাক হুঁশিয়ারিও দিচ্ছে। বাম মোর্চার নেতারা বলছেন, সরকার কি ব্যবসা খুলেছে যে আয় খোঁজে? গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকারের আয় হাতানো জনগণ মানবে না। এই মোর্চাদের এমন মোচড়ামোচড়িতে কার কী যায় আসে? জনগণ মানবে না-এ তথ্য দেওয়ার তারা কে? কয়টা জনগণ এ তথ্য দিয়েছে তাদের কাছে? কে শোনে এই ইনফরমারদের কথা? তাদের ওজন এবং দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, ব্যাস-ব্যাসার্ধ সরকারেরও জানা।  তাহলে সমস্যাটা কোথায়? গ্যাস আর গ্যাসট্রিকে অসুবিধার কোনো সমস্যা হয় না। তাতে জেনারেল-ইনজেনারেল কোনো জনগণেরই কিছু আটকে থাকে না। তাদের নাকে-কানে কোথাও সমস্যা নেই। এ কারণে কোনো পণ্যের দাম বাড়ানো-কমানোতে দেশে আজ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। হবেও না ইনশাল্লাহ। তাই গ্যাসের বাড়তি দামে কারও পেটে গ্যাস জমে থাকবে, সেই শঙ্কা না করাই ভালো। কোনো সমস্যাই এ দেশের বীর জনতাকে শেষ পর্যন্ত কাবু করতে পারে না। তারা ভাঙে না, মচকায়ও না। এখন আর কারও উছালে পড়ে শহীদ-গাজীর পথও ধরতে রাজি না তারা। গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়েও তেমনই। জনগণ জোর গলায় আমিন বা শুকুর আলহামদুলিল্লাহ না বললেও এখন পর্যন্ত নাউজুবিল্লাহ বা আস্তাগফিরুল্লাহ কিছিমের কিছুও বলেনি। অর্থাৎ কবুলই করে নিয়েছে তারা। নীরবতা সম্মতিরই লক্ষণ-কথাটা এমনি এমনি আবিষ্কার হয়নি।

অর্থনীতির থিউরিতে কোনো পণ্যের দামের হেরফেরে সংশ্লিষ্ট আরও অনেক কিছুরই দাম বাড়ে-কমে। যেমন তেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় বাস ভাড়াসহ অন্যান্য অনেক কিছুর দাম। কিন্তু দাম কমানোর সুফলও জনগণ পায় না। পায়নি। কিছুদিন আগে তেলের দাম কমিয়েছিল সরকার। তাতে বাস ভাড়া বা অন্য কোনো কিছুর দাম কি কমেছে? উৎপাদন খরচ কমেছে কতটুকু? তাহলে ওই দাম কমানোর রসটা গিলল কে? কে খেল সরটা? অর্থনীতির রীতিনীতি না জানা মানুষও বোঝে, প্রাইভেট সেক্টর বা সাধারণ মানুষের হাতে থাকলে টাকার ঘোরাফেরা স্বাভাবিক থাকে। লেনদেনে থাকে গতিময়তা। কিন্তু রাষ্ট্র বা সরকারের হাতে থাকলে তা থমকে যায়। টাকাগুলো তখন ঘোরাফেরা কম করে। সেই টাকার কিছু ব্যয় হয় উন্নয়নের নামে। আর বিশাল একটা ভাগ যায় ক্ষমতাধরদের কাছে, নয়তো সুইস ব্যাংকে। মোদ্দা কথা সুশাসন, ন্যায়-সাম্য না থাকলে অর্থনীতির নীতিরীতি খাটে না। তখন দাম বাড়ার প্রভাবটা গড়াতে গড়াতে ভোক্তা বা সাধারণ মানুষের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে। আর দাম কমার সুফল ফাঁকেফুকেই থাকে। গ্যাসের দামের ব্যাপারটাও এমনই। হাদারাম পাবলিকেরও তা বোঝা ফাইনাল। তাই কোনো কিছুর দাম বাড়তি-কমতি এখন আর মানুষ গায়ে লাগায় না। গ্যাসের এমন লাফে ‘ফোস্কা’ ফোটা দূরে থাক যেন জ্বালাপোড়াও নেই কারও। দেশে গ্যাসের এত সন্ধান পেয়ে কী লাভ, তা-ও ভাবে না মানুষ।

গ্যাস সেক্টরে চুরিচামারির খবরও কারও একেবারে অজানা নয়। এ ছাড়া আইএমএফের হিসাব মোতাবেক বছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১৪৬৬ ডলার। বাংলা মুদ্রায় ১,১৭,২৮০ টাকা। চাট্টিখানি কথা? এত কামাই রোজগারের মানুষ গ্যাসের বাড়তি কয়েকশ টাকা নিয়ে ভাববে কেন? একটা প্রেস্টিজ আছে না? তাদের কী পেট খারাপ হয়েছে?

ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে শেষ করলে লেখাটা বোধ হয় আর টানতে হবে না।

এক রোগী ডাক্তারকে জানায়, তার পেটে গ্যাসের খুব সমস্যা। তবে, এই গ্যাসে গন্ধ নেই, আওয়াজও হয় না। ডাক্তারের চেম্বারে সিরিয়ালে থাকা অবস্থায়ও তার বারো-চৌদ্দবার গ্যাস বেরিয়েছে। গন্ধ এবং শব্দ না থাকায় কেউ তা টের পায়নি।

ডাক্তার তাকে কিছু ওষুধ দিয়ে এক সপ্তাহ পর আবার দেখা করতে বলেন। এক সপ্তাহ পর ডাক্তারের কাছে গিয়ে রোগী জানায়, তার গ্যাস এখনো আছে। তাতে এখনো আওয়াজ নেই, তবে জঘন্য দুর্গন্ধ বের হয়।

ডাক্তার একটু চিন্তা করে গম্ভীর কণ্ঠে রোগীকে বলেন, চিকিৎসায় অ্যাকশন শুরু হয়েছে। আপনার নাক ঠিক হয়ে গেছে। এখন দরকার আপনার কানের চিকিৎসা।

লেখক  : বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

সর্বশেষ খবর