শুক্রবার, ১০ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

নামাজ ও সামাজিক বন্ধন

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

নামাজ ও সামাজিক বন্ধন

ইসলামে নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। নামাজ ও সামাজিক বন্ধন একটির সঙ্গে অপরটির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মানব সমাজে সভ্যতা, নৈতিকতা ও সামাজিকতার বিকাশ এবং সামাজিক বন্ধন মজবুতির জন্য নামাজের সীমাহীন অবদান রয়েছে।  এ জন্যই জামাতের বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। মানুষ সমষ্টিগতভাবে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করে একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সেখানে ধনী-গরিব উঁচু-নিচুর কোনো ভেদাভেদ নেই। নামাজের পর একে অপরের খোঁজখবর নেয়। কোনো দিন যদি নিয়মিত কোনো মুসল্লি জামাতে শরিক হতে না পারে সবাই তার খোঁজখবর নেন। প্রয়োজনে বাড়িতে গিয়ে তার বিষয়াদি জানতে চান। নামাজের মাধ্যমে পরস্পর মায়া-মহব্বত তৈরি হয় এবং সামাজিক বন্ধন মজবুত হয়। তাই তো তাওহিদ ও রিসালাতের বিষয়ে সাক্ষ্যদানের পর একজন মুসলমানের প্রধানতম কর্তব্য হলো নামাজ আদায় করা। কোনো ব্যক্তি ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে এসে এক কালিমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার পরপরই রসুল (সা.) তাকে নামাজের তালিম দিতেন। এমনকি রসুল (সা.) আরবের বিভিন্ন গোত্রের নামে যেসব বাণী প্রেরণ করেছিলেন তাতে নামাজ মুসলমানদের অবশ্য কর্তব্যরূপে পুনঃ পুনঃ উল্লেখ করেছেন। তিনি নবুয়তের ২৩ বছরে নামাজের প্রতি অধিক তাগিদ করে গেছেন। ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্তে শেষ অসিয়তস্বরূপ নামাজের কথাই উল্লেখ করে বলেছিলেন : নামাজ এবং তোমাদের দাস-দাসীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। (ইবনে মাজাহ) ফরজ ইবাদতসমূহের মধ্যে নামাজ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কারণেই বোখারি শরিফের একটি হাদিসে এসেছে, প্রিয়নবী (সা.) নামাজকে জাকাত, হজ এবং সওম নামক  রুকনের আগে স্থান দিয়ে ইরশাদ করেন : ইসলাম পাঁচটি বুনিয়াদের ওপর স্থাপিত। সেগুলো হলো ‘এ মর্মে সাক্ষ্য দেওয়া, এক. আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই, হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহতায়ালার বান্দা ও রসুল। দুই. নামাজ পাবন্দীর সঙ্গে আদায় করা, তিন. জাকাত দেওয়া, চার. হজ করা পাঁচ. রমজানের রোজা রাখা’। নামাজ ইসলাম ও মুসলমানদের  প্রতীক। একজন মানুষ মুসলিম কি অমুসলিম তা নামাজ দ্বারাই বাহ্যতভাবে চেনা যায়। নামাজ দীনের খুঁটি। খুঁটি ব্যতিরেকে কোনো ইমারত যেমন টিকে থাকতে পারে না ঠিক তেমনিভাবে নামাজ ব্যতিরেকে মানুষের ইমান ও ইসলামও টিকে থাকতে পারে না। হজরত রসুলে আরাবী (সা.) বলেন,‘ ইসলামের খুঁটি হচ্ছে নামাজ, কিয়ামতের দিনে সর্বাগ্রে  নামাজের হিসাবই গ্রহণ করা হবে’। তিনি আরও ইরশাদ করেন : ‘কিয়ামত দিবসে বান্দাদের কাছ থেকে সর্বপ্রথম যে জিনিস সম্পর্কীয় হিসাব গ্রহণ করা হবে সেটি হলো নামাজ’। নামাজের হিসাব যদি ভালো ও মঙ্গলজনক হয় তবে সে সফলতা লাভ করবে। আর যদি মন্দ হয় তবে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। (তিরমিজি) কোনো ব্যক্তির যদি জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ ছুটে যায় তাহলে বুঝতে হবে তার জীবন থেকে অনেক বড় একটি অংশ ছুটে গেছে। হজরত নাওফাল ইবনে মুআবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত যে, প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তির এক ওয়াক্ত নামাজ ছুটে গেল তার যেন পরিবার-পরিজন ও ধনসম্পদ সবকিছু লুণ্ঠিত হয়ে গেল। (তিরমিজি) নামাজ এমন একটি বিধান যা শরিয়তের মাপকাঠি যে বয়স থেকে একজন ব্যক্তির ওপর বর্তায় তখন থেকে সবার সঙ্গে সমানভাবে সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ নারী, পুরুষ, ধনী, নির্ধন, রাজা, প্রজা, আমলা, কর্মচারী, যুবক, বৃদ্ধ, সুস্থ, অসুস্থ-সবার ওপর সমানভাবে ফরজ। এটি এমন ইবাদত যা কোনো ব্যক্তি থেকে সামান্য জ্ঞান থাকা অবস্থায় কোনোভাবেই রহিত হয় না। এ ফরজ পালনে যদি দাঁড়ানোর মতো শক্তি না থাকে তা হলে বসে বসে হলেও আদায় করতে হয়। যদি বসে আদায় করার মতো শক্তিও না থাকে তা হলে শুয়ে হলেও আদায় করতে হয়। কারোর পক্ষে যদি মুখ দ্বারা শব্দ উচ্চারণ করা অসম্ভব হয় তাহলে হাতের ইশারা দ্বারা হলেও নামাজ পড়তে হয়। যাত্রাপথে কোথাও যাত্রাবিরতি দিয়ে নামাজ পড়ার সুযোগ না থাকলে গাড়িতে চলা পথে হলেও নামাজ পড়ে নিতে হয়। যদি ব্যক্তি কোনো সাওয়ারির ওপর থাকে তাহলে সাওয়ারি যেদিকে মুখ করে চলছে সেদিকে ফিরে হলেও নামাজ পড়ে নিতে হয়। এক কথায় কোনো অবস্থাতেই নামাজ মাফ নয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষ মহিলাদের কিছুটা ছাড় রয়েছে বিস্তারিত লেখার এখানে সুযোগ নেই। সব নবীই নিজ নিজ উম্মতকে নামাজের জন্য নির্দেশ ও তাগিদ করে গেছেন। পবিত্র কোরআনে হজরত ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব, লুকমান, মূসা, ঈসা (আ.) প্রমুখ নবী কর্তৃক নিজ নিজ বংশধর ও উম্মতকে নামাজের তাগিদ প্রদানসূচক বহু আয়াতের উল্লেখ পাওয়া যায়। নামাজের মাহাত্ম্য সম্পর্কে পবিত্র হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ বলেন, আমি নামাজকে আমার এবং আমার বান্দার মধ্যে দুভাগে বিভক্ত করে নিয়েছি। এক ভাগ আমার জন্য, অপর ভাগ আমার বান্দার জন্য। আমার বান্দা যা প্রার্থনা করে সে তা লাভ করে। বান্দা যখন বলে ‘সব প্রশংসা আল্লাহতায়ালার প্রাপ্য’ তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল। যখন বান্দা বলে ‘যিনি দয়াময় ও পরম দয়ালু’ আল্লাহ তদুত্তরে বলেন, আমার বান্দা আমার গৌরব ও মহিমা ঘোষণা করল। যখন বান্দা বলে, ‘যিনি বিচার দিবসের প্রভু’ তখন আল্লাহ বলেন : আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল। যখন বান্দা বলে, ‘আমরা শুধু তোমারই এবাদত করি এবং তোমারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি’ তখন আল্লাহ বলেন : এ আয়াত আমার ও আমার বান্দার মধ্যে অর্থাৎ সে যা প্রার্থনা করবে তা-ই সে পাবে। যখন বান্দা বলে, ‘আমাদের সরল পথে পরিচালিত কর যে পথ তোমার অনুগ্রহপ্রাপ্তদের পথ। তোমার ক্রোধপ্রাপ্ত ও পথভ্রষ্টদের পথ নয় অর্থাৎ আপনার ক্রোধপ্রাপ্তদের পথে আমাদের পরিচালিত করবেন না। তখন আল্লাহ বলেন : এটি আমার বান্দার জন্য, সে যা চায় তা সে নিশ্চয় পেয়ে যাবে। (আহমদ, ইবনে মাজাহ) প্রিয় পাঠক : সব নবী ও রসুল নামাজের প্রতি এত বেশি গুরুত্ব কেন দিয়েছেন? এই জন্যই দিয়েছেন নামাজ দ্বারা ব্যক্তি থেকে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে শান্তি আসে। দূর হয় অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা। তৈরি হয় পরস্পর সামাজিক বন্ধন। একটু লক্ষ্য করুন। মানুষের আখলাক ও নৈতিকতার উন্নতি সাধন এবং কুপ্রবৃত্তিসমূহের দমনে নামাজ অব্যর্থ আমল। নামাজ ব্যক্তির মনকে পরিচ্ছন্ন ও পরিষ্কার করে দেয়। ব্যক্তির মনে আল্লাহর মহানত্ব ও তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রতিষ্ঠিত করে। অবাধ্যতা কিংবা গর্হিত কাজ ও অশ্লীলতার প্রতি সে আন্তরিকভাবে ঘৃণ্যভাব পোষণে সক্ষম হয়। ইরশাদ হচ্ছে :  ‘নামাজ যথার্থভাবে আদায় কর, নিশ্চয় নামাজ (ব্যক্তিকে) সব অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। (সূরা আনকাবুত : ৪৫) আল্লাহ আমাদের সবাইকে নামাজের ইহতেমাম করার তাওফিক দান করুন। আমিন

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও খতিব

বারিধারা, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর