রবিবার, ১২ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

লোকটি তবে কবি ছিল?

দিলারা হাফিজ

লোকটি তবে কবি ছিল?

(১২ মার্চ কবি রফিক আজাদ এর ১ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে)

সকালে ঘুম ভাঙতেই টের পাই আমি মার্চ মাসের ট্রেনে চেপে বসে আছি। এই মার্চ মাস আমাদের দিয়েছে অনেক কিছু, স্বাধীনতা, সার্বভৌম, লাল সবুজ পতাকায় আবৃত এক খণ্ড ভূমি, আরও কত কী? ব্যক্তিগতভাবে আবার আমার কাছ থেকে কেড়েও নিয়েছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ জীবন সঙ্গী কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদকে। স্বাধীনতার বীর সেনানী স্বাধীনতার মাসেই চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।

বিরহ ভারাতুর বুকের ভিতর থেকে হু হু করে কান্না উগরে বেরিয়ে আসতে চাইছে বারংবার। বিপুল শূন্যতার এত ভার বুকের ভিতর আজকের মতো আগে কখনো অনুভব করিনি। মার্চ মাস? এ কেমন মার্চ?

দ্রুত বাথরুমে ঢুকে চোখে-মুখে জল ভেজালাম। একি সারা মুখ চোখের জলে একাকার। এখন দেখি সশব্দে তা বেরুতে চাচ্ছে, মা এখনো ঘুমে। কান্নাচাপা শব্দ যতই  ঠেলে ভিতরে পাঠাতে চাইছি, ততই সোরগোল করে সে বেরিয়ে পড়তে চাইছে।

বাধ্য হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে চলে এলাম। মার শোবার ঘর থেকে যতটা দূরে থাকা যায়। পাছে মা জেগে না যায় কান্নার শব্দে। এমনিতে হাতের ব্যথায় রাতে ঘুম হয়নি তার।

শোফায় বসে বসে কাঁদছি। কাজের মেয়ে আয়েশা আমার কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত রেখে বলল, সাত-সকালে কাঁদছেন কেন, কী অইছে আপনার?

কিচ্ছু হয়নি আয়েশা, আমার স্বামীর কথা মনে পড়ছে। এই মার্চ মাসের ১২ তারিখে তিনি মারা গেছেন। তার কষ্টের কথা ভেবে কাঁদছি। আইসিইউ এর অত্যাচার থেকে মানুষটা বেরিয়ে আসতে চাইছিল বার বার। কিন্তু ডাক্তারদের মতামত উপেক্ষা করে আমি তাকে হাসপাতালের বাইরে বাড়িতে নিয়ে আসতে পারিনি। তার শেষ ইচ্ছের একটাও আমি রাখতে পারিনি। এক রাতে অসহ্য হয়ে তার নাকে সর্বক্ষণ ঢুকে থাকা রাইস টিউব তিনবার টেনে বের করে ফেলেছিলেন- তিন বারই দজ্জাল ডাক্তার পুনরায় তা প্রতিস্থাপন করে তাকে এতটাই কষ্ট দিয়েছিল যে, অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করবার ছিল না আমাদের।

এরপর তার হাত বেঁধে রাখা হলো, সবই নাকি রোগীর ভালোর জন্যে করছিল ডাক্তাররা এবং দিনের পরে দিন আমাদের তা মেনেও নিতে হচ্ছিল। এরপর সকালে ২-৪ মিনিট সামান্য সময়ের জন্য আমাদের যে দেখতে দেওয়া হতো, সেই সময়ে একদিন গিয়ে দেখি তার পা দুটু বাঁধা বেডের সঙ্গে। হাঁটু থেকে পায়ের পাতা অবধি চামড়া ছিলে গেছে।

কারণ কী? জিজ্ঞেস করতেই নার্স জানালো রোগী বেড থেকে নেমে চলে যেতে চাচ্ছিল বাসায়, সেই কারণে নামতে গিয়ে চামড়া ছোড়ে গেছে সামান্য। কাজেই ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করেই রোগীর ভালোর জন্যে পা বেঁধে রেখেছি। স্তব্ধবাক আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম রফিক আজাদের মাথার কাছে- আজ আর তা মনেও করতে পারছি না। হায়রে, রোগীর মানবাধিকার, এখনো সপ্তদশ শতকেই পড়ে আছে বিবর্ণ মোড়কে যেন।

মানুষটাকে বাঁচাবার জন্য কত কষ্টটাই না দিলাম ডাক্তারদের পরামর্শে। কী লাভ হলো! যদি জানতাম তিনি এই মাটির পৃথিবীতে আর থাকবেন না, তাহলে তার ইচ্ছে মতোই না হয় সব হতো। তিনি তো যাবার কালে একটু শান্তিতে যেতে পারতেন। মন যা যা চেয়েছিল সেইমতো না হয় থাকতেন আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুজন-সন্তানবেষ্টিত  হয়ে। কী ক্ষতি-বৃদ্ধি ছিল তাতে।

ভাবতে চাইনে, তবু দুঃস্বপ্নের ভাবনা আমাকে ছেড়ে যায় না। এই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের সম্মানিত ভিসি রফিক আজাদের ভাগনে, ইতিমধ্যে ৩-৪ জন মন্ত্রী এসে দেখে গেছেন রোগীকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ভিসির সঙ্গে কথা বলে রোগীর সম্বন্ধে খোঁজ-খবর রাখছেন। প্যান্ট-শার্ট পরা লোক যারা দু-চার অক্ষর পড়তে পাড়েন তারাও রোগীর নাম জানেন কবি ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে- সেই রোগীকে দিনের পর দিন ডাক্তাররা হাত- পা বেঁধে চিকিৎসা দিচ্ছেন আইসিইউ-তে।

আমরা অন্ধ-বধিরের মতো রোগীর ভালো হবে ভেবে তাদের কথা মতো কাজ করে চলেছি। অথচ, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা যে কবি তার কথার মূল্য দিয়ে তাকে বাড়িতে নিয়ে আসার সাহস করছিনে। বরং প্রতিদিন অপেক্ষা করছি মুক্তিযোদ্ধা কবির উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরের কোনো দেশে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করা হবে হয়তো।

না, রফিক আজাদের বেলায় সেটি ঘটেনি। অবশ্য কবি নিজেও তা চাননি। তিনি সব সময় নিজের দেশেই তার চিকিৎসা হোক-এ রকম মনেভাব প্রকাশ করেছেন। একদিন হঠাৎ করেই আমাকে বললেন, “আমার চিকিৎসার জন্যে কখনো ভিক্ষাবৃত্তি করো না। নিজে যেটুকু বহন করতে পারবে সেটুকুই করো।” তার এই শেষ নির্দেশ আমি পালন করতে পেরেছি শেষ পর্যন্ত- এইটুকু যা সান্ত্বনা।

দেখতে দেখতে গোটা একটা বছর পেরিয়ে যেতে যেতে কবির ১ম মৃত্যুবার্ষিকী ও সমাগত প্রায়। এর মধ্যে পার হলো তার ৭৫তম জন্মবার্ষিকী। ব্যক্তি পর্যায়ে কবির শুভানুধ্যায়ী-বন্ধু-ভক্ত-স্বজন-সন্তানদের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদ। এ পর্ষদের উদ্যোগে পালিত হলো কবির ৭৫তম জন্মদিনের উৎসব। এ উপলক্ষে কবির ৭৫টি প্রেমের কবিতা নিয়ে চিত্রা প্রকাশনী প্রকাশ করেছে কবিতা ৭৫। কাশবন পত্রিকার মিন্টু হক কবিকে ভালোবেসে প্রকাশ করেছে ৭৩২ পৃষ্ঠার স্মরণিকা ‘অমেয় আলোর কবি রফিক আজাদ’।

তবু কোথায় যেন এক শূন্যতা ভর করে বসে আছে মনের গোপন গহ্বরে। যার যা প্রাপ্য আমরা যেন তা দিতে পারিনি অথবা দিতে চাইনে অকৃপণ হাতে।

কারু কারু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম যে হয় না তা নয়। শুধু রফিক আজাদের বেলায় সময় আর ইতিহাস অনুকূল হলো না কখনো। প্রতিকূলের সমুদ্র সাঁতরে অবশেষে পার হলেন তিনি এক কবির জীবন। যে জীবন সম্পর্কে নিজেই কবিতা লিখে বলে গেছেন সবটা।

 

 লোকটি তবে কবি ছিল?

 

সুখে তারও লোভ ছিলো—চিরকাল অসুখে ভুগেছে।

মাথার অসুখ ছিলো, লোকটির—বুকের, দাঁতের—

নিত্যসঙ্গী গিঁটেবাত, হাঁটতো তাই খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে;

শেষ দিকে শ্বাসকষ্ট—নিঃশ্বাসের জন্যে এক বুক

বাতাসও তার ভাগ্যে বরাদ্দ ছিলো না!—লোকটির

শরীরে অসুখ ছিলো নানা—এ জন্যে সে আজীবন

লাঞ্ছিত হয়েছে আর অপমান সয়েছে অনেক।

সমাজে ছিলো না তার, বলতে গেলে, সামান্য প্রভাবও;

লোকটির কোনো গুণই, কোনোদিন, সমাজ দ্যাখেনি!

 

শরীরে অসুখ ছিলো—ছিলো না চোখের কোনো দোষ,

এবং জিহ্বাও তার অসম্ভব অনাড়ষ্ট ছিলো—

 

শেষোক্ত দোষের জন্যে লোকটির মৃত্যুদণ্ড হয়!

লেখক : কবিপত্নী

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর