শনিবার, ১৮ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

২০৩০ : বিশ্বকর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমানে সমান

শাইখ সিরাজ

২০৩০ : বিশ্বকর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমানে সমান

৮ মার্চ বিশ্বব্যাপী পালিত হলো বিশ্ব নারী দিবস। জাতিসংঘের এবারের প্রতিপাদ্যের আহ্বান ২০৩০ সালের ভিতর কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতা অর্জনের দিকে। বহু পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দিনটিকে অনেকেই অবশ্য পালন করছেন ‘পরিবর্তন আনব, দৃঢ় থাকব’! এ প্রতিপাদ্য সামনে নিয়ে। নারী দিবস এক বহু পুরনো সংগ্রামের দিন। এটা ঠিক এবং সর্বসম্মত মত যে, নারীর প্রতি বৈষম্য এবং অন্যায়-অবিচারের ইতিহাস প্রাচীন। আর আমাদের দেশে, বিশেষ করে গ্রাম এলাকার নারীরা যথার্থ অধিকারবঞ্চিত। যেখানে কৃষিশ্রমের বিষয়টিতে নারী ও পুরুষের বিভাজন অনেক বড়। ফারাকটা বেশি। নারী দিবসের শুরুটাও হয়েছিল শ্রমক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অসম একটি জায়গা থেকে। বিশ শতকের শুরুর দিকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে নারী দিবসের উত্থান। ১৯১১ সালে জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন এ দিবস পালনের আওয়াজ তোলেন। অক্টোবর বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো এ দিনটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে থাকে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের আহ্বানের পর দিবসটি বৈশ্বিক স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে নারীদের বিশাল অবদানে ঘরে-বাইরে, শিক্ষা, অর্থনীতি, কৃষি— সব ক্ষেত্রেই আমরা উন্নয়ন করেছি। তবে নারীর প্রতি বৈষম্য কেন এখনো কমছে না বা এই কিতাবি কথাগুলো আর কত দিন বলে যেতে হবে, তাই ভাবছি। আমার টিভি অনুষ্ঠানে আমি বহুবার বলেছি, ধান উৎপাদনে যতগুলো ধাপ রয়েছে, তার বেশির ভাগই সম্পন্ন করেন নারীরা। অথচ নিজে দেখেছি পুরুষ শ্রমিক টাকা পায় বেশি। আর নারীরা কম। অথচ নারী শ্রমিক একটুও কম কাজ করছে না পুরুষের চেয়ে। কাজের কোনো কমতি নেই তাদের। যেমন মাঠে তেমনি ঘরেও। যদিও নানান প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৫ নম্বর শর্ত হলো লিঙ্গসমতা। টেকসই উন্নয়নের কথা বলছি আমরা এখন। কিন্তু সহস্রাব্দ উন্নয়নে এখনো বেশকিছু কাজ পড়ে আছে। তার অন্যতম হলো চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগ এবং অন্যদিকে শ্রমজীবী নারীরা পুরুষের সমান মজুরি পায় না। যদি সরকার পর্যায়ের কথা বলি, স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের বাধা হচ্ছে তাদের পুরুষ সহকর্মীরা। রাজনীতির শীর্ষে নারী নেতৃত্ব থাকলেও রাষ্ট্র ও রাজনীতির নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় নারীর গুরুত্ব কম। অথচ শিক্ষার সকল পর্যায়েই এগিয়ে আছে নারীরা। কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে অনেক নারী কৃষকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। তাদের সাফল্যগাথা তুলে ধরেছি টেলিভিশনে, পত্রপত্রিকা আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যশোরের হামিদা বেগম, গদখালীর ফুল উৎপাদক ও বিক্রেতা বারিসন, জৈব কৃষির পথিকৃৎ নরসিংদীর সেলিনা জাহান, জাহেদা বেগম, জয়পুরহাটের রেহানা বেগম এবং পাহাড়ি অঞ্চলে, রাঙামাটির বেবি চাকমা। এদের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। কী পরিশ্রম আর সৃজন দিয়ে তারা নিজেদের সঁপে দিয়েছেন দেশের উন্নয়নে আর ব্যক্তি উন্নয়নে, তা কল্পনাতীত। আর এসব কিংবদন্তিতুল্য নারীর পেছনে হেঁটেছেন অসংখ্য অন্য নারী। যারা সফল হয়েছেন নারীর আদর্শ সামনে রেখেই। আমরা শুধু মুখে মুখেই হয়তো বলি, বাংলাদেশের উন্নয়ন, গ্রামীণ এবং জাতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো নারীরা। কিন্তু কেন আমরা তাদের খাতা-কলমে এ স্বীকৃতি দিয়ে থেমে যাচ্ছি, তা বোধগম্য নয়। এ লেখার শুরুতেই অবশ্য সে কথা কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

গোটা পৃথিবীর মোট কৃষি শ্রমশক্তির ৪৩ ভাগ হলো নারী। কোনো কোনো দেশে তা ৭০ ভাগের মতো। আমরাও সে কাতারেই পড়ি। যদিও আমাদের নারীদের বিশাল অবদান রয়েছে কৃষি খাতে, কিন্তু একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৭৭ ভাগ নারী ক্ষমতায়নের মহাসড়ক থেকে বহুদূরে অবস্থান করছে। যখন সত্যি একজন নারীর ক্ষমতায়ন হবে, তখনই তারা তাদের নিজস্ব পছন্দের এবং অধিকারের কথা গলা উঁচু করে বলতে পারবে। তারা জমিতে অধিকার পাবে, অগ্রাধিকার পাবে সুযোগে আর নেতৃত্বে আসবে আরও বেশি। আর এভাবেই তো পুরো অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। যা খাদ্য নিরাপত্তার পথ সুগম করবে। এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নারীর এ উন্নয়ন বিশাল এক অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

দেখুন, বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ বা ডিজিটাল বিপ্লব আমাদের জন্য নানান সুযোগ নিয়ে এসেছে। এ সুযোগগুলো কাজে লাগিয়েছে নগরের নারীরা। এ উন্নয়নের ছোঁয়া আরও বিস্তৃতভাবে গ্রামীণ নারীদের জন্য কবে সহায়ক হতে পারে, সে নিয়েই ভাবছি আমরা। তবে গ্রামীণ নারীদের উন্নয়নের মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশের উন্নয়ন হবে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। শ্রমের ধরনে অনেক পরিবর্তন আসছে। জীবিকা এবং আয়-রোজগার অনেকাংশে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে, নতুন নতুন বাণিজ্যনীতি আসছে, আসছে পরিবেশগত নানান পরিবর্তন। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে এ বিষয়গুলোর দিকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেই হবে।  কিছু সাম্প্রতিক তথ্য দিচ্ছি আপনাদের, প্রিয় পাঠক। সিএসআরএল জরিপমতে, গত দশকে নারী শ্রমিক ৩০ লাখ থেকে বেড়ে ৮০ লাখে চলে গেছে। ১১৬% বৃদ্ধি বলছে গবেষণাটি। আর পুরুষের শ্রম কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে, ১০.৪ শতাংশ হারে। বাংলাদেশে আমরা দেখছি ৭৭ ভাগ নারী শ্রমিকের বাস গ্রামে। এ-সংখ্যক নারী বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর এদের ওপরে প্রভাব ফেলতে অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় তো আছেই। দিন দিন বড় কঠিন বাস্তবতার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের গ্রামীণ নারীরা। নোবেলজয়ী ড. অমর্ত্য সেন একদিন আমাকে বলছিলেন, ‘যেসব পরিবারে নারীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, সেখানে তাদের সন্তানরা আরও সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে। আর এটা তখনই হয়, যখন নারীদের আয়-রোজগার বাড়ে।’

প্রিয় পাঠক! সবশেষে বলতে চাই, আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার পেছনের ‘গেটকিপার’ হচ্ছে নারীরা। তাদের কারণেই আজ কৃষি খাতে একটা নীরব বিপ্লব সাধিত হয়ে গেছে। আমরা হয়তো তা টের পাচ্ছি না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের নারীরা এর থেকেও বড় কোনো অর্জন দিয়ে পুরো জাতিকে অবাক করে দেবে। যেমন আজ সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে নারী কৃষকরা আমাকে অভিভূত করেছে তাদের নিরলস কাজ দেখিয়ে। হয়তো অঙ্কে হিসাব করা যাবে না তাদের অবদানের অংশটি। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের অনেকের ভিতর এখনো নারীকে হেয় করে দেখার সংস্কার রয়ে গেছে। অথচ সমাজের অর্ধেক, দেশের অর্ধেক, পরিবারের অর্ধেক ও কর্মশক্তির অর্ধেককে আটকে রাখলে তা দেশের উন্নতিকেও যে আটকে রাখবে তা যেন আমরা ভুলে না যাই। ২০৩০ সালে নারী-পুরুষে সমানে সমান বিশ্বকর্মক্ষেত্রটি দেখার আশায় বুক বেঁধে রইলাম।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর