বুধবার, ২২ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

স্বাধীনতা পেয়েছি মুক্তি অনেক দূর

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

স্বাধীনতা পেয়েছি মুক্তি অনেক দূর

মার্চ মাস এখন শেষার্ধে। বছর ঘুরে এ মাসটি এলেই মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্মের মানুষের মনপ্রাণ ভরপুর হয়ে ওঠে একাত্তরের মার্চ মাসের উত্তাল তরঙ্গে ঘেরা উত্তেজনা আর রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে। যে অনুভূতির অপর নাম চেতনা। ৭ মার্চের ভাষণের শেষপ্রান্তে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।  সেই সংগ্রামের পথ ধরে ভৌগোলিক স্বাধীনতা আমরা একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে অর্জন করেছি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় ও তাদের বিতাড়নের মধ্য দিয়ে। কিন্তু গত ৪৫ বছর ধরে যে প্রধান প্রশ্নটি সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো, বঙ্গবন্ধু সেদিন যে মুক্তির কথা বলেছিলেন তার কতদূর কী হলো?

৪৫ বছরে কতদূর এলাম? যে শেকল ও বন্দিত্ব থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম তা পেতে আর কত সময় লাগবে? কয়েক দিন পরই ৪৬তম স্বাধীনতা দিবস। দিবস পালনকে সার্থক করতে হলে এবং দীর্ঘ সংগ্রাম ও ৩০ লাখ মানুষের জীবন বিসর্জনকে অর্থবহ করতে চাইলে আজ এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে। চ্যালেঞ্জগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। ঐতিহাসিক সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জনের পথে আজকের বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে মুক্তি বলতে আসলে কী বুঝি তা নিয়ে জাতিগতভাবে এখন আমরা বিরাট বিভাজনের গর্তে পড়ে গেছি। তাই ৪৫ বছর পরেও আকাঙ্ক্ষিত মুক্তির শেষ সীমানা আমাদের নজরে আসছে না। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর মাত্র ১০ মাসের মাথায় রাষ্ট্রের মূল দলিল বাহাত্তরের সংবিধানে একেবারে শুরুতে জাতীয় মুক্তি অর্জনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়, ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছি। অর্থাৎ নির্ধারিত হলো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য হলো জাতীয় মুক্তি অর্জন, স্বাধীনতা অর্জনই শেষ কথা নয়, মুক্তি অর্জনের পন্থা মাত্র। তাই আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি অর্জিত না হলে স্বাধীনতা অর্জন ব্যর্থ হয়ে যায়।

মুক্তির স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য কী হবে তাও ওই একই লাইনের মধ্যে প্রোথিত করা হয়, যার প্রকাশ ঘটে ঐতিহাসিক সংগ্রাম কথাটি যথার্থভাবে মুক্তি কথাটির সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছর সংগ্রামের বড় দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, রাজনৈতিক মুক্তি, যার মর্মবাণী হচ্ছে রাষ্ট্রীয় অঙ্গনের সর্বক্ষেত্রে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সমঅধিকার নিশ্চিত করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বিতর্কের ঊর্ধ্বে অবধারিত থাকবে। দ্বিতীয়ত ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি। পাকিস্তান আমলে মুক্তিলাভের প্রধান অন্তরায় ছিল রাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। যার শত শত ব্যবহারিক উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ আছে। পত্রিকার কলামে তা লেখার জায়গা হবে না। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক যাতে তার রাজনৈতিকসহ সব অধিকার ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সমভাবে পেতে পারে সে জন্য বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মনিরপেক্ষতা। লক্ষ্য অর্জনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ যাত্রা শুরু হয়। এটা তো দু-চার বছরে সম্ভব হয় না। তাই এর জন্য সমগ্র জাতির মান স্বতন্ত্রকে তার উপযোগী করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু উপযুক্ত শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। কিন্তু তার বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার আগেই সব কিছু উল্টে যায়। তারপর কেন এবং কীভাবে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্য ও তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে জাতির মধ্যে চরম বিভাজন সৃষ্টি হলো সেটাও আজকে বোঝা দরকার। পঁচাত্তরের পরে ক্ষমতায় আসা সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক আদেশ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করে দিলেন এবং একই সঙ্গে সংবিধানের প্রারম্ভে উল্লিখিত জাতীয় মুক্তির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা ছিল তাও উঠিয়ে দিলেন। অর্থাৎ মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যটাকেই রাখা হলো না। আর লক্ষ্য না থাকলে তা অর্জনের প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু দেশের বৃহত্তর জনগণ তা মেনে নেয়নি বিধায় স্বাধীনতা অর্জনের মৌলিক উদ্দেশ্য নিয়েই নতুন করে বিতর্ক শুরু হলো এবং জাতি চরমভাবে বিভাজিত হয়ে পড়ল। যা এখনো অব্যাহত আছে। রাষ্ট্রের মৌলিকত্ব নিয়ে বিভাজন থাকলে মুক্তির পথ কঠিন হয়ে যায়। বাংলাদেশে তাই ঘটেছে। গণতন্ত্র এখন সবচেয়ে সস্তা কথা হয়ে গেছে। স্বৈরাচারী সামরিক শাসকদের রাজনীতিতে বিশ্বাসীরাও আজ গণতন্ত্রের কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন নিজেকে গণতান্ত্রিক দেশের নেতা মনে করেন। কারণ, তার দেশের নাম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। তাই ব্যবহারিক ও প্রচার-প্রচারণার দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বে আমরা বহুরূপের গণতন্ত্র দেখতে পাই।

 

 

আমরা স্বচক্ষে দেখেছি ও শুনেছি পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নিজেকে পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জনক বলতেন। সেটি প্রচার করার জন্য রেডিও-টেলিভিশন, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের অভাব ছিল না। ১৯৬৯ সালে তিনি গণতন্ত্র ও উন্নয়নের এক দশক পূর্তি উৎসব করেছিলেন ঢাকঢোল পিটিয়ে। এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো আইয়ুব খানের তথাকথিত গণতন্ত্রই পাকিস্তানকে ডুবিয়েছে। পরবর্তীতে পাকিস্তানের আরেক সামরিক শাসক জিয়াউল হক ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে এবং কট্টর শরিয়া আইন জারি করে নিজেকে গণতন্ত্রের প্রবর্তক মনে করতেন, যার হাত ধরে বিশ্বে সশস্ত্র জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিস্তার ঘটেছে। সেটি এখন মানব জাতির সভ্যতা ও গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। আইয়ুব খান ও জিয়াউল হক দুজনেই রাষ্ট্রতন্ত্রের সঙ্গে কট্টর ধর্মবাদিতাকে মিশিয়ে সেটাকে গণতন্ত্র বলে চালাতে চেয়েছেন। এই যে উদাহরণগুলো দিলাম, এর বিপরীতে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ব্যবহারিক দিকটাও আমরা দেখতে পাই। যে গণতন্ত্রের হাত ধরে যুক্তরাষ্ট্র বহু আগেই বিশ্বের এক নম্বর শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের স্বরূপটা তুলে ধরার জন্য একটা উদ্ধৃতি দিই। ১৯৯২ সালে একটি সাংবিধানিক রুল নিষ্পত্তিকালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হ্যারি এ ব্লাকমান তার রায়ে উল্লেখ করেন, “Allowing religious differences to invade the public arena- presented a direct threat to the fundamental concepts of freedom, equlity and democracy on which the nation had been built.” অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে ধর্মের ব্যবহার আমাদের মৌলিক দর্শন স্বাধীনতা, সমঅধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য সরাসরি হুমকি। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের উপরোক্ত রায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধানের মৌলিক দর্শনের হুবহু মিল রয়েছে।

সুতরাং ধর্মতান্ত্রিকতা ও সাম্প্রদায়িকতা মিশেলের গণতন্ত্র মানুষের জন্য ইহজাগতিক মুক্তি আনতে অক্ষম, যা পঁচাত্তরের পরে বাংলাদেশের কপালে ঘটেছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় সমৃদ্ধ গণতন্ত্রই আমাদের আকাঙ্ক্ষিত মুক্তি আনতে পারে, অন্য কোনো পন্থার গণতন্ত্র নয়। সমস্যা শুধু এখানে নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েও আজ উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। চেতনা মানুষের মনোজগতের বিষয়। এক প্রকার মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। মানুষের চেতনা বহু রকমের থাকে। জাতীয় চেতনা থেকে শুরু করে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, বংশগত ইত্যাদি। এর কোনোটাই শূন্য থেকে আসে না বা সৃষ্টি হয় না। প্রত্যেকটি চেতনা সৃষ্টির পিছনে কাজ করে বিগত দিনের ঘটনা প্রবাহ এবং তার সঙ্গে জড়িত মহান সব মানুষের কীর্তি ও কর্মকাণ্ড। এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগরণের শ্রেষ্ঠ মাস মার্চ। একাত্তরের ১ মার্চ থেকে শুরু করে ২৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিটি দিনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৃষ্টির অনন্য উজ্জ্বল মাইলফলক। প্রত্যেকটি ঘটনাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে চেতনা সৃষ্টির অফুরন্ত ভাণ্ডার। তাই একাত্তরের মার্চসহ ২৩ বছরের সংগ্রামের পথে সংঘটিত উজ্জ্বলতম সব ঘটনা, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয়ের মধ্য দিয়ে সংঘটিত ঘটনাবলির ভিতর থেকে যে চেতনার উন্মেষ হয় সেটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এর বাইরে অনেক রকম চেতনা থাকতে পারে, সেগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলার সুযোগ নেই। তাই যারা উপরোক্ত ঘটনাবলির যথার্থ মূল্যায়ন করে না, মর্যাদা দেয় না, তাদের মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা প্রহসন ও ভণ্ডামির মতো শোনায়। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৫ বছরের মাথায় এসে এরকম কথা বলতে হচ্ছে এই কারণে যে, পঁচাত্তরের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির সুবিধাভোগী হিসেবে যাদের উত্থান ও বিস্তার ঘটেছে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগানিয়া উপরোক্ত ঘটনাবলির মূল্যায়ন তো করেই না, বরং সেগুলোকে ইতিহাস থেকে বাতিল করে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা আগেও করেছে, এখনো করে যাচ্ছে। এই পর্যায়ে আরেকটি কথা বলতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের দর্শন, আদর্শ ও চেতনা বলতে যা কিছু বোঝায় অন্য কিছুর সঙ্গে এর কোনো আপস হবে না। গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র অধ্যাপক একটি পত্রিকায় তার কলামের মাধ্যমে বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম দুটোই সংবিধান থেকে বাদ দিলে রাজনৈতিক ঝগড়া মিটে যাবে। এই অধ্যাপক মহোদয় এখন প্রায়শই টেলিভিশনের টকশোতে আসেন। কারণ, তিনি নিরপেক্ষ।

নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে তারা এই প্রচারণাটি চালাতে পারছেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। এটিও বড় ভয়ের জায়গা। ধর্মনিরপেক্ষতাহীন গণতন্ত্র হবে আইয়ুব খান বা অন্য কোনো সামরিক স্বৈরশাসকের ভাষার গণতন্ত্র, সেটি মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র হবে না।  সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরে এলেও রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মতান্ত্রিক রাজনীতি বহাল থাকায় মুক্তির পথে অগ্রগতি শ্লথ এবং বিপজ্জনক অবস্থায় আছে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

নিউ অরলিনস, ইউএসএ।

সর্বশেষ খবর